মাঝে মাঝে আঙুল বাঁকা করতে হয়

0

এস এম মনসুর নাদিম,সিটিনিউজ :: বিক্রয় সহযোগীদের(MERCHANDISER) সবসময় আউট ডোরের আপডেট থাকা চাই। Compititor দের Product’র প্যাকেজিং এ কোন রদবদল করেছে কিনা, কোন অফার সংযোজন করেছে কিনা কিংবা কোন ক্ষেত্রে মুল্য ছাড় দিয়েছে কিনা তা দেখে সাথে সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। নিজদের Product’র মেয়াদোত্তীর্ন তারিখ সহ ড্যামেজ পণ্য চেক করে তার যথাযথ দ্রুত ব্যাবস্থা করা উত্তম বিক্রয় সেবার অন্তর্ভুক্ত।

Short expiry আর Damage পণ্য সবসময় হাসিমুখে চেঞ্জ করে দেবেন।কিছু কিছু মার্কেটে Short expiry আর Damage পণ্য গুলো ফেরত নিতে / দিতে নানা রকমের পেপার ওয়ার্ক করতে হয়, এতে বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করবেননা। কারণ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু নিয়ম থাকে। যেই কাস্টমারের যেই নিয়ম সেখানে সেই নিয়মকেই ফলো করার নামই বিজনেস। আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি Food Company’তে কাজ করতাম। রোজ আমাকে ডেরা সিটি সেন্টারে যা বর্তমানে CARRE FOUR নামে পরিচিত সেখানে ভোর ছয়টার সময় যেতে হতো। আমাদের Product গুলো Arrange আর Display করতে হত। একটু বিলম্ব হলে ঢুকতে দেয়া হতোনা।

সেলফ বয় গুলো নিজেদের কাজের চাপ কমাতে অন্য কোম্পানির MERCHANDISER দের দিয়ে কাজ করাতে নানারকম ফন্দিতে থাকতো। ওখানে Display’র Space গুলো সব Rental. তাই যার যতটুকু বরাদ্ধ জায়গা তার থেকে একচুল আগে বাড়ালে ঝামেলা বাধায়। কিন্তু কোন রকমে যদি তাকে আপনি খুশি করতে পারেন তো আপনার জন্য বরাদ্ধ জায়গার বাইরেও Display করা কোন ব্যাপার না। যে কোম্পানি গুলোর মার্কেটিং টিম দক্ষ তারা টেলিফোন সেট দিয়ে, কার্ড দিয়ে, নগদ টাকা দিয়ে এই সেলফ বয় ও সেলফ সুপারভাইজারদের কাবু রাখে।

এ ব্যাপারে আমার দুটো অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চাই। DEIRA CARRE FOUR এর এক Shelf boy’র সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিলনা। সবসময় আমার প্রোডাক্ট গুলোকে সে ডিসপ্লে থেকে আউট করে রাখতো। প্রতিদিন তার সাথে আমার কিচ কিচ হত। একদিন অন্য এক কোম্পানির সেলস ম্যান আমাকে বললেন- ওকে কিছু দেন কোম্পানি থেকে নিয়ে হলেও।

সব কোম্পানি গুলো এদের দিয়ে দিয়ে অভ্যাসটা খারাপ করে ফেলছে। এদিকে আমাদের পাকিস্তানি ম্যানেজম্যান্ট। বললেও তেমন কিছু দেবেনা।পাকিস্তানীরা খেতে ভালোবাসে দিতে নয়। তাই চিন্তা করতে লাগলাম কী করে এই বদ টাকে বশ করা যায়। আমাকে আমার Sale দেখাতে হবে। আমার পারফরম্যান্স দেখাতে হবে। একটা ক্ষুদ্র আইডিয়া এলো মাথায়।

পরদিন আসার সময় করাচি সিটি রেস্টুরেন্ট থেকে তার জন্য পার্সেল একটা দোসা নিলাম। এসেই পলিথিনের পুটলিটা তার হাতে দিতেই সে চমকে উঠলো। নিতে চাইলো না। বললাম, আরে দোস্ত খাও। আমি ব্রেকফাস্টে খেয়েছিলাম। ভালো লাগলো তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম। সে অনেক সতর্কতার সাথে নিয়ে আমাকে ধন্যবাদ বলে তাদের খাবার রুমে ঢুকে গেলো। পরদিন আবারো একই কাণ্ড করলাম। যথারীতি সংকোচিত চিত্তে ( নাকি ভয়ে ভয়ে) হাত বাড়িয়ে নিয়ে ধন্যবাদ বলে ঢুকে গেলো খাবারের রুমে। এভাবে চলল প্রায় একমাস। এর মধ্যে তার কলিগেরা সবাই জেনে গেছে আমি তার জন্য প্রতিদিন ব্রেকফ্রাস্ট নিয়ে আসি। আমিও নির্বিগ্নে আমার প্রোডাক্ট এর ডিসপ্লে করে যাচ্ছি। আমার মার্কেটিং ম্যানেজার আমার পারফরম্যান্সে অনেক খুশি।

একমাস পর আমি দোসা আনা ছেড়ে দিলাম। এতে ঐ সেলফবয় আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আবারো আগের মুর্তি ধারন করলে আমি চড়া গলায় বলে দিলাম-দুঃখিত, আমার সীমিত আয়। প্রতিদিন আপনার জন্য ব্রেকফ্রাস্ট আনা আমার জন্য সম্ভব না। এতে লোকটা ক্ষেপে গিয়ে আমার ডিসপ্লের জায়গাটা সংকোচিত করে দিলে আমি তাকে বললাম- দেখো ভাই, আমার ডিসপ্লেতে কোন গড়বড় করবে আমি তোমার ফ্রান্সি ম্যানেজারকে বলে দেবো তোমার জন্য ব্রেকফ্রাস্ট আনছিনা বলে তুমি আমার সাথে এরকম করছো। পরেরদিন থেকে আমার ডিসপ্লে আগের চেয়েও বিস্তৃত হয়েছে এবং ভারতের কেরেলা প্রদেশের ঐ সেলফবয় এর প্রমোশন হয়ে সুপার ভাইজার অতঃপর ম্যানেজার হওয়া অবধি আমার সাথে তার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

এখানে বোঝাতে চেয়েছি যে, কিছু কিছু জায়গায় ভালো আচরণে কাওকে বশ করতে নাপারলে একটু আঙুল বাঁকা করতে হয়। তাও স্থান-কাল-পাত্র বুঝে। আরেকটি ঘটনা বলছি এটাও আজমান CARRE FOUR’র ঘটনা।আমার কলিগ পাকিস্তানি সিন্ধি খাদিম হুসাইনের CARRE FOUR ID টা মার্কেটের ভেতরে কোথায় যেন পড়ে গেছে। বেচারা পাগলের মত খুঁজছে। কিন্তু পেলনা।

জনৈক সেলফবয় এসে ফিস ফিসিয়ে বলল- আমাকে ১০০০ দেরহাম (বর্তমান বাজার মুল্যে-২১০০০ টাকা)দিলে আমি খুঁজে দেবো। উল্লেখ্য ঐ আইডি ব্যাতীত CARRE FOUR এ প্রবেশ করা যাবেনা। আবার নতুন করে বানাতে গেলে ১০০০ দেরহাম জমা করতে হবে। খাদিম হুসেইন বুঝতে পারলো জিনিষটা সে পেয়েছে। অনেক অনুনয়-বিনয় করলো। কারণ প্রথমে সে মনে করেছে ওই লোকটা টাকা দাবি করে মজা করছে। পরে বোঝা গেলো ওই লোকটা সত্যি সত্যি টাকা দাবি করছে। নিরুপায় খাদিম হুসেইন দর-দাম করে ৫০০ দেরহামে লোকটাকে রাজি করিয়েছে।

কথা হল পরদিন সকালে খাদিম হুসেইন টাকা নিয়ে আসবে এবং ওই সেলফবয় আইডি দেবে। পরদিন খাদিম হুসেইন ৫০০ টাকার একটা কচকচে নোট দিয়ে সেলফবয় থেকে তার আইডি টা নিয়ে ম্যানেজারের সাথে দেখা করে নোটের নম্বর লেখা একটি কাগজ ফ্রান্সি ম্যানেজারকে দিয়ে ঘটনাটা বিস্তারিত বললে, ম্যানেজার দ্রুত ফ্লোরে এসে ওই সেলফবয়ের পকেট সার্চ করে খাদিমের দেয়া ৫০০ দেরহামের নোট পেলেন। অতঃপর শো-কজ, লেটার, বরখাস্ত।

এখানে শিক্ষনীয় বিষয় হল দুটি-১, সেলফবয়টার এতটা লোভী হওয়া উচিৎ ছিলনা এবং সে যথাযথ প্রশিক্ষিত ছিলনা। তার উচিৎ ছিল নিজের কলিগের সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ করা। এতে তার বিচক্ষণতা প্রকাশ পেতো এবং দুর্মুল্যের বাজারে পাওয়া চাকুরিটাও রক্ষা পেতো। ২, যখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। ওখানে CARRE FOUR, সিটি সেন্টার, কো-অপারেটিভ,সহ নানা শপিংমল গুলিতে মার্চেন্ডাইজিং এর জন্য খুব ভোরে পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকতে হয়।

তখন সেখানে শুধুমাত্র সেলফ বয়েরা ও মার্কেটগুলির নাইট শিফটের সিকিউরিটিরা থাকে। একদা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম ষ্টেট ফজিরাহ লু লু সেন্টারে সামান্য একটা সমস্যার কারনে আমাদের মার্চেন্টাইজারের সাথে এরিয়া ইনচার্জ হিসেবে আমাকে যেতে হয়েছিল। ওই সমস্যার সমাধান করে বের হওয়ার সময় দেখি একটা ভারতীয় তরুণকে ঘিরে মার্কেটের সিকিউরিটি অফিসার ও সুপার ভাইজার সহ মানুষের ভিড়।

জটলায় উঁকি দিয়ে পরিচিত একজনকে দেখে ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করায় লোকটি বলল-ওই ভারতীয় তরুণটি একটি কোম্পানির নতুন মার্চেন্টাইজার। গতকাল মার্চেন্টাইজিং করতে এসে ভেজিটেবল সেকশনে ঘুরে ঘুরে কলা আর কিছু ফ্রুটস খেয়েছে যা মার্কেটের ইনডোর সিসি টিভি ক্যামেরার রেকর্ডে ধরা পড়েছে। কী লজ্জার বিষয়। এখানে এই বিক্রয় সহযোগীকে (MERCHANDISER) যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। বিদেশে নয় শুধু এখন বাংলাদেশেও সর্বত্র সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো আছে।

আর ক্যামেরা না থাকলেও একজন শিক্ষিত সুস্থ লোক কখনো এ ধরনের অপরাধ করতে পারেনা। কিছু কিছু ছোট ছোট কোম্পানি অর্ধশিক্ষিত হেল্পার বা লেবারদের মার্চেন্টাইজার এর ইউনিফরম পরায়ে মার্কেটে ছেড়ে দেয়।ফলে এ ধরনের ছোট-খাটো ঘটনায় কোম্পানির গুড ওইল নষ্ট হয় কোম্পানিকে লজ্জা ও বিব্রতকর অবস্থায়তো পড়তে হয় আবার ব্যবসায়েও এর প্রভাব পড়ে। এখানেই ভুল। কোম্পানিগুলো খরচ বাঁচানোর জন্য কম বেতনে অদক্ষ লোক নিয়োগ দেবে আর এদের দ্বারাই কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি হবে। তাই উর্দুতে একটা প্রবাদ আছে-‘সস্তা রোনা বারবার মেঙ্গা রোনা একবার’। অর্থাৎ সস্তা কান্না বারবার, দামী কান্না একবার। (চলমান)

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.