জুবায়ের সিদ্দিকী:: নগরীর আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা, মোগলটুলি, বেপারী পাড়া, এক্সেস রোড়, সিডিএ আবাসিক এলাকা, আবিদর পাড়া, বিল্লাপাড়া, সিজিএস কলোনি, মুহুরী পাড়া, গুলবাগ, শান্তিবাগ, ছোটপুল, হালিশহর হাউজিং এষ্টেট, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, বক্সিরহাট, চরপাথরঘাট সহ নিন্মাঞ্চলের বাড়িঘর বছরে সাত মাস ধরে খালি পড়ে থাকে। এসব এলাকায় দিনে দুইবার করে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। বৃষ্টি হলে এই জোয়ারের পানি হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত হয়। এসব এলাকার সড়কগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে অনেক আগেই। পানিতে ভেসেছে দিনের পর দিন ও রাস্তাঘাটের বেহাল দশা এ অবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবিত বাড়তি গৃহকর নিয়ে নাগরিক মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। ভাঙ্গা-জরাজীর্ন সড়ক সংস্কারের দাবী ও এসেসমেন্টের নামে বাড়তি গৃহকর ধার্য করার প্রতিবাদে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নগরীর রাজপথে মানববন্ধন ও সমাবেশ করছে।
সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে নগরীর ৩৩০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম অর্থনীতির প্রানকেন্দ্র হলেও নগরীর অধিকাংশ সড়ক এখন মরণ ফাঁদে পরিনত হয়েছে। সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, নগরবাসীর দুর্ভোগের কথা সিটি কর্পোরেশন ভাবছে না। সড়কের দুরাবস্থার পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রতিদিনই নগরীতে নানা শ্রেনী পেশার মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত রেখেছেন। এ ব্যাপারে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি নুরুর আবছার বলেন,’ ভাড়ার ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিল করে পুর্বের পদ্ধতিতে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে। আমরা নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে আমাদের ন্যায্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। সিটি কর্পোরেশন মনগড়া এসেসমেন্টের নামে নগরবাসীর উপর গলাকাটা করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে জনগনের অশান্তির শেষ নেই।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কাজ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সিটি কর্পোরেশন নতুন ভাবে গৃহকর এসেসমেন্টের নামে বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে’’। নগরীর চাক্তাই এলাকার বাসিন্দা নুর বেগম। তার মালিকানাধীন ৪১৬ বর্গফুটের একতলা ভবনের ভ্যালুয়েশন করা হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পাশের দুটি ভবন মরিয়ম বেগম ও বিলকিছ বেগমের। ভবন দুটিও ৪১৬ বর্গফুটের। অথচ ভবন দুটির মুল্যায়ন ধরা হয়েছে মাত্র ২৭ হাজার টাকা। এসেসমেন্ট করার সময় সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা অবৈধ উৎকোচ নিয়ে অনেকের মুল্যায়ন কমিয়ে দিয়েছেন। আবার অবিশ্বাস্য অংকের ভ্যালুয়েশন করা হয়েছে অনেক ঝুঁপড়ি ও বস্তি ঘরকেও। ১০ হাজার টাকা থেকে লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছে তারা। আবার এসেসমেন্ট ঘোষনার পর নগরবাসী যেসব আপিল করেছেন তার বিপরীতেও অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে মেয়রের নির্দেশ অমান্য করে প্রতিটি আপিল ফরমে ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫ শ’টাকা পর্যন্ত নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। নগরবাসীর অভিযোগ, কর পুনর্মুল্যায়নের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন যে পরিমান রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে তারচেয়ে বেশি অর্থ অবৈধ লেনদেন হয়েছে।
এদিকে নগরীর লাভ লেইন মোড়ে নগর বিএনপির উদ্যোগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করেছে। সমাবেশে নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে সবাই রাজি। কিন্তু তা যৌক্তিক হতে হবে। তিনি এ বর্ধিত কর অবিলম্বে প্রত্যাহার করার জন্য মেয়রের প্রতি আহবান জানান’। এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অদক্ষতা, পরিকল্পনাহীনতা ও সমন্বয়ের অভাবে নাগরিক দুর্ভোগ প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাপন মারাত্বকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যারা দল থেকে মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি হয়েছেন তাদের অনেকেই এখন ব্যক্তিগত আখের গোছানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।
গত ৬ অক্টোবর সকালে তার চশমাহিলস্থ বাসভবনে চট্টগ্রাম মহানগরীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবি ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ তার সাথে সাক্ষাত করতে এলে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি দৃঢভাবে বলতে চাই, জনগনের সাথে থেকে রাজপথে আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আমার বেড়ে উঠা। কেউ যদি জনগনের মনের ভাষা পাঠ করতে না পারেন এবং ক্ষমতার অহংবোধে ভোগেন তিনি কিছুতেই রাজনীতিক হতে পারেন না। তাই আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মনগড়া হালনাগাদ গৃহকর এসেসমেন্ট অযৌক্তিক এবং নিবর্তনমুলক। নগরীর জলাবদ্ধতা, সড়ক যোগাযোগের বেহাল অবস্থা নিরসন ও প্রায় অর্থেক ওয়ার্ডে নাগরিক সুবিধা সেবার মান নিশ্চিত না করে ঢালাও ভাবে কয়েকগুর বেশি গৃহকর ধার্য করা নগরবাসী গলাকাটার সামিল। এর বিরুপ প্রভাবে আজ নগরবাসী সংক্ষুব্ধ।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সহ বিভিন সেবাদানকারী সংস্থার সমস্যা, ভুল-ভ্রান্তি, অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়গুলো তুলে ধরে অবিলম্বে সমাধানের দাবী জানিয়েছি। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো আমার এ আর্জি আকাঙ্কাকে তারা বাঁকা চোখে দেখেছেন। আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়েই সরকার অনুসৃত কর্মকান্ডে নিজেদের ভুল ভ্রান্তি শুধরে নিতে না পারলে সকল ব্যর্থতার জন্য দল ও বর্তমান জনকল্যানমুখী সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই কোন সমালোচনাকে বাঁকা চোখে দেখা সমীচীন নয়। ভুল ভ্রান্তি শুধরে সরকারী উন্নয়ন উদ্যোগ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দল ও সরকারের প্রতি জনগনের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে যে কর্তৃপক্ষকেই দায়িত্ব দেন না কেন তা যেন অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় সে জন্য আওয়ামী ঘরানার রাজনীতিক হিসেবে আমাদের সমান দায়িত্ব রয়েছে। আমি কখনো চাইনি সরকার ও জনগনের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হোকা। নিজেদের সৃষ্ট দুর্বলতা ও অযোগ্যতার সযোগ কাজে লাগিয়ে বিরোধী দল যেন ইস্যু তৈরী করে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
সরকারি সেবা সংস্থার প্রধান ও কর্মকর্তারা দলে যত বড় নেতা বা সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা হোন না কেন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কাজ কর্মের বিচার বিশ্লেষন ও সমালোচনার সংস্কৃতি চর্চা গড়ে তুলতে হবে। মহিউদ্দিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা প্রতিষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিশন ভিশন বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম নগরবাসীর জন্য সরকারী যেবাদানকারী সংস্থা ও প্রতিষ্টানগুলোর প্রধান ও কর্নধারদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, সরকার অনুসৃত নীতিমালা ও উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মুলোৎপাটন করতে হবে। তিনি বলেন, এ সকল সংস্থাগুলোর মধ্যে একশ্রেনীর অসৎ কর্মকর্তা কর্মচারী দুর্নীতি অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ায় নগরবাসী নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে কমকরে ৪টি ড্রেজার দিয়ে কর্নফুলী নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং পরিচালিত হলে এ সমস্যার আশু সমাধান হতো। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লোক দেখানো ড্রেজিং করলেও এর সুফল তো আসেইনি বরং তা কুফল বয়ে এনেছে। কোটি কোটি টাকার অর্থের অপচয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অতুলনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ন্যাশনাল গ্রিড়ে সিংহভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। অথচ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বানিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে ভয়াবহ লোড শেডিং জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ভৌতিক বিদ্যুৎ বিল দিয়ে গ্রাহকদের হয়রানী করা হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে কর্নফুলী গ্যাস চরমভাবে ব্যর্থ। গ্যাসের স্বাভাবিক চাপ না থাকায় গৃহস্থালী রান্নাবানা ও কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
তিনি বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি উড়াল সেতু বাস্তবায়িত করার ফলে কিছু সফল এলেও বহদ্দারহাট থেকে লালখান বাজার, বহদ্দারহাট থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বেহাল হয়ে পড়েছে। উড়াল সেতুর নিচে দুপাশে রাস্তাগুলোর সংরক্ষন ও উন্নয়নের জন্য একই পকল্পে আলাদা বরাদ্দ থাকলেও এই সড়কগুলো চলাচলের ক্ষেত্রে অনুপযোগী এবং এ কারনে দৃশ্যমান জনদুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা রয়েছে। তারা জঙ্গিবাদ ও নাশকতা নির্মুলে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে পুলিশ বাহিনীর কিছু দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তা মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসায় ইন্ধন যোগাচ্ছে। তারা নানাভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। এদের বিরুদ্ধে উর্দ্ধতন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে সচেতন থাকতে হবে।