চট্টগ্রামে এমপি মন্ত্রীদের ঘিরে রেখেছে চামচা ও চাটুকাররা !

0

জুবায়ের সিদ্দিকী :    চট্টগ্রামে এমপি মন্ত্রীদের ঘিরে রেখেছে চামচা ও চাটুকাররা। এতে করে তৃনমুলের নেতাকর্মীদের পক্ষে এমপি মন্ত্রীদের নাগাল পাওয়া দুস্কর হয়ে উঠেছে। এমনিতেই সকল সংসদ ও মন্ত্রীগন বেশিরভাগ সময় অবস্থান করেন ঢাকায়। মফস্বলের সাংসদরা থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। শুধুমাত্র এলাকায় কোন কর্মসুচী হলে যাওয়া হয়। না হয় থাকেন ঢাকায়। নির্যাতিত, নিপড়িত, ফরিয়াদী কারো পক্ষে ঘেষা সম্ভব হয়না এসব বড়লোকদের কাছে।

এমপি মন্ত্রীরা দুরত্ব বজায় রাখায় ত্যাগী নেতাকর্মীগন হতাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেও মুখে কিছু মন্তব্য করছেন না। চামচা চাটুকারদের রাজত্ব চলছে আওয়ামী লীগে। হামবাড়া ভাব এসেছে নগরের শীর্ষ নেতাদের কাছে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর মুজিব কোর্ট সেলাই করার ধুম পড়েছিল। ৫ বছর অতিক্রম করেগত ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের পর দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এমপি মন্ত্রীদের তালিকা পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি তাদের আন্তরিকতার। অনেক শীর্ষ নেতা এখন তৃনমুলের অনেক নেতাকর্মীকে চেনেন না এখন। দেখলেই জিজ্ঞেস করেন ’ওবা তোয়াঁর বাড়ি ক’ডে। কিয়াল্লাই আইস্যদে।
চট্টগ্রামে মফস্বলের অনেক থানায় এমপিদের চামচা থেকে শুরু করে চাটুকারদের কথায় চলতে হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনকে। পুলিশ কর্মকর্তাদের উর্দ্ধতন কর্মকর্তার চেয়ে চামচাদের বেশি সমিহ করতে হয়। এভাবে চলছে মফস্বল ও নগরীর থানাচিত্র।
আমার নিজের সন্তানের ভার্সিটিতে ভর্তিযুদ্ধে অপেক্ষমান তালিকায় নাম থাকলে এক সাবেক মন্ত্রীর সুপারিশের জন্য সহকর্মীদের অনুরোধে ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গিয়েছিলাম। রাত ১২টার পর দেখা হল মন্ত্রী সাহেবের সাথে। এই মন্ত্রী এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে তাঁর বাসায় সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। দেখা হয়েছে কথাও হয়েছে। মনে করেছিলাম তিনি আমাকে দেখলেই চিনবেন। না, তিনি চেনেননি! পরিচয় পওয়ার পর হাতের কাগজটি নিয়ে এপিএসকে দিলেন। দুই দিন পর ঢাকায় মন্ত্রনালয়ে দেখা করতে গেলাম।

সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর মন্ত্রী মহোদয়ের দেখা মিললো। না, তিনি এবারও আমাকে চেনেননি। আবার পরিচয় দিলাম! এপিএসকে আমার সামনে বললেন ডিও লেটার দিয়ে পাঠাতে। ৫ মিনিট কথা বলে চলে এলাম চট্টগ্রাম। ২দিন পর এপিএসকে ফোন করলে তিনি বললেন, ’ডিও লেটারে দস্তখত করেননি। পরে খবর নেন।’ এক সপ্তাহ পর এপিএসকে ফোন করলে তিনি জানান,’ ভাই ডিও লেটার দস্তখত হয়নি। হবে বলে মনে হয় না। আশা ছেড়ে দিন।

অবশেষে সন্তানকে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালাম। কোন মন্ত্রী এমপির কাছে কোন তদবিরে যাওয়ার অভ্যাস নেই। মালিশ বা তদবিরের সাংবাদিকতা আমি করি না। আমার সহকর্মীগন উৎসাহ দেওয়াতে সে সময় যেতে হয়েছিল। আমার জানা ছিল, আওয়ামী লীগ নেতারা অকৃতজ্ঞ। তাদের চরিত্র বদল হতে সময় লাগে না। লাইসেন্স বা কোন সুবিধা আদায়ের খায়েশ আমার নেই। সেই মন্ত্রী এবারে এবার অটোপাশ এমপি হলেও বাদ পড়েছে মন্ত্রী পরিষদ থেকে । আল্লাহ তাকে হেদায়েত করুক। আমার কাজ হয়নি তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু দু:খ লেগেছে, এতবার দেখা হবার পর, কথা হবার পরও তিনি চেনেন না কিভাবে।

এ রকম ব্যবহার করছে এরা তৃনমুলের নেতাকর্মীদের সাথেও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে লালন করে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কাগজে একটানা দীর্ঘদিন কাজ করছি। তাতে কি! বাড়তি কোন সুবিধা আদায়ের খায়েশ আমার নেই। তবে নেতা ও পাতিনেতাদের স্বভাব চরিত্র অন্যদের ব্যথিত করে। ক্ষমতা ও অর্থ মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় তা কল্পনা করলে শিহরিত হতে হয়। অনেক এমপি ও নেতা মনে করেন ক্ষমতায় আছেন এবং যুগ যুগ ধরে থাকবেন। ক্ষমতা থেকে যে একদিন বিদায় নিতে হবে তারা বিষয়টি বেমালুম ভুলে যান। এক মনিষি বলেছিলেন,’ ক্ষমতা ও কারাগার খুব কাছাকাছি।

বিএনপি-জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামের এক শীর্ষ বিএনপি নেতার অফিসে গিয়েছিলাম। বললেন,’গেদুচাচা তো আমাদের বিরুদ্ধে লেখেন। আপনিও কি এ জন্য এসেছেন। এমন সময় এক কর্মী এসে নেতাকে বললেন, আমাদের এক কর্মীকে পিটিয়েছে আগ্রাবাদের ছাত্রলীগ কর্মীরা। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে নেতা বললেন, ’ক’ ডিয়ার পোয়া এগুন,থানারে কই বান্দিতো। এর কয়দিন পর সার্কিট হাউজে বিএনপি সরকারের এক মন্ত্রীর সাক্ষাতকার নিতে হলো। সাক্ষাতকার দিয়ে বললেন, ’আপনাকে ধন্যবাদ। এন্টি গভমেন্ট পত্রিকা হয়েও আমার সাক্ষাতকার নিতে এসেছেন। গেদুচাচাকেও ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানালেন পত্রিকার প্রতি। সাক্ষাতকার ছাপা হবার পরও ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা, এমপি, মন্ত্রীর সাক্ষাতকার গ্রহন করলে ধন্যবাদ তো দুরের কথা, এরপর গেলে চেনেন না। এই হলো ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় থাকলে স্বভাব। তবে বিপরীত চিত্র দেখা যায়, ক্ষমতায় না থাকলে। তখন পত্রিকাই যেন সব ভরসা। সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ, আপ্যায়ন, আদরযত্ন কয়েকগুন বেড়ে যায়। আসলেই আওয়ামী লীগের চরিত্র দুই রকম। ক্ষমতায় গেলে এক আচরন, ক্ষমতায় না থাকলে আরেক। তবে ব্যতিক্ষমও আছে। মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একশ জন মানুষের ভিড়ে দেখলেও নাম ধরে ডাক দিতে পারতেন। মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো দক্ষ রাজনীতিকদের অভাব বর্তমানে প্রবল। এই চরিত্র রয়েছে কিছু কিছু পুলিশের মধ্যেও। চট্টগ্রাম বন্দর থানার ওসি ছিলেন দেলোয়ার। তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় হাটহাজারীতে থাকাকালীন মারা যান। নিজের বডিগার্ড ও সেন্ট্রিকে সকাল বিকাল তিনি জিজ্ঞেস করতেন ’তুমি কে? আমার সাথে একদিন সকালে দেখা হলে দুজনে একঘন্টা দুজনে গল্পগুজব করেছি।

সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখে জিজ্ঞেস বললেন,’আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। আমি উল্টো বললাম, ’আপনাকেও তো চেনা মনে হচ্ছে না। যেমন কুকুর তেমন মুকুর। ’আরে ভাই আমাকে চেনেন না, আমি ওসি বন্দর! এভাবে একদিন ’হামবাড়া এমপিদের বলতে হতে পারে,’ আরে ভাই আমাকে চেনেন না, আমি অমুক এলাকার এমপি ছিলাম। সেদিন খুব বেশিদুর নয়। এক ওয়ান ইলেভেন অনেক বড় নেতাকে পথে বসিয়েছে, তেমনি পথ থেকে অনেকে এসে হালের বড় নেতা। দুই পয়সার কেরানী টাইপিষ্টরাও হয়ে গেছে ভাগ্যক্রমে এমপি-মন্ত্রী! এরা মানুষকে দেখলে চিনবেন কিভাবে। চামচা চাটুকারদের রাজত্ব নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম।

আওয়ামী লীগের মধ্যে হঠাৎ করে হাইব্রিড নেতাদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে চাটুকারদের সংখ্যা। এই চাটুকার ও চামচাদের কারনে এমপি-মন্ত্রী, দল ও সরকারের যে বারোটা বাজতে শুরু করেছে তা কখন বুঝতে পারবেন হাইকমান্ড? অনেক জনপ্রতিনিধি মোবাইলে ধমকান নিজের দলের নেতাকর্মীদের। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন ত্যাগী নেতাদের। ক্ষমতা ও অবৈধ টাকায় এসেছে পরিবর্তন। সেদিন এক আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করি যখন মুজিব কোর্ট গা না চাপালে কিভাবে হয়। তাই একসাথে ৪টি সেলাই করতে গিয়েছি। এরা হচ্ছে হাইব্রিড নেতা। এই হাইব্রিড নেতাদের রিতিমতো উৎসব চলছে। এসব হাইব্রিড নেতাদের দ্বারা এখন পরিবেষ্টিত হয়েছেনে জনপ্রতিনিধিরা। ত্যাগী, কর্মঠ, পরিশ্রমি, সৎ ও নিষ্টাবান নেতারা এখন নির্বিকার হয়ে পড়েছেন। হতাশ এসব নেতাকর্মীগন।

চট্টগ্রামে ক্ষমতাসীন দলে বর্তমানে হাইব্রীড় নেতাদের যে হারে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে তাতে ত্যাগী নেতাদের কোনঠাসা না হয়ে উপায় নেই। বিএনপি জামায়াত সরকারের আমলে এভাবে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ত্যাগী নেতাদের তাচ্ছিল্য ও চেনাকে অচেনার ভান করে অহংকার করে গায়ে চর্বি জমিয়েছিলেন তারা এখন জনবিচ্ছিন্ন। কেউ কারাগারে, ফেরারী বা পলাতক জীবনযাপন করছেন। বাস্তবতা বড় নির্মম। যেমন কর্ম তেমন ফল তারা পাবেনই। ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ড ও শীর্ষ নেতারা এসব এমপি-মন্ত্রীকে যদি হাইব্রীড় নেতাদের পরিত্যাগ না করান তবে রাজনীতির জন্য হবে অশনিসংকেত।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.