২৩ ভাগ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়

0

ঢাকা : ২৭ বছর বয়সী নসিমন বেগম। বয়সের সঙ্গে বাস্তব চেহারার কোনো মিল নেই। দেখে মনে হয় যেন চল্লিশোর্ধ্ব নারী। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায়। বয়স যখন ১৫ তখন তার বিয়ে হয়। মাত্র ১৩ বছরের ব্যবধানে চার সন্তানের জননী হন নসিমন। তার একটি সন্তান স্কুলে যায়। সন্তানদের স্বাস্থ্যের অবস্থাও ভালো নয়। যেন অপুষ্ট মায়ের অপুষ্ট সন্তান।

তুলির বয়স ১৪। তাকে দেখলে মনে হয় বয়স দশ বছরের কম হবে। লিকলিকে শরীর। উচ্চতা চার ফুটের কাছাকাছি। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। স্থানীয় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। স্কুল থেকে ফিরে গৃহস্থালি কাজে মাকে সাহায্য করে। ছোট দুই ভাইবোনের দেখাশোনাও তাকেই করতে হয়।

সন্ধ্যার পর যখন সে পড়তে বসে তখন খালি ঘুম পায়। শরীরে শক্তি পায় না। তুলির মায়ের স্বাস্থ্যও ভালো নয়। প্রায়ই জ্বর আসে, মাথাব্যথা করে বলেও জানায় তুলির মা রাহেলা বেগম।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে, নসিমন, রাহেলা বেগম ও তুলির মতো অনেক নারী ও শিশু রয়েছে, যারা অপুষ্টির শিকার।

সরেজমিন ভুক্তভোগী এই মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, হাওর এলাকায় বছরের প্রায় ছয় মাস পানিবন্দি অবস্থায় থাকে। এ সময় মানুষের কাজ থাকে না। খাদ্য নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। ঠিকমতো তিন বেলা খাবারও জোটে না তাদের। অপুষ্ট শিশু দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে বড় হয়। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে বাড়ন্ত সময়ে তার পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয় না। অপুষ্ট মেয়ে শিশু বড় হয়ে অপুষ্ট নারীতে পরিণত হয়। অপুষ্ট নারী আবার অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়। এভাবে অপুষ্টি এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তার লাভ করে। অপুষ্ট শিশুর মৃত্যুর হারও বেশি।

জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০২৫) চূড়ান্ত খসড়ায় দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর জরিপে দেখা যায়, দেশে ২৩ শতাংশ শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে। ১৮ শতাংশ গর্ভবতী মা অপুষ্টির শিকার। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলে মা-সহ অন্য শিশু পরিচর্যাকারীদের ৭৩ শতাংশ স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলে না। জরিপে আরো বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অনেক শিশুর উচ্চমাত্রায় অপুষ্টি রয়েছে। এদের মধ্যে বয়সের তুলনায় ৩৬ শতাংশের উচ্চতা কম, ১৪ শতাংশ কৃশকায় এবং ৩২ শতাংশের ওজন কম। তবে গত তিন দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির অনেক অগ্রগতি হয়েছে।

ইউনিসেফ-এর হিসেব মতে, প্রতি বছর এক লাখের বেশি নবজাতকের মৃত্যু হয়। অথচ গর্ভবতী মাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য দিলে এই মৃত্যুর হার বহুগুণ কমানো সম্ভব। গর্ভাবস্থায় মায়ের যেমন প্রয়োজনীয় পুষ্টি দরকার তেমনি প্রসবের পর স্তন্যদানকারী মায়েরও যথাযথ পুষ্টি প্রয়োজন। মাতৃদুগ্ধ শিশুর প্রথম ও ছয় মাস বয়স পর্যন্ত একমাত্র খাদ্য। দুই বছর বয়স পর্যন্ত যে শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করে সে শিশু ভবিষ্যতে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। শিশুকে স্তন্যদানকারী মায়ের পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন খুব বেশি। কারণ শিশু তো মায়ের মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে। শুধু যে দারিদ্র্যের কারণে মা ও শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে তা নয়। এ জন্য অসচেতনতা ও অজ্ঞতাও অনেকভাবে দায়ী।

জন্মের পর অনেক সময় মেয়ে শিশু অবহেলার শিকার হয়। বয়ঃসন্ধিকাল একজন মেয়ে শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় পুষ্টিকর খাদ্য না পেলে সে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠবে। সুস্থ মা ছাড়া সুস্থ শিশু আশা করা যায় না। তাছাড়া অনেক সময় খাবারের ভাগে মেয়ে শিশু পারিবারিক বৈষম্যের শিকার হয়। মেয়ে বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে যাবে আর ছেলে শিশু বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরবে তাই ভালো খাবার ও যত্ন ছেলে শিশুকে দিতে হবে এমন ভ্রান্ত ধারণা এখনো গ্রামগঞ্জের অনেক পরিবারের মধ্যে বিদ্যমান। আসলে স্তন্যদানকারী মায়ের পুষ্টিকর খাদ্যের ওপর শিশুর স্বাস্থ্য নির্ভর করে।

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় ‘পুষ্টিবিধানের শাসন-প্রক্রিয়া’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলা হয়েছে, দেশে অপুষ্টির শিকার শিশুর সংখ্যা ৫৫ লাখ এবং তারা সব ধরনের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত। এমনকি বর্তমানে দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই জিঙ্ক স্বল্পতায় ভুগছে। এ তথ্য যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও অনস্বীকার্য যে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতার পরিচয় দিয়েছে।

বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ২৩ শতাংশের নিচে। এ কারণে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং সার্বিকভাবে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বকায় শিশুর হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী এর আগে ১৯৯৬-৯৭ সালে দেশে খর্বকায় শিশু ছিল ৬০ শতাংশ। আর ২০১১ সালে ছিল ৪১ শতাংশ। খাদ্য ও পুষ্টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই এ উন্নতি।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী খর্বকায় শিশুর হার ৩৬ শতাংশ হলেও দরিদ্র পরিবারগুলির মধ্যে এই হার ৪৯ শতাংশ। তাই এইক্ষেত্রে উন্নতির জন্য আমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি-২০১২ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে দেখা যায়, বয়স অনুপাতে কম ওজন জনিত অপুষ্টি সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.