কক্সবাজারে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে তিন লাখ মানুষ

0

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার : বর্ষা মৌসুম এলেই কক্সবাজারবাসির মনে আতংক ভর করে। তবুও ঝুঁকি নিতে হয়। মৃত্যু ঝুঁকি। ফি বছর এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা চোখের সামনে ঘটলেও যাওয়ার যে আর কোনো পথ নেই। তাই তো মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে আতংকিত বসবাস। তবুও কক্সবাজারে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে রোহিঙ্গাসহ অন্তত ৫০ হাজার বসতিতে তিন লাখ মানুষ।

তারা অবৈধভাবে জায়গা দখল, ঝুঁপড়ি ঘর নির্মান, বস্তি ও প্লট আকারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে ওরা সেখানে বসতি গেড়ে রেখেছে। সরকারি খাস জমি, বনভুমি জমি দখল করে যেমন এসব অবৈধ বস্তি, বসতি গড়ে তোলা হয়েছে, তেমনি ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় কেন্দ্র করেও গড়ে উঠেছে অনেক বসতি। এসব বসতিকে কেন্দ্র করে চলে মাফিয়া চক্রের রমরমা কারবার।

বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগও আছে এখানে। মাদক ব্যবসাসহ অসামাজিক কার্যকলাপও চলে। তারপরও মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয় এতটুকু আশ্রয়ের জন্য। পাহাড়ে বিপদ আসে বারবার।
তবে শুধু কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে গড়ে ওঠা ৩০ হাজার বসতিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদফতর। এসব বসতি গত মার্চ মাসে এক সপ্তাহের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগও নিয়েছিল। তবে ভূমিদস্যুদের ইন্ধনে গত এপ্রিল মাসে বহু নারী জেলা প্রশাসন চত্বরে এসে উচ্ছেদ অভিযান না করার দাবিতে মানববন্ধন করে। এতে আপাতত ভেস্তে যায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ অভিযান।

কক্সবাজার বন বিভাগের সূত্র জানায়, জেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ৭৩ হাজার ৩৫৮ হেক্টর। এরমধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর বনভূমি। এর মধ্যে পাহাড়ি জমিতেই বসবাস করছে ১৩ হাজার ৮২৬টি পরিবারের তিন লাখ মানুষ। তবে বেসরকারী হিসেব অনুযায়ী শুধু কক্সবাজার শহরেই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে ৩০ হাজার। কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা ২৩ লাখ হলেও অন্তত তিন লাখ মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাহাড় ধসে গত ১০ বছরে ৬ সেনা সদস্যসহ ৩ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে পাহাড় ধসে মারা যায় ১৭ জন মারা যায়। গত ২০১৫ সালে কক্সবাজার শহরের রাডারের পাহাড় ধসে মা-মেয়ে সহ ৫ জন , ২০১১-২০১৩ সালে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। ২০১২ সালে ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় ২৯ জনের প্রাণহানি হয়। ২০১০ সালের ১৫ জুন রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকার ১৭ ইসিবি সেনা ক্যাম্পের ৬ জন সেনা সদস্যসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে নিহত হন অন্তত ৬২ জন। ২০০৯ সালে চকরিয়া, উখিয়া ও রামুতে ৫ জন এবং ২০০৮ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফে ফকিরা মুরা ও টুইন্যার পাহাড় ধসের একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জন প্রাণ হারান। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন ও পাহাড় কাটার কারণে প্রাণহানির তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলেও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না।

কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকায় নানা কৌশলে চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড় কেটে এসব এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। কক্সবাজার শহরের ঘোনার পাড়া, মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, বইল্যাপাড়া, জাদি পাহাড়, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, ইসলামপুর, হালিমা পাড়া, লাইট হাউজ পাড়া, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এলাকা, আবু উকিলের ঘোনা, রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকা, পাহাড়তলী, বাঁচা মিয়ারঘোনা, হাশেমিয়া মাদ্রাসার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিডিআর ক্যাম্পের পেছনে, লারপাড়া, সদর উপজেলা কার্যালয়ের পেছনে, পাওয়ার হাউস, লিংকরোড, কলাতলী বাইপাস সড়কের দুই পাশের বিশাল পাহাড়ি এলাকা, হিমছড়িসহ জেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে।

এছাড়া কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, সদর উপজেলা, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ বসতি। এসব বসতিকে কেন্দ্র করে চলে মাফিয়া চক্রের রমরমা কারবার। বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগও আছে এখানে। মাদক ব্যবসাসহ অসামাজিক কার্যকলাপও চলে। তারপরও মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয় এতটুকু আশ্রয়ের জন্য। এসব বসতিরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ আলী কবির বলেন, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করা প্রায় ৩ লাখ মানুষ রয়েছে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে। একারণে জেলা প্রশসকের সাথে আলাপ করে পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একই সাথে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে নানা কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযানও চলছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সরদার সরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড় কাটা রোধে অভিযান ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চলমান রয়েছে। খবর পাওয়া মাত্রই

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অভিযান চালানো হচ্ছে। ভুমিদস্যুদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা হচ্ছে। তবে, জনবল সংকটের কারণে অভিযান একটু ব্যাহত হচ্ছে বলেও দাবী করেন এই কর্মকর্তা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন পাহাড়ে অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া কথা জানিয়ে বলেন, জেলা প্রশাসন, বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটার বিষয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন মাইকিং অব্যাহত আছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.