রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী বানানোর নিষ্ঠুরতাই মিয়ানমার

0

বঙ্গোপসাগর, মিয়ানমার উপকূল, আন্দামান, মালেক্কা প্রণালীসহ সমুদ্রের বিভিন্ন জলসীমায় ভাসমান সবাইকে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশী বলে চালিয়ে দেয়ার অপকৌশল নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শুক্রবার সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২০৮ জন অবৈধ অভিবাসীকে বাংলাদেশী বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু বাঙালিদের সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিচয় থাকার পরও মিয়ানমার তাদের দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নানা অপকৌশলে বাঙালি আখ্যায় মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের রাষ্ট্রীয় ইন্ধন অব্যাহত রেখেছে। অথচ হাজার বছরের বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস বলে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের নৃত্বাত্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের বৈধ নাগরিক।

বিভিন্ন সূত্র মতে, সাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাসমান অভিবাসীদের ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত সন্ত্রাসের শিকার ভাগ্য বিড়ন্বিত ও মানবতা বিবর্জিত সে দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নাগরিক। বিশেষ করে ২০১২ সালের জুনে রাষ্ট্রীয় মদদে সংঘটিত এক তরফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে ভস্মীভূত সহায় সম্বলহীন মানুষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যাদের উপর চলা অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম, অমানবিকতার ধারাবাহিকতায় মাতৃভূমি ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটা জীর্ণশীর্ণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভাসমান কাফেলা। ২০১২ সালের সহিংসতায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রাণদান, দুই লক্ষাধিক সংখ্যালঘু বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। আর এ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র না বলে ময়লা আবর্জনা, মানবতা বিবর্জিত উন্মুক্ত ‘গারদখানা’ বলছে বিশ্ব মিডিয়া।

২০১২ সালে খোলা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে সে সময়ে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা আর বর্তমান সময়ের সংখ্যা গণনা করলে বাস্তবতা ফুটে উঠবে বলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দাবি। রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি সহায় সম্বল সর্বস্ব হারিয়ে অভ্যন্তরীণ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও সেখানে খাদ্য আবাসন, স্যানিটেশন, পানীয় জল, প্রয়োজনীয় ওষুধ, পুষ্টির অভাবে একটু নিরাপদে বাঁচার তাগিদে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীশিশু, পুরুষ সমূদ্র পথে অনিশ্চিত চরম ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। ওদের গন্তব্য কিন্তু বাংলাদেশ কিংবা থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া। এসব ঝুঁকিপূর্ণ সমূদ্র যাত্রার প্রারাম্ভে নৌকায় উঠার পূর্বে মিয়ানমার পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, কোস্টগার্ড, ইমিগ্রেশন ও নৌবাহিনীর হাতে মাথা পিছু তাদের চাহিদা মত অর্থ দিতে হয়েছে বলে রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের ইতিকথা : ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে ও ৭ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে আরব বণিকদের মাধ্যমে আরাকানের ইসলাম প্রচার শুরু হয়। যা দীর্ঘকাল স্থায়িত্ব্‌ ছিল। এর পর বেশ কিছুকাল ধরে অর্থাৎ ৯৫০ সাল পর্যন্ত হিন্দুরা আরাকান শাসন করত। ৯৫০ সালের পর ক্ষমতার পালা বদলে মোঘলরা আরাকান কব্জা করলেও ১৪৩০ সালে বাংলার সুলতান নাছির উদ্দিন শাহের সাহায্যে সুলাইমান শাহের মাধ্যমে আরাকানে মুসলিম শাসনের গোড়া পত্তন হয়। সুলাইমান শাহ তখন আরাকানের রাজধানী ম্রোহাং বা পাথরী কিল্লায় স্থানান্তর করেন। সে সময় আরাকানের মুদ্রায় আরবী ও ফার্সি ভাষা মুদ্রিত ছিল। আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিমদের অন্তর্কলহ ও দণ্ডের কারণে ১৭৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বর্মী রাজ বোধাপায়া এর নিকট রোহিঙ্গাদের ক্ষমতা হারাতে হয়।

১৮৪৫ সালে বৃটিশরা অন্যান্য দেশের মত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করে বার্মা দখল করলে আরাকান ও বৃটিশ উপনিবেশিকের করতলগত হয়। বৃটিশ কলোনীর অধীন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালীন শাসনতান্ত্রিক জটিলতার সুযোগে “মগ বুদ্ধরা” ১৯৪২ সালে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এসময় উত্তর আরাকানে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম খুন ও প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছাড়া হয়। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত “পেন লং” কনফারেন্সে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিরত রাখা হয়। আরাকানে স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে জেনারেল অং সান বৃটিশ বিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করলেও ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভের পর রোহিঙ্গাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকানের স্বায়ত্তশাসন দেয়নি। সে জেনারেল অং সান বার্মা স্বাধীনের পরপরই বার্মা টিউটোরিয়েল ফোর্স বা বিটিএফ গঠন করে ৯০ শতাংশ সামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে দেশ শাসন করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমননীতি অভিযান চালান। রোহিঙ্গা বিরোধী দমন নিপীড়ন অভিযানের পূর্ণতা দেয় ১৯৬২ সালে অপর জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখলের পর।

এরই ধারাবাহিকতায় বর্মী জেনারেল শাসকগণ ১৯৯০৯১ সাল পর্যন্ত ১৭ বার বিভিন্ন নামে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান চালায়। ইতিপূর্বে ১৯৮২ সালে বার্মা সামরিক জান্তার জারিকৃত নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত করে। এ আইনের মাধ্যমে বার্মা মূলত ৩ ক্যাটাগরির নাগরিকত্ব ঘোষণা করে। তৎমধ্যে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বা তাইরেন্স, সাধারণ নাগরিক বা নাইংচা ও অতিথি নাগরিক বা নাইং ক্রাচা নামে এ ৩ শ্রেণীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বর্তমানে যে পরিচয় পত্র রয়েছে তাতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঙালি ‘লুমিউ’ বা ‘বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত’ হিসেবে লেখা আছে। মিয়ানমারের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হতে হলে তাতে অবশ্যই বুদ্ধ ধর্মাবলম্বী হতে হবে এবং ১৮২৩ সালের পুর্বে তাদের পূর্ব পুরুষ যে কোনভাবে মিয়ানমারে এসেছিল তা দালিলিক প্রমাণ করতে হয়। অথচ মিয়ানমারের বর্তমান রাখাইন প্রদেশ বা আরাকান প্রদেশে আরব বণিক মুসলিমদের পদচারণা ও ইসলাম প্রচারণা শুরু হয়েছিল ষষ্ট ও সপ্তম শতাব্দীতে। ৯৫০ সালের পর থেকে বেশ কয়েক শতব্দী পর্যন্ত মোঘলরা এবং মুসলিমরা আরাকান শাসন করে। সে সময় মুসলিমদের আলাদা মুদ্রা ও স্বতন্ত্র রাজধানীও ছিল। বৃটিশ কলোনির শাসনাধীন নানা ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ১৯৪২ সালে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চরম নির্যাতন চালায় মগ বুদ্ধরা। যাকে স্থানীয় ভাষায় কচু কাটার মত রোহিঙ্গা নিধন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। বর্তমান মিয়ানমারের বিরোধী দলীয় নেত্রীর পিতা জেনারেল অং সান রোহিঙ্গাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বৃটিশ বিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করার পরও অঙ্গীকারকৃত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়নি। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে বার্মার রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে জেনারেলদের হাতে কুক্ষিগত থাকায় একের পর এক রোহিঙ্গা নিধন অভিযান পরিচালনা করা হয়। যা সর্বশেষ ২০১২ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ দাঙ্গায় ২০০ জনের মত রোহিঙ্গা খুন এবং প্রায় ২ লাখের মত রোহিঙ্গা সর্বশান্ত হয়ে অমানবিকভাবে স্থানীয় আশ্রয় কেন্দ্রে বিভীষিকাময় দিন কাটাচ্ছে। কার্যতঃ ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূল থেকে সমূদ্র পথে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু, পুরুষ মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে অভিবাসী হতে থাকে। রোহিঙ্গাদের পাশপাশি মানব পাচারকারীর দালাল চক্র বাংলাদেশী কিশোর যুবকদের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে অভিবাসী হতে বাধ্য করে।

কক্সবাজারভিত্তিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মানবপাচার সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে তোলপাড় চলছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। যুগযুগ ধরে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, বাংলাদেশে অবস্থানরত অবৈধ রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে এবং বৈধভাবে অবস্থানরতদের প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সে সময় থেকে যদি আমাদের দাবিগুলো গুরুত্ব সহকারে উচ্চ পর্যায়ে বিবেচনা করা হত আজকে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হত না। মানব পাচার, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় জিম্মি শিবির, সাগরে লাশের ছড়াছড়ি ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের পিছনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া সদস্য, পাচারকারী গডফাদারেরা জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি মানবপাচারের মত জঘন্য অপরাধের সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.