পটুয়াখালীর স্টেডিয়াম

0

স্টাফ রিপোর্টারঃ-   একটা সময় ভরানী খাল দিয়ে এসে গ্রামের পর গ্রাম লুট করত পর্তুগিজ জলদস্যুরা। তখন এর নাম ছিল হতপতুয়ার খাল। এই পতুয়ার খাল থেকেই নামকরণ পটুয়াখালীর। এখন আর জলদস্যুর অত্যাচার নেই। তবে প্রভাব খাটিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে ঢুকে পড়েছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। পটুয়াখালীতে খেলার পিছিয়ে যাওয়ার বড় কারণ এটাই। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব আর সংগঠকদের নিষ্ক্রিয়তাতেও প্রায় সব খেলার লিগ অনিয়মিত। আশির দশকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক থাকা ফজলে আলী খান এ জন্য দায়ী করলেন ক্রীড়াঙ্গনের দলীয়করণকে, ‘যে সরকার যখন আসে, তাদের লোকজন খামোখা দায়িত্বে আসেন ক্রীড়াঙ্গনের। খেলার বাইরের লোক হওয়ায় তাঁদের দিয়ে বছরব্যাপী খেলা আয়োজন সম্ভব নয়। সেটাই হয়েছে পটুয়াখালীতে। এ জন্য পিছিয়ে পড়েছি আমরা।’

সাগরকন্যা পটুয়াখালী বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে মহাসেন, আইলা, সিডরের মতো প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে। ঘুরেও দাঁড়িয়েছে। তবে সিডরে লণ্ডভণ্ড হওয়ার পর সংস্কার হচ্ছিল না জেলা স্টেডিয়ামের। গণপূর্ত বিভাগ উল্টো পরিত্যক্ত ঘোষণা করে এটা। গ্যালারি ভাঙলেও মাঠে খেলা হচ্ছিল কোনো রকমে। তাতেও কমছিল না হতাশা। গ্যালারিতে দর্শক না এলে খেলা আর কাদের জন্য? অবশেষে সেই দুঃখগাথার সমাপ্তি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আর জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে সংস্কার হতে যাচ্ছে স্টেডিয়ামের। পাস হয়ে গেছে দুই কোটি ২৭ লাখ টাকার ওয়ার্ক অর্ডারও। এ জন্য সন্তুষ্টি ঝরল জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মামুনের কণ্ঠে, ‘ঢাকায় দুই সপ্তাহ পড়েছিলাম সংস্কার কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাসের জন্য। আড়াই কোটি টাকার ওয়ার্ক অর্ডার পাস হয়ে গেছে। আশা করছি, স্টেডিয়াম সংস্কারের পর গতি ফিরবে ক্রীড়াঙ্গনে।’

পটুয়াখালীতে ১৯৭৩ সালে স্টেডিয়াম আর জিমনেশিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিষ্ঠার পর সংস্কার হয়নি জিমনেশিয়ামের। তাই বেহাল দশা এটির। খেলোয়াড়রাও পাচ্ছে না অনুশীলনের সুযোগ। এই জিমনেশিয়ামের পাশেই চলে হ্যান্ডবল, ভলিবলের মতো খেলাগুলো। একটা সময় বাস্কেটবলে সুনাম ছিল পটুয়াখালীর। সেই জৌলুস আর নেই। গত ১০ বছর গড়ায়নি বাস্কেটবল লিগই। এই কোর্টটারও বেহাল দশা। তবে অল্প কয়েকটা ক্লাব নিয়ে হলেও ক্রিকেট আর ফুটবল লিগ গড়ায় মাঠে। ডিএফএ গঠনের পর দুই বছর হয়নি প্রথম বিভাগ লিগ। গতবার ডিএফএ না করলেও জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজন করেছিল একটি ফুটবল লিগের। দ্বিতীয় বিভাগ কাগজে-কলমে থাকলেও সেটা অনিয়মিত। বাফুফের নিটল টাটা লিগ বিভিন্ন জেলায় শেষ হয়েছে অনেক আগে। সেই লিগ পটুয়াখালীতে মাঠে গড়িয়েছে মে মাসের প্রথম দিন। ফুটবলটা হয় পিডিএস মাঠে। এই মাঠেই ষাট-সত্তরের দশকের ফুটবল লিগে থাকত উপচে পড়া দর্শক। রীতিমতো টিকিট কেটে আসতে হতো মাঠে। সেগুলো রূপকথার গল্প এখন। আটটি দল নিয়ে আয়োজিত লিগে মাঠে টানা যায় না দর্শক। ঢাকা থেকে কোনো ক্লাব খেলোয়াড় আনলে অবশ্য বদলে যায় ছবিটা। তবে ফাইনালের আগে ঢাকার খেলোয়াড় আনতে চান না কেউ।

জেলা শহরের আলাউদ্দিন পার্ক, শেরেবাংলা মাঠ, জুবিলী স্কুল মাঠ, কলেজ মাঠ, পিডিএস মাঠ কিংবা স্টেডিয়ামের মাঠে আশি বা নব্বইয়ের দশকে মুখর ছিল ফুটবল উন্মাদনায়। তখন খুলনা বিভাগের অধীনে থাকা পটুয়াখালী জেলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে একাধিকবার। স্বাধীনতার আগে ঢাকার ফুটবলে সুনামের সঙ্গে খেলেছেন আব্দুল হাই চান্দু। তাঁর সমমানের খেলোয়াড় ছিলেন একাধিক। লাভা রাখাইন, মুসা রাখাইন, শাহ আলমরা মাতিয়েছেন ঢাকার ফুটবল। অথচ এখন ঢাকার ফুটবলে খুঁজে পাওয়া যায় না পটুয়াখালীর কাউকে। লিগের আমেজ হারানোয় এই হাল। তবে প্রথমবারের মতো এ বছর জেলা প্রশাসক কাপ অনুষ্ঠিত হওয়ায় ফুটবলের পালে লেগেছে নতুন হাওয়া। জেলার সাতটি উপজেলা নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্টটির শিরোপা জিতেছিল পটুয়াখালী সদর। দর্শক উন্মাদনাও ছিল উল্লেখ করার মতো।

ক্রিকেটে স্পনসর না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও জমজমাট লিগ আয়োজনের উপায় নেই। তার পরও প্রথম বিভাগে আট আর দ্বিতীয় বিভাগের ১৬টি দল নিয়ে লিগ আয়োজনের চেষ্টা থাকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার। সর্বশেষ প্রথম বিভাগের শিরোপা জিতে ব্লু বার্ডস জুনিয়র। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দ্বিতীয় বিভাগে দল সংখ্যার বাধ্যবাধকতা থাকায় তৃতীয় বিভাগ আয়োজনেরও পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। এ নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মামুনের আশাবাদ, ‘অর্থ সংকট আছে সত্য, তার পরও খেলা তো থাকতে হবে। এ জন্যই তৃতীয় বিভাগের পরিকল্পনা। আশা করছি আমরা পারব সেটা।’

জুলুস না থাকলেও পটুয়াখালী থেকে সোহাগ গাজীর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা অপার বিস্ময়। তাঁর পথ ধরে অনূর্ধ্ব ১৯ দলে পৌঁছেছেন শাহীন গাজীও। তেমনি বিস্ময়ের বয়সভিত্তিক দলগুলোর সাফল্য। অনূর্ধ্ব ১৪-তে বর্তমান বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন পটুয়াখালী। গত বছর শিরোপা এসেছিল অনূর্ধ্ব ১৮ বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও। গত বছর অনূধ্ব ১৬ বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও পৌঁছেছিল তারা। সেই পটুয়াখালীতে ক্রিকেটের স্পনসর বলতে ২০১৩ সালের লিগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের ৭০ হাজার টাকা দেওয়া। ক্রিকেটের মতো খরুচে লিগ এত কম টাকায় করা অসম্ভব। আর পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়াতেই জৌলুস হারিয়েছে ক্রিকেট লিগ।

হকিতে এক সময় সুনাম ছিল পটুয়াখালীর। ১৯৮৮ সালে জাতীয় যুব হকির ফাইনালেও পৌঁছেছিল তারা। সেই পটুয়াখালীতে হকি লিগ হয়ে পড়েছে অনিয়মিত। জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় জাহিদ বিশ্বাস জানালেন, ‘২০০০ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলেছি। তখন থেকেই যদি ধরি তাহলে গত ১৫ বছরে মাত্র দুটি লিগ হয়েছে আমাদের জেলায়। সেটাও কয়েকটা নামমাত্র দল নিয়ে লোক দেখানো বলতে পারেন।’ অভিযোগের সত্যতা মিলল এ বছরের হকি লিগ দেখে। মাত্র চারটি দল নিয়ে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে মুন্সেফপাড়া বয়েজ ক্লাব। তবে খেলার মানের চেয়ে খেলার আয়োজন করতে পারায় সন্তুষ্টি ঝরেছে জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মামুনের কণ্ঠে, ‘কত দিন পর এই লিগ হলো মনে নেই কারো। খেলাটা যখন চালু করা গেছে তখন সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখতেই পারি।’

শহরের পিডিএস মাঠ আশির দশকের বেশির ভাগ সময় থাকত হকি খেলোয়াড়দের দখলে। এসডিও রোডের বাস্কেটবল কোর্ট আর পিডিএস মাঠ সংলগ্ন আরেকটি বাস্কেটবল কোর্ট মুখর থাকত খেলায়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত সেগুলো অতীতের স্মৃতি বহন করছে।

তবে সুনাম ধরে রেখেছে টেবিল টেনিস। এই জেলা থেকে জাতীয় দলের চৌকাঠে পা পড়েছে তিনজনের। জাতীয় দলে খেলে পটুয়াখালীর সুনাম বাড়িয়েছেন শারমিন সুলতানা, নুসরাত জাহান লোপা আর রহিমা আখতার। নিয়মিত লিগ না হলেও সাফল্য আছে ভলিবলে। এ বছর বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ভলিবলের শিরোপা জিতেছে পটুয়াখালী। বরিশাল জেলা দল গড়া হয় পটুয়াখালীর খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দিয়েই। ভলিবল কমিটির আহ্বায়ক হারুন অর রশিদ তৃপ্ত এতে, ‘বিভাগীয় দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় আমাদেরই। এটা গর্বের। তবে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেতে নিয়মিত লিগ করাটা জরুরি। খেলাটা মাঠে রাখার চেষ্টাই করছি আমরা।’

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.