চট্টগ্রামে কাঠগড়ায় আওয়ামীলীগ, খেসারত দিতে হবে নির্বাচনে

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃঃ  নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব, পাল্টাপাল্টি কমিটি এবং সাংগঠনিক স্থবিরতার চিত্র তুলে ধরে নগর আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ডের নেতারা জানান দিয়েছে, সংগঠনটির তৃনমূলের কি অবস্থা বিরাজ করছে। গত ৩ মার্চ শনিবার সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সংগঠনটির তৃনমূলের দুরাবস্থার চিত্র ভেসে উঠে।

নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর দামপাড়া রোড়ের বাসায় এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নেতাদের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজেরও আয়োজন করেন তিনি। এর আগে টানা ৪ ঘন্টার বৈঠকে মহানগর এবং থানা-ওয়ার্ডের ৩২ জন নেতা বক্তব্য রাখেন। সভায় বিভিন্ন সাংগঠনিক সমস্যার কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি থানা-ওয়ার্ডের নেতাদের সাথে নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের কিছুটা বাকবিতন্ডা হয়।

এ নিয়ে সভায় কিছুটা উত্তেজনাও হয়। থানা-ওয়ার্ডের নেতাদের বক্তব্যের সুযোগ দেওয়ার আগে আ.জ.ম নাছির উদ্দিন তাদের উদ্দেশ্যে একটানা ৪৫ মিনিট বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি থানা-ওয়ার্ড নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আজকে আমরা আপনাদের কথা শুনবো। তবে বিতর্কিত ও আক্রমনাত্বক কোন কথা বলতে পারবেন না। কেবল সাংগঠনিক সমস্যার কথা তুলে ধরবেন’।

কিন্তু নেতারা থানা-ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সমস্যার কথা বলতে গিয়ে সভায় বিতর্কের ঢেউ উঠে। পাঁচলাইশ থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ন আহবায়ক মো: এয়াকুব সংগঠনকে গতিশীল করার কথা জানিয়ে বলেন, ‘সংগঠনকে তৃনমূলে বিকেন্দ্রিকরণ করতে হবে। আপনারা মহানগর থেকে ইউনিট পর্যন্ত নিয়ন্ত্রন করতে চান। ইউনিটকে যদি ওয়ার্ডের দেখার সুযোগ না থাকে, ওয়ার্ডকে যদি থানার দেখার সুযোগ না থাকে তাহলে কেমনে হবে? এ সময় আ.জ.ম নাছির ক্ষুদ্ধ হয়ে বলে উঠেন, ‘আপনি বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। আপনি বসেন।

আপনার কথা আর শুনবো না। আপনি আমাদের শেখাচ্ছেন? আপনি ওয়ার্ড দ্ধারা নির্বাচিত হয়েছেন। আপনার থানা কমিটিতো ওয়ার্ডের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে হয়নি। তখন এয়াকুব বলে উঠেন, ‘কিছুক্ষণ আগে বলেছেন, আজকে আমাদের কথা শুনবেন। কিন্তু এখন কথা বলতে দিচ্ছেন না। পরে ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক নাজিম উদ্দিন তার বক্তব্যের শেষের দিকে বলছিলেন, ‘আমাদের ছালাম ভাই (নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএ চেয়ারম্যান) আছেন তাঁকে সাথে নিয়ে…।

এ সময় মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলে উঠেন, ‘আপনি এখানে ভাইয়ের কথা বলছেন কেন। কিসের ভাই। মহানগর আওয়ামী লীগ বলেন। ওখানে কি মহানগর আওয়ামী লীগের কোন নেতা নেই। ভাইয়ের কথা বলে আপনারা সংগঠনে বিতর্ক সৃষ্টি করবেন না। পাহাড়তলী থানা, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ড, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ড, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড এবং বক্সিরহাট ওয়ার্ডের নেতারা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক দুরাবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন তাদের বক্তব্যে।

১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ মুসা হারানো বিজ্ঞপ্তির কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের সভাপতি শফিউল ইসলামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাংগঠনিক কোন কর্মকান্ডে তাকে পাওয়া যায় না। তিনি এখন বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। বাকলিয়া এলাকার যুবদল নেতা এমদাদুল হক বাদশা আমার বিুরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেছেন।

সেই মামলার স্বাক্ষী হলেন আমার সভাপতি। ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডের আহবায়ক আবুল কাশেম ও যুগ্ন আহবায়ক এরশাদ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাদের বিরোধের কথা সভায় উপস্থিত নেতাদের জানান দেন। ২৯নং পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের সভাপতি আলী বক্স নেতাদের সাংগঠনিক ওয়ার্ডের সীমানা লঙ্ঘনের অভিযোগ করে বলেন, ‘নেতারা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় এসে সভা সমাবেশ করছেন’। এটা তো হতে পারে না। আমার এলাকায় অন্য ওয়ার্ডের নেতারা দুই মাস আগে এসে সভা-সমাবেশ করেছেন।

তখন যুবদল নেতা হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এটা নিয়ন্ত্রন করা উচিত। দীর্ঘদিন পর নগর আওয়ামী লীগের সভায় হাজিরা দেন বন্দর পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এম.এ লতিফ। ইপিজেড থানা আওয়ামী লীগের আহবায়ক হারুনুর রশিদ বক্তব্য রাখতে গিয়ে মঞ্চে বসা সংসদ সদস্য এম.এ লতিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তিনি আমাদের এমপি হয়েও কোন  খোঁজ খবর রাখেন না।

সাংগঠনিক কর্মকান্ডে তাকে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া সভায় থানা-ওয়ার্ডের কয়েকজন নেতা তাদের এলাকায় যুবলীগ-ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির কথা বলেছেন। এর আগে সভার শুরুর দিকে লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম মঞ্চে বসা আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বর্তমান যুগ হচ্ছে ডিজিটাল যুগ।

মঞ্চে নেতৃবৃন্দ যারা আছেন, আপনারা সবাই এক আছেন কি কিনা? তারা এখান থেকে বের হয়ে তাদের লেজুড়বৃত্তিক উচ্ছিষ্ট কিছু ছাত্রলীগের ছেলেকে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নেতাদের হেনস্থা করবেন কি না? নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন রাখেন,  ‘যদি আমাদের অঙ্গ সংগঠনের কেউ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? তাঁর বক্তব্যের প্রশংসা করে নগর আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কারও কোন বক্তব্য থাকলে প্রকাশ্যে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ লেখালেখি করে নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাবমুর্তি নষ্ট করলে প্রমান সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। সভার শেষ দিকে নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীর বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। মঞ্চে পাশে বসা সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামকে ইঙ্গিত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।

রেজাউল করিম বলেন, ‘ চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এ উন্নয়নের সাফল্য কার তলিতে যাবে? সরকারের তলিতে, আওয়ামী লীগের তলিতে’। ‘সমালোচনা-আত্মাসমালোচনা না করলে পার্টি শুদ্ধ হবে না’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে দেখি বড় বড় ব্যানার। যেখানে অমুকের সাথে অমুকের ছবি। এখন একটা সহজ উপায় বের হয়েছে, ‘নেত্রীর ফটোর সাথে আমার ছবি ছাপিয়ে দিয়ে গোটা চিটাগাং টাউন ছেঁয়ে ফেললাম।

এটা তো হতে পারে না’। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে রেজাউল করিম বলেন, ‘আপনাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভবিষ্যতে পার্টির সিদ্ধান্ত ছাড়া কেউ কোন ব্যানার পোষ্টার ছাপাতে পারবে না’। দলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।

সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরী করে মন্ত্রনালয়ে পাঠায় কিন্তু কাজ পেয়ে যায় সিডিএ। মেঘা প্রকল্পগুলো সিডিএ’কে দিলেও কাজ শুরু না করে কালক্ষেপন করায় মানুষ দুষছেন কাউন্সিলর ও মেয়রকে। এ অবস্থায় সম্প্রতি সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের ভুয়সী প্রশংসা করে একই অনুষ্ঠানে সিটি মেয়রের সমালোচনা করেন গনপুর্তমন্ত্রী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

এ ঘটনার পর নগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে দলের বর্ধিত সভায়। সুত্র মতে, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সর্বশেষ মেয়র প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে এখাট্টা হয়েছিলেন, ‘সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি এমপি, ডা. আফসারুল আমীন এমপি, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও এম.এ লতিফ এমপি প্রমুখ। অভিযোগ উঠে, তাদের বিরোধের কারনে জনপ্রিয় মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তার রাজনৈতিক শীষ্য মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হন।

এই ক্ষত না শুকাতেই নগর কমিটিতে সাধারন সম্পাদক হিসেবে উঠে আসেন অপেক্ষাকৃত তরুন রাজনীতিবিদ আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। মেয়র পদেও দলের মনোনয়ন পেয়ে দ্বিতীয় দফায় চমক দেখান তিনি। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হবার পর নানা ঘটনাপ্রবাহে প্রতিপক্ষে অবস্থান নেন দলের কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। জোয়ারের পানি ও অতিবৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতায় মানুষের ভোগান্তির কারনে বারবার সমালোচিত হন মেয়র। প্রত্যাশীত উন্নয়ন কর্মকান্ড করতে না পারায় তিনি সমালোচনা করেন মন্ত্রনালয়ের।

এ বিষয়টির নেতিবাচক প্রচারনায় মেয়র কুপোকাত হলেও সিডিএ’ই হয়ে যায় চট্টগ্রামের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। এরই মধ্যে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ প্রাপ্তী এবং মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের গ্রুপ রাজনীতির মেরুকরন ঘটেছে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনকে সাথে নিয়েই দল চালাচ্ছেন। তবে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ড ও ১৬টি থানা কমিটির নেতাকর্মীরা বরাবরই মহিউদ্দিনের অনুসারী।

তাদের হাল ধরেছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন ও যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক ফরিদ মাহমুদ প্রমুখরা। অপরদিকে সিডিএ’র চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম মুলত চান্দগাঁও-বোয়ালখালী নির্বাচনী এলাকা কেন্দ্রীক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। তিনি এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানা গেছে। আরেক সহ-সভাপতি ডা. আফসারুল আমীনের সঙ্গে মেয়র নাছিরের সম্পর্ক ভাল।

তবে সম্প্রতি সম্পর্কের চিড় ধরেছে এম.এ লতিফের। মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি মন্ত্রী হবার পর অনেকটাই ব্যস্ত। এ অবস্থায় জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী ও সড়ক উন্নয়নে ব্যর্থ হলে এবং দলের গ্রুপিং দ্বন্দ্ব দুর করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে খেসারত দিতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকবর্গ।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.