‘কবির কোন দেশ নেই, কোন সীমান্ত নেই’

0

সিটিনিউজবিডি : নিজেকে নেহায়েত একজন গৃহস্থ মানুষ মনে করেন ‍দুই বাংলার তুমুল জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী। তিনি বলেন, আমার জীবনে এমন কোনো গল্প নেই, যা শুনে আপনারা রোমাঞ্চিত হবেন।

শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে গ্রন্থবিপণি বাতিঘরের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ‘আমার জীবন, আমার রচনা’ শিরোনামের বিশেষ অনুষ্ঠানে পাঠকের মুখোমুখি হয়ে নিজের সম্পর্কে এভাবে বললেন কবি জয় গোস্বামী।

ভক্ত-পাঠকদের মুখোমুখি হয়ে বরেণ্য এই কবি জানালেন, তার সাহিত্যকর্মের অধিকাংশই তিনি সৃষ্টি করেছেন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, বাসে কিংবা ট্রামে বসে।

কবিতা আর কবির আলোকপাত গিয়ে জয় গোস্বামী বলেন, কবির কোন দেশ নেই, কোন ধর্ম নেই, কোন সীমান্ত নেই, কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই। কবির বিচরণ অবাধ।‘কবির কোন দেশ নেই, কোন সীমান্ত নেই’

অনুষ্ঠান পাঁচটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচটার আগেই হল রুম কানায় কানায় ভরে উঠে। ভক্ত-অনুরক্তদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকরা।

সাড়ে পাঁচটায় হল রুমে প্রবেশ করেন কবি। সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্মুহু করতালিতে কবিকে স্বাগত জানান ভক্তরা। এরপর হলজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা।

কবি বিশ্বজিত চৌধুরীর সঞ্চালনায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। ‘হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দ জলে’ কবিতা দিয়ে কবি জয় গোস্বামী শুরু করেন তার আবৃত্তি। একে একে আবৃত্তি করে শোনান ‘ঈশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ’, ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’, ‘আমরাতো অল্পতে খুশি’সহ প্রায় ১২টি কবিতা।

এরপর লেখালেখি নিয়ে পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কবি। উঠে আসে জীবনের বিভিন্ন গল্পও।

শুরুতেই কবি জয় গোস্বামী পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, আমি জীবনে কখনো কোনো যুদ্ধে যাইনি। আমি কোনো বীরত্বের কাজ করিনি। আমি জঙ্গল বা সমুদ্র কোনোটিতেই যাত্রা করিনি। আমি পর্বত আরোহণ করিনি। নেহায়েত সাধারণ একজন গৃহস্থ মানুষ। যে কথাগুলো মুখে বলতে পারিনি, সেগুলো লেখার চেষ্টা করেছি। ফলে আপনারা আমার কাছে আমার জীবন সম্পর্কে শুনতে চেয়ে অত্যন্ত হতাশ হবেন। এমন কিছু নেই, যেটা আমি বলতে পারি, যেটা রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো।

ক্রীড়া ও সঙ্গীতের প্রতি তার দুর্বলতা তুলে ধরতে গিয়ে জয় গোস্বামী বলেন, স্পোর্টস ও গানের লোক, আমি তাদের পায়ে পায়ে কুকুরের মতো ঘুরি। গানের লোকদের পায়ে পায়ে কুকুরের মতো ঘুরি শিশুকাল থেকে। আমারতো কোনো নেশা নেই। সঙ্গীত হচ্ছে একমাত্র জিনিস, যা আমাকে নেশাগ্রস্ত করে দেয়। আমাকে ভেতর থেকে বাইরে নিয়ে আসে।

‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ আলোচিত কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপট জানতে চান এক পাঠক। এ প্রসঙ্গে কবি জয় গোস্বামী বলেন, বেশির ভাগ কবিতা আমি রাস্তাঘাটে হাঁটতে হাঁটতে লিখেছি। কখনো ট্রামের মধ্যে যেতে যেতে লিখেছি। কখনো বাসে। তখন আমি আর কাবেরী (কবির স্ত্রী) সবে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। আমি তৎকালীন কর্মস্থল থেকে বেরিয়েছি। আমার সঙ্গে ছিলেন একজন স্পোর্টসের লোক। সে আমার সঙ্গে অফিসের আভ্যন্তরীণ কলহের গল্প বলতে বলতে আসছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি বাসের টার্মিনালের দিকে। একটা বাসে আমি উঠে যাবো। আমি ফিরবো দক্ষিণ কলকাতায়। সে চলে যাবে হাওড়ায়। যেহেতু অফিস শেষের ভিড়ে আমরা হাঁটছি সেহেতু মাঝে মাঝে সে পিছিয়ে পড়ছে। যখন সে পিছিয়ে পড়ছে তখন ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ লাইনগুলোও আমার মাথায় হানা দিচ্ছে। আবার সে যেই আমার কাছে চলে আসছে, তখন লাইনগুলো ছুটে যাচ্ছে। এরকম করতে করতে আমার বেশকিছু পথ হেঁটে গেলাম। এরপর বাসে উঠলাম। যেখানে ঠাসাঠাসি ভিড়। যখন বাসে ধাক্কা লাগছে গায়ে তখন লাইনগুলো ছুটে যাচ্ছে। যখন স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি, তখন লাইনগুলো আবার আসছে। এরকম করতে করতে আমার যেখানে নামবার কথা সেখানে এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয়। বাড়িতে যেতে যেতে ওই পথটুকুর মধ্যে কবিতাটা তৈরি হয়ে গেল। আমি বাড়ি গিয়ে সাধারণত স্নান করি। স্নান না করেই কাগজ নিয়ে বসলাম এবং ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ কবিতাটা লিখলাম। এই হলো ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ লিখার ইতিহাস।

‘কবির কোন দেশ নেই, কোন সীমান্ত নেই’‘মেঘ বালিকার জন্য রূপকথা’ কবিতার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে কবি বলেন, আমার জীবনের একটা সময় ছিল, যখন জানতাম না যে মেয়েরা কবিতা পড়ে। আমি আমার জীবনের একটা বড় অংশ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করে কাটিয়েছি। যেহেতু আমি স্কুল ড্রপআউট। একা একা ঘুরে বেড়াতাম। একা একা লাইব্রেরিতে বসে থাকতাম। আমার যৌবনের একটা সময় আমি কোনো মেয়েকে চিনতাম না। এরপর আস্তে আস্তে কবিতা লিখা শুরু করলাম। আমার বাড়িতে চিঠি আসা শুরু হলো। শুধু প্রকাশক কিংবা সম্পাদকদের চিঠি তা নয়, দুয়েকটি মেয়ের চিঠিও আসতে লাগলো। যেহেতু মেয়েদের কোনো চিঠির উত্তর কী করে দেব, আমি জানি না। তখন পর্যন্ত সেসব শিখিনি। সেহেতু আমি চিঠির উত্তর দিতে পারি না। তার মধ্যে কেউ কেউ দিয়ে দেয় চন্দনের গুড়ো। কখনো কখনো গোলাপের পাপড়ি। কোনো উত্তরই আমি দিই না। ‍অবশেষে একদিন মরিয়া হয়ে স্থির করলাম একজনের লেখার উত্তর দেব। সেই উত্তরটা লিখতে গিয়ে আমি কবিতাটা লিখি। ফলে তাকে আর কখনো উত্তর দেওয়া হয়নি। তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

এক পাঠক জানতে চান কোন বিষয়টিকে কবিতায় প্রাধান্য দেন জয় গোস্বামী। উত্তরে তিনি বলেন, কোন বিষয়টাকে প্রধান্য দেব, এটা আমার হাতের ওপর থাকে না। এটা থাকে কোথায়, তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। সেটা থাকে নিয়তির ভেতরে। আমি কোন বিষয়ে লিখবো, কি নিয়ে লিখবো, সেটা আমার হাতের ওপর থাকে না। সেটা নিয়তি ঠিক করে দেয়।

লেখালেখিতে লেখকদের বন্ধ্যাত্ব নিয়ে এক পাঠকের প্রশ্নের জবাবে জয় গোস্বামী বলেন, আমার ৫৩ বছরের লেখালেখির বয়সে কেবল দু’বছর ১১ মাস কবিতা লিখিনি। তার কারণ হচ্ছে, আমি সবসময় ভেবেছি আমার মনটা যেভাবে পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে, আমি কি সে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার উপযোগী শব্দ বা ভাষা খুঁজে পাচ্ছি। এ প্রশ্ন আমি সবসময় নিজেকে করেছি। ২৫টা লেখা বাড়িতে আছে। আমি ডাকে বিভিন্ন জায়গায় কবিতা পাঠাতাম। থাকতাম কলকাতা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে একটা জায়গায়। সেখান থেকে ডাকে লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা পাঠাতাম। ১০টা জায়গায় কবিতা পাঠিয়েছি, দু’টো কাগজ ছাপিয়েছে। একটা পত্রিকা হয়তো ডাকে এলো, আরেকটা এলো না।
তখন মনে হতো আমার লেখা নিশ্চয় ভালো হয়নি। তখন লেখা থাকতো বেশি। আর ছাপার জায়গা ছিল ভীষণ কম। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে তখন লিটল ম্যাগাজিন বা বাণিজ্যিক কাগজ থেকে প্রতিবছর লেখা চাওয়া হয়। আমি লেখা দিতাম। একটা স্বাভাবিক যুক্তি হচ্ছে নিশ্চয় লেখা ভালো হচ্ছে, তা না হলে তারা কবিতা চাইবেন কেন। ছাপাও বা হবে কেন। এভাবে ২০-২৫ বছর চলে। আমার মনে হলো যে, আমার মনটা যে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, আমার ভাষা কি সেভাবে পাল্টাচ্ছে। এটার জন্য আমি একটু অপেক্ষা করলাম, বললেন জয় গোস্বামী।

তিনি বলেন, এ রকম বন্ধ্যাত্বে বুদ্ধদেব বসু পড়েছিলেন। ‘কবি ও আমার জীবন’ প্রবন্ধে তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। সে রকম অবস্থা নয়। একটু বিরতি দিলাম। ওই বিরতির সময়টা আমি নির্ভর করলাম অন্য কবিদের কবিতা নিয়ে লেখার। যখন লেখকদের লেখার অসাড়তা আসে তখন তারা অন্যের কবিতা অনুবাদ করে। আমি অন্যের কবিতা অনুবাদ করার চাইতে, বাংলা ভাষায় অনেক ভালো কবিতা পড়েছি।

জয় বলেন, একেবারে অল্প বয়সী একটা ছেলে, যার নামই কখনো শুনিনি। কাগজে তার একটা ভালো লেখা পড়লাম। সে সময় চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ, তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। সে আমায় পছন্দ করতো কোনো কারণে। সেসময় সে সংবাদ প্রতিদিনের রোববার নামে একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। সে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। সে বললো, তুমি কবিতা নিয়ে বছরে একবার করে দেশ পত্রিকায় লেখ। ওই লেখাটা তুমি সাপ্তাহিকভাবে রোববারে লেখ। আমি বললাম, সাপ্তাহিক পারবো না পাক্ষিকভাবে লিখি। গোসাইবাগান শিরোনামে লিখতে শুরু করলাম। সেখানে বুদ্ধদেব বসু নিয়ে যেমন লিখেছি শূন্য দশকের কবি নিয়েও লিখেছি। সাতবছর লিখেছিলাম। আমার ভালো লাগা কবিতা নিয়ে কয়েক বছর লেখার পর আমি আবার নিজের কবিতার মধ্যে ফিরে গেলাম।

তরুণ কবিদের নিন্দা, কলহ ও বিদ্বেষ চর্চা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে কবি বলেন, এগুলো থেকে মনকে দূরে রাখতে পারলে ভালো।

ফেলানি হত্যা ও সীমান্তে বিএসএফ’র হত্যাকাণ্ড কবি হৃদয়কে স্পর্শ করে কি না জানতে চান এক পাঠক। উত্তরে কবি বলেন, যে কোনো হত্যারই আমি বিরোধী।

বর্তমান বিশ্বে যেখানে মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে, এ অবস্থার উন্নয়নে কবিতা বা সাহিত্যের অবদান কতটুকু জানতে চান আরেক পাঠক। উত্তরে কবি বলেন, কবির কোনো দেশ নেই, ধর্ম নেই, কোনো সীমান্ত নেই, কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। কবির বিচরণ অবাধ। কবিতা, গান ও চিত্রকলা প্রত্যক্ষভাবে হয়তো শাসককে প্রলয়কে বাধা দিতে পারে না। কিন্তু সে মূল ক্ষত পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করে যায়। সমস্ত ধর্মের মানুষ সঙ্গীতকে আশ্রয় করেছে ভালবাসার জন্য। সব ধর্ম বলে ভালবাসার কথা।

অনুষ্ঠান শুরু হয় কবিতায়, শেষও হয় কবির তিনটি কবিতা আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.