কেন অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা জানা যাবে নাঃ হাইকোর্ট

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের ঠিকানা কেন জানা যাবে না জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। বাংলাদেশ থেকে কয়েক বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।  পাচারের সঙ্গে জড়িত শতাধিক ব্যক্তি।  তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।  একই সঙ্গে অর্থ পাচারে জড়িতদের তথ্যানুসন্ধান এবং এর ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি চলমান রয়েছে।  এসব তথ্য পাওয়া গেলে পাচারের পরিমাণ ও জড়িতের সংখ্যা আরও বাড়বে।

বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বৃহস্পতিবার দুদকের দাখিল করা প্রায় ২৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়।  এ সময় আদালত বলেছেন, পাচারকারীদের নামটা জাতি জানতে পারবে তো?

দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থ পাচারের (মানি লন্ডারিং) দুই মামলায় এখন পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া দুই ব্যক্তির প্রায় ৪১ কোটি ৪১ লাখ টাকা দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এছাড়া দুই ব্যক্তির ইংল্যান্ডে থাকা ১২ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯১ পাউন্ড এবং এক ব্যক্তির হংকংয়ে থাকা ১৬ মিলিয়ন হংকং ডলার আদালতের আদেশের মাধ্যমে ফ্রিজ (জব্দ) করে রাখা হয়েছে।

এদিন হাইকোর্টের নির্দেশে বিদেশে অর্থ পাচার এবং কানাডার কথিত ‘বেগমপাড়ায়’ বাংলাদেশি অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে পৃথক প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও এনবিআর।  তবে তথ্যের ঘাটতি থাকায় দুদক ও বাকি পাঁচ সংস্থাকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।  রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তাহমিনা পলি।

গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউতে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি কর্মচারীরা।  আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন।  কিছু আছেন পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী।’ পর দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।  পরে ২২ নভেম্বর ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট।  আদেশে দুদক এবং পাঁচ সংস্থাকে বিদেশে অর্থ পাচার এবং কানাডায় বাংলাদেশি অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।  এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন দাখিল করে সংস্থাগুলো।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাসে অর্থ পাচার সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে। তারা প্রতিবেদন দিলে আদালতে তা দাখিল করা হবে।  দুদকের প্রতিবেদনে চলতি বছর পর্যন্ত দেশে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে করা মামলার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।  মামলার হিসাবে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।  এসব মামলায় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বিএনপির পদত্যাগী নেতা এম. মোরশেদ খান, মোসাদ্দেক আলী ফালু, খন্দকার মোশারফ, গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন প্রমুখ রয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুদক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের অপরাধে ৪৭টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে।  অপরদিকে ৮৮টি মামলা তদন্ত করছে দুদক।  এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় চার ব্যক্তির বিদেশে অর্থ-সম্পদ ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করা এবং ফেরত আনা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে দুদক জানায়, ২০০৯ সালে কাফরুল থানার এক মামলায় পাচার করা প্রায় ২১ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই বছরই ক্যান্টনমেন্ট থানায় করা এক মামলায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা ফেরত এনে রাষ্ট্রের অনুকূলে জমা করা হয়েছে। ২০১৪ সালে রমনা থানার মামলায় ব্রিটেনে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আট লাখ আট হাজার ৫৩৮ পাউন্ড ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়েছে। ২০১৩ সালে গুলশান থানার এক মামলায় মোরশেদ খানের ১৬ মিলিয়ন হংকং ডলার ফ্রিজ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১১ সালের ক্যান্টনমেন্ট থানার এক মামলায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের চার লাখ ১৮ হাজার ৮৫৩ পাউন্ড ফ্রিজ করা হয়েছে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের তথ্যানুসন্ধান চলছে।  কানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়ে সে দেশের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। সিআইডি জানিয়েছে, ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ সাত জন এবং হ্যাকারদের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় অর্থ পাচার করা হয়েছে।  তাদের মধ্যে সম্রাট এবং এনামুল হক আরমান ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেছেন।

প্রতিবেদনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য এবং সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলো পাচারকারীদের নামের তালিকা দিতে না পারায় শুনানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট থেকে আমাদের নামের দরকার নেই। যারা অর্থ পাচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তারপর আদালতে দেন।

এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, আমরা চলতি বছর পর্যন্ত তথ্য দিয়েছি। তখন আদালত বলেন, পুরাতন কাহিনি বলে লাভ নেই। আমাদের আদশের পর কী করেছেন তা দেখতে চাই। তার একটা ফিরিস্তি দেন। জবাবে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বিদেশে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, জব্দ করা হয়েছে তা এখানে দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেন, এগুলো করেছেন ঠিক আছে। যারা অবৈধভাবে দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে গাড়ি-বাড়ি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটি জানান। পুরাতন কাহিনি শুনে কোনো লাভ নেই। যা বলেছেন তা সবাই জানে। নতুন কী করেছেন সেটা বলেন। যদি আদালতকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা না করেন, তাহলে মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেব। দুদকের উদ্দেশে আদালত আরও বলেন, সময় লাগলে সময় নেন। তবু আমাদের আপডেট তথ্য দেন।

এ সময় অন্য সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আদালত বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল তো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন।  বিভিন্ন মিশনে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।  এক পর্যায়ে আদালত বলেন, সব সংস্থা যদি সরকারকে সহায়তা করে, তাহলে কেন অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা জানা যাবে না।  কোর্টের কাজ হলো সরকার ও জনগণকে সহযোগিতা করা।  আমরা দেশ ও দেশের মানুষকে সহযোগিতা করতে চাই। অর্থ পাচার নিয়ে যে রিপোর্ট বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে হয়েছে তা অশনিসংকেত।  বিচারক হয়েও যদি এখন এসব দায়িত্ব পালন না করি, তাহলে একসময় মানুষ আমাদের কাছে প্রশ্ন করবেন, বিচারকের দায়িত্বে থেকে কী করেছেন।  তখন আমরা লজ্জায় পড়ে যাব।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যসূত্র উল্লেখ করে আদালত আরও বলেন, দেশে ১৮ কোটি মানুষ। তার মধ্যে হয়তো অল্প কিছু মানুষই এই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। পাচারকারীরা অনেক ভীত। যারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করেছেন তাদের নাম আমরা জানতে চাই। বিচারটা না করেন, নামগুলো জানাতে হবে। আমরা তো শুনলাম বেগমপাড়া, সাহেবপাড়া আছে। আর কত কী পাড়া আছে?

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.