চট্টগ্রামে নষ্ট রাজনীতি এবং উপেক্ষিত ত্যাগী নেতারা

0

জুবায়ের সিদ্দিকী  :  সারাদেশের মত চট্টগ্রামেও অভ্যন্তরীন কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, সুযোগসন্ধানী ও হাইব্রীড় নেতাদের নানামুখী তৎপরতায় সমস্যায় পড়েছে তৃনমুল আওয়ামী লীগ। এমপি-মন্ত্রীদের পাশে এখন ত্যাগী নেতাকর্মীরা ভিড়তে পারেন না। ভুঁইফোড়রাই নেতৃত্বের অগ্রভাগে। আদর্শ ও লক্ষ্য অভীন্ন। তবুও অধিকাংশ নেতাকর্মী দুই মেরুতে অবস্থান। কর্মসুচীতে একসাথে এরপরও নেতা নিয়ে আছে পছন্দ-অপছন্দের কারিশমা নগরীতে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এমপি মন্ত্রীদের কারনে কমপক্ষে ২৫টি জেলায় দলীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকা ত্যাগী, সংগ্রামী, নির্যাতিত ও কর্মীবান্ধব নেতারা এখন অনেকটা কোনঠাসা।

আওয়ামী লীগে কোনভাবেই ত্যাগী নেতাদের মুল্যায়ন নেই। নেতৃত্ব ও ক্ষমতা এখন হাইব্রীড় নেতৃত্বের হাতের মুঠোয়। উড়ে এসে জুড়ে বসা এসব নেতার দলে আবেদন না থাকলেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কর্মীদের কাছে তারা বিরক্তির কারন হয়ে উঠেছে। অনেকেই ব্যস্ত দলীয় পদ পদবী ব্যবহার করে আখের গুছাতে। অনেক এমপির ব্যক্তিগত সহকারী শিবিরের ক্যাডার অথবা রাজাকারের বংশধর। চট্টগ্রামের এক সাবেক মন্ত্রীর এপিএসের ছিল এই কাহিনী। নগর বা উপজেলা কোথাও কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নগরীতে বা উপজেলায় দিবসভিত্ত্বিক কর্মসুচী ছাড়া কোন কর্মসুচী পালন করা হয় না।

এমপিরা অধিকাংশ সময় ঢাকায় থাকেন। চট্টগ্রামের মফস্বলের এমপিরা থাকেন শহরের অভিজাত এলাকায়। মাঝেমধ্যে এলাকায় গেলেও সরকারী কর্মসুচী শেষ করেই আবার চট্টগ্রাম নগরীতে বাসায় ফিরে আসেন। তাদের অনুসারী হাইব্রিড নেতা ও আত্বীয়স্বজন এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করেন। এর ফলে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে তৃনমুল নেতাকর্মীদের মধ্যে। এতে করে বিভক্তির দেখা দিচ্ছে দলে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তৃনমুলকে শক্তিশালী ও উজ্জীবিত করতে উদ্যোগ নিলেও কোন কাজ হচ্ছে না। শীর্ষ নেতারা সুবিধা আর ভোগবিলাসেই ব্যস্ত। দলীয় কর্মসুচীর দিকে তাদের নজর নেই। অনৈক্য থাকায় জেলার রাজনীতির দৈন্যদশা। প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও নেতাকর্মীরা নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্ত।

চুনোপুটিরাও এখন দল ক্ষমতায় আসার পর বড় নেতা হয়ে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত। তাদের উপর নগরীর শীর্ষনেতাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। জায়গা দখল থেকে শুরু করে এমন কোন অপকর্ম নেই যে, তারা করছেন না। এমতাবস্থায় দলীয় কর্মকান্ড ঝিমিয়ে পড়েছে। ত্যাগী নেতারা নিরব হয়ে পড়ছেন। চাটুকারদের রাজত্ব যেন থেমে নেই।

এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ক্ষমতাসীন দল বা এর অংগসংগঠনের সদস্য পদ থাক বা না থাক ’জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান বা মুক্তিযুদ্ধের নামে স্বপক্ষীয় শক্তি উল্লেখ করে নিজের ঢাউস ছবিযুক্ত ব্যানার রয়েছে যত্রতত্র। এসব সাইনবোর্ড ব্যানার ঝুলছে দিনের পর দিন। ইদানীং মেয়রের ছবির সাথে নিজের ছবি দিয়ে ’নাছির ভাই এগিয়ে চলো’ মার্কা ব্যানারে যাদের ছবি উঠেছে তাদের অনেককে মেয়র চেনেন কিনা সন্দেহ আছে। দলীয় পরিচয়ে এসব অনেক অখাদ্য কুখাদ্য বাজারে হয়েছে সু;স্বাদু খাদ্য। এদের দাপট ও ক্ষমতা রাজনীতির প্লাটফরম থেকে শুরু করে সরকারী অফিসগুলোতে উপচে পড়ছে। মাস কয়েক আগে বিকেলে যেতে হল সদর ভুমি অফিসে।

খতিয়ান সহ জরুরী কাজগুলো সে অফিসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালু হয়েছে। সহকারী কমিশনার কক্ষে বসে সে পদ্ধতির খুঁটিনাটি দিকগুলো জনগনকে কিভাবে সেবা দিবেন তা বর্ননা করছিলেন তৎকালীন সহকারী কমিশনার সামিউল মাসুদ। হঠাৎ শুনি মানুঝের ঝগড়ার আওয়াজ। সে সময় মাসুদ সাহেব পিয়নকে ডেকে বললেন, কে চিৎকার করছে। আমার কাছে নিয়ে আসো। সে ব্যক্তি কক্ষে প্রবেশ করে বললেন,’ না। মোবাইলে মন্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম। আমি নাছিরাবাদ আওয়ামী লীগের একজন সাবেক নেতা। সামিউল মাসুদ সাহেব তাকে বসিয়ে তার ফাইল তলব করে বললেন,’ ঠিক আছে কাল এসে নিয়ে যাবেন। সে লোকের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বললেন ’ কিছু মনে করবেন না স্যার আপনি ম্যাজিষ্ট্রেট মানুষ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই হল ভুমি অফিসের চিত্র।

ওবা বইনপুত ভালা আছনি। কতদিন ন দেখি বাঁজি! আঁই তোয়ার অফিসত আইস্্িযদে’ বলতে বলতে প্রবেশ করলেন সরকারী এক অফিসের উদ্ধতন কর্মকর্তার অফিসে কক্ষে মধ্যবয়সী এক মহিলা। তিনি মন্ত্রীর সাথে কথা বলছিলেন এ দৃশ্য দেখালেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে। এভাবে নগরীতে রাজনৈতিক নেতারা তদবির বানিজ্য নেমেছেন কোমর বেঁধে। বিদ্যুৎ, গ্যাসের সংযোগ, নিয়োগ-বদলী, স্কুল-কলেজে ভর্তি, ভুমি অফিস থেকে শুরু করে সর্বত্র তদবিরবাজদের রাজত্ব যেন থেমে নেই। নগরীর অনেক জনপ্রতিনিধি, ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের কাছে ’তদবির’ এখন প্রধান পেশা হয়ে উঠেছে।

রাজনীতির লেবাসে এরা চষে বেড়ায় সরকারী সব দপ্তরে। এমপি-মন্ত্রীদের নাম ভাঙ্গিয়ে এদের রমরমা বাণিজ্য জমজমাট। এখন চট্টগ্রাম মহানগরী ও মফস্বলে নবনির্বাচিত মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের ভাবমুর্তি বিনষ্ট করতে এক শ্রেনীর নব্য আওয়ামী লীগার ও হাইব্রীড় নেতাকর্মী পোস্টার, ব্যানার, ফ্যাষ্টুনে তার ছবিযুক্ত করে নিজেদের প্রচার করা ছাড়াও আত্বীয় ও খাসলোক পরিচয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে বিগত দিনে একটি মহল চেষ্টা করেছিল এখন তখন তিনি সেসব নেতাকর্মীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন’ কাক্কু অঁল এত কারবারী ন’হইও। আঁরে কাম গইত্যে দও’’। মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালীন এভাবে কেউ করার সাহস পাননি। কারন তার ’ইংরেজি ভাষা’ সকলের জানা আছে। বর্তমান মেয়র মহোদয়কে বলবো, ’হাইব্রীড়দের উৎসাহি হয়ে যত্র তত্র মেয়রের নাম বিক্রি করে ফায়দা লুটেরাদের হুশিয়ার করে দিতে হবে অথবা এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নেওয়া যাইতে পারে।

সাধারন মানুষ নিরাপত্তা চায়। নিরাপদ থাকতে চায়। তাদের সেই নিরাপত্তা দিতে হবে। সাধারন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কঠোরতার কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে কারো প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনেরও সুযোগ নেই। অপরাধীদের বিরুদ্ধে বা টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ যে দলেও যত বড় নেতা হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন বাঞ্চনীয়। জায়গা দখল থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী অনেক কর্মকান্ডের নাটাই রয়েছে হাইব্রীড় নেতাদের হাতে। যার কারনে সরকার ও দলের ভাবমুতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। এরপর আছে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে ঘাপটি মেরে থাকা সরকার বিরোধী অনেক কর্মকর্তা। এরাই আগলে রাখে হাইব্রিডদের প্রশাসনে তদবির বানিজ্যে। সেদিন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বললেন, কোথাও গিয়ে স্বস্তি নেই। যেখানেই যাচ্ছি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনছি। রাজনীতি এখন চরমভাবে কলুষিত হয়ে পড়েছে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে পেশায় পরিনত করেছেন। যার কারনে রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

সরকারী দলের এমপি কোন কোন জায়গায় পিস্তল উঠিয়ে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। এমনকি এক এমপি গুলি করে এক শিশুকে আহত করেছে। এভাবে অনেক জায়গায় জনপ্রতিনিধিরা মানুষকে মানুষ ভাবেন না। দেখলে বলেন,’ কড়ে বাড়ি। এড়ে কি! কেউ আবার বলেন ’তোয়ারে তো ন’চিনিলাম, কার পোয়া তুঁই’। একেকজন জনপ্রতিনিধি থানা ও প্রশাসনকে জিম্মি করে রেখেছেন। সকল উপজেলা ও নগরীতেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চামচা ও চাটুকাররা প্রশাসনে হস্তক্ষেপ ও দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।

বৃহত্তর চট্টগ্রামের চিত্র এমনই। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে অগনিত নেতা ও হাফ নেতা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অমুক ভাই, তমুকভাই ও বড়ভাইদের নাম ভাঙ্গিয়ে এরা নষ্ট রাজনীতির বিষাক্ত বাতাসে যেন বিষ ছড়াচ্ছেন। এর মাসুল একদিন দলকে হয়ত দিতে হতে পারে। ত্যাগীদের মুল্যায়ন না করে জামাত শিবিরের ও বিএনপির ঘরানার লোকজন পরিবেষ্টিত হচ্ছেন অনেক জনপ্রতিনিধি। এর সুফল ভাল হতে পারে না।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.