মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বে কোভিড ইউনিটের চিকিৎসকরা!

0

সিটি নিউজ ডেস্ক: ২ এপ্রিল দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রে পরিদর্শক, পরীক্ষক ও কন্ট্রোলরুমের দায়িত্ব পালন করবেন বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ নির্ণয়ের কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পিসিআর ল্যাবের টেকনোলজিস্ট, এমএলএসএসসহ বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালের কর্মকর্তারা। এছাড়া বর্তমানে দেশে বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের দায়িত্ব পালন করছেন যেসব চিকিৎসক, তারাও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে দায়িত্ব পালন করবেন!

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনা মেনে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের কাছে দায়িত্ব পালনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পরীক্ষা প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বুধবার (৩১ মার্চ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দেশে বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ছে। আর এমন অবস্থায় রাজধানীর হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্ব পাওয়া কোভিড ইউনিটের চিকিৎসকরা মনে করছেন এমন অবস্থায় জনসমাগমে গেলে সেটা হতে পারে অন্যদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃপক্ষ বলছেন, যারা পজিটিভ হবে তাদের কেউ তো আর পরীক্ষাকেন্দ্রে যাবেন না দায়িত্ব পালন করতে। আর কোভিড ইউনিটের চিকিৎসক বা পিসিআর ল্যাবের টেকনোলজিস্টরা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করলে তেমন কোনো ঝুঁকিও দেখছেন না স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর।

রাজধানীর একাধিক কোভিড ইউনিটের দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসক ও পিসিআর ল্যাবের দায়িত্ব পালনকারী টেকনোলজিস্টদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোভিড ইউনিটে দায়িত্ব পালন করা এক চিকিৎসক বলেন, আমরা আগে কোভিড ইউনিটে দায়িত্ব পালন শেষে কোয়ারেনটাইনে থাকতাম ১৫ দিনের জন্য। আর এখন দায়িত্ব পালনের মাঝেই আমাদের দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্ব, যেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা থাকছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার অ্যাজমা আছে ও একইসঙ্গে জ্বর কিন্তু এখনো পিসিআর পরীক্ষা করানো হয় নাই। তবে দায়িত্ব পালন শেষে যখন কোয়ারেনটাইনে যাবো তার আগে আমাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সুতরাং এর আগে আমার পজিটিভ বা নেগেটিভ জানার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, আজকে একটা ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রাম হয়েছে। সেখানে জানানো হয়েছে যারা পজিটিভ তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে না। কিন্তু, যারা বর্তমানে রানিং অবস্থায় কোভিড ইউনিটে দায়িত্ব পালন করছি তারা কিভাবে পজিটিভ বা নেগেটিভ শিওর হবো? আমার আরেক কলিগের এর মধ্যে জ্বর এসেছিল এবং একই সঙ্গে আমাদের ইউনিটের প্রধানেরও একই অবস্থা। আমাদের সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি আদেশ আমাদের মানতে হবে কিন্তু যদি আমাদের কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়ায় তবে তার দায়টা আসলে কারা নেবে জানি না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন টেকনোলজিস্ট বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রতিদিন নানা রকম স্যাম্পল নিয়ে কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংক্রমণের ঝুঁকি তো থাকেই। কিন্তু, সরকারি দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগও নেই। শুনেছি পরীক্ষাকেন্দ্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্কের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং একইসঙ্গে আইসোলেশনেরও ব্যবস্থা আছে।

সংক্রমণের দায় নেবে কে, প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সংক্রমণ বাড়ছে দেশে আর এমন অবস্থায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। কারণ এতে করে শিক্ষার্থীদের মাঝে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। একইসঙ্গে কোভিড ইউনিটে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারাসহ ল্যাবের টেকনোলজিস্টদের কেন্দ্রে দায়িত্ব দেওয়া মানে হলো সংক্রমণ ছড়াতে সাহায্য করা। আর এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষার্থীরাও স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। আমার কাছে এটাকে মনে হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা হিসেবে। পূর্বে তাদের যে সমন্বয়হীনতা ছিল তা এখানেও দেখা গেছে। কারণ এই মন্ত্রণালয় কিন্তু স্বাস্থ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত। তারাই কিন্তু যুক্ত ১৮ দফা নির্দেশনা প্রদানের বিষয়েও।

তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনার সঙ্গে আসলে পরীক্ষা নেওয়ার যে প্রস্তুতি তা আসলে মিলছে না। নানা ভাবে তাই মনে হচ্ছে এটা আরেকটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২ তারিখে পরীক্ষা না হয়ে যদি আরও দুই মাস পরে হতো তাতে এমন কোনো ক্ষতি হতো না। সেক্ষেত্রে বরং পরীক্ষার্থীসহ অন্যান্য সকলের জীবনের ঝুঁকিটা একটু কমানো যেতো বলে মনে করি। এখন যদি কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয় কিন্তু দেখা গেলো সংক্রমিতও হয়েছে তবে তার দায়িত্ব কে নেবে? পরীক্ষা নিতে গিয়ে কোনো কোভিড ইউনিটের চিকিৎসক বা টেকনোলজিস্ট থেকে সংক্রমণ ছড়ায় তবে তার দায় কে নেবে?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দুটি বিষয় বলতে হয়। প্রথমত এই যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে সংক্রমণের এমন ঊর্ধ্বগতির সময়ে সেটি অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সরকারের ১৮ দফা যে নির্দেশনা তার সঙ্গে এটি সঙ্গতি পূর্ণ না। করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরণের পরীক্ষা আয়োজন করা হলো একটি আত্মঘাতী বিষয়। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় এমন কোনো লোকজন থাকা উচিত না যাদের রোগ বহন করে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কোভিড ইউনিটের চিকিৎসকই বলেন আর টেকনোলজিস্টই বলেন তারা তো ক্লোজ কন্টাক্টেই থাকছে রোগীদের সঙ্গে বা বিভিন্ন স্ট্রেইনের নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে। ফলে এটাও যথাযথ না। বিষয়টা মনে হচ্ছে দায়সারা গোছের একটা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য করা একটা আয়োজন। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বে। তাদের পরিবারের সদস্যরাও ঝুঁকিতে পড়বেন। এদের মধ্যে অনেকেই আক্রান্ত হয়ে ভোগান্তিতে পড়বেন। দুঃখজনকভাবে কেউ কেউ মৃত্যুর দিকে যেতে পারে যদি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে তো। সেক্ষেত্রে আসলে দায় কে নেবে?

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের অধ্যক্ষ ও দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. টিটু মিয়াঁ বলেন, পিসিআর ল্যাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনোলজিস্টরা যেহেতু খুব ক্লোজলি বিভিন্ন নমুনা নিয়ে কাজ করে সেক্ষেত্রে তাদের মনে হয় দায়িত্ব না দেওয়াই শ্রেয়।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

যদি কোনো চিকিৎসক আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে কি না এবং সেখান থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রে সংক্রমণ ছড়াতে পারে কি না? একই সঙ্গে কোভিড ইউনিটে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও ল্যাবের টেকনোলজিস্টদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে কি না?

এই দুটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আহসান হাবিব বলেন, পরীক্ষা গ্রহণের জন্য সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখানে যারা পজিটিভ হবেন নমুনা পরীক্ষায় তবে তারা এমনেই আইসোলেশনে থাকবে। কেন্দ্রগুলোকে সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আর তাই তারাও আক্রান্ত চিকিৎসকদের দূরেই রাখবে।

অনেক উপসর্গহীন রোগী পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে যাদের লক্ষণ না থাকায় পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হয় না। তাদের মাঝে যদি কেউ একজন এমন ওরিয়েন্টশনে থাকে তবে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের এই পরিচালক বলেন, এই ইস্যু তো অনেক বড় ইস্যু তাই এটা নিয়ে কিছু বললাম না। এমনিতে আমাদের বলা হয়েছে যে যারা কোভিড পজিটিভ তারা ডিউটি করবে না। আর সবাইকে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে যদি কেন্দ্রে প্রবেশ করাতে হয় তবে বিষয়টা হয়ে যাবে লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড় হয়ে যাওয়ার মতন। সবাইকে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে পরীক্ষা নেওয়া বা দেওয়ানো কী সম্ভব? আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাই তো করছি স্বাস্থ্য বিধি নিশ্চিত করার জন্য। এর চেয়ে বেশি তো আর সম্ভব হচ্ছে না।

ওরিয়েন্টশন এভাবে না করে অনলাইনে কোনো নির্দেশনা দেওয়া যেতো কিনা সে বিষয়ে ডা. আহসান হাবিব বলেন, এটা কেন্দ্রগুলো বিষয়।

এ দিকে সরকার নির্দেশনা ভাঙা বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে জানতে পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
সুত্র: সারাবাংলা ডট নেট

সিটি নিউজ/এসআরএস

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.