চট্টগ্রামে অটোরিকশা বানিজ্যে থানা ও হাইওয়ে পুলিশ

0

জুবায়ের সিদ্দিকী  –  

দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোতে সরকারী আদেশে বন্ধ হয়ে গেছে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও থ্রি হুইলার চলাচল। মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণে গত ১ আগষ্ট থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা থাকলেও চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে কার্যকর হয়নি সরকারী এ আদেশ। মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনায় প্রাণহানীতে প্রশাসনের টনক নড়লেও এ অটোরিকশা ধরপাকড় নিয়েই পেট ভরছে হাইওয়ে পুলিশের। অভিযোগ উঠেছে, মহাসড়কে চলাচল নিষেধাজ্ঞার নির্দেশনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সিএনজি অটোরিকশা থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। গত এক মাসে হাইওয়ে পুলিশের শিকলবাহা ফাঁড়ির ইনচার্জ শফিকুল ইসলামের পকেটে কেছে প্রায় কোটি টাকা।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুুল তুলেছেন বিআরটিএর সদস্য ও চট্টগ্রাম চেম্বার এন্ড কমার্সের সহ-সভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ। জানতে চাইলে, সৈয়দ জামাল আহমেদ জানান, ’হাইওয়ে পুলিশের শিকলবাহা ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) শফিকুল ইসলাম কাউকে পরোয়া করে না। তার খুঁটির জোর কোথায় জানি না। সরকারী নির্দেশনা আছে মহাসড়কে গাড়ি না চলা। কিন্তু আইসি শফিক গাড়ি আটকিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রত্যেক গাড়ি থেকে ৭ হাজার থেকে ১২ হাজার পর্যন্ত নেয়। টাকা দিতে না পারলে গাড়ি আটকিয়ে রাখে। আমি একাধিকবার তাকে গাড়ি থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করতে বলেছি। কিন্তু সে বলে সেই টাকা নাকি উপর মহলকেও দিতে হয়। সেই উপর মহল কে আমরা তা’ জানি না। মন্ত্রী মহোদয় (ভুমি প্রতিমন্ত্রী ) তাকে কয়েকবার বলেছেন গাড়ি আটকিয়ে টাকা না নেয়ার জন্য। কিন্তু সে মন্ত্রীর কথাও শোনে না।’
জানা যায়, আগষ্ট মাসের শুরু থেকে মহাসড়কে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের পর থেকে কয়েকদিন চলাচল বন্ধ থাকলেও হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে পুনরায় চলাচল করতে শুরু করে। এ জন্য পুলিশকে নির্ধারিত অংকের টোকেন মুল্য দিতে হয়। তবে সরকারের কোন মন্ত্রী মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত করলে অটোরিকশার উপর শুরু হয় হাইওয়ে পুলিশের খড়গ। বিশেষ করে সেতু মন্ত্রী গেলে তো কথাই নেই। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে বলেন, শিকলবাহা (পটিয়া) ফাঁড়ির আইসি শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চলে অটোরিকশা ধরা অভিযান। পরে অটোরিকশা প্রতি ৭ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে ছেড়ে দেন আইসি শফিক।

গত এক মাসে প্রতিদিন শতাধিক সিএনজি অটোরিকশা আটকিয়ে প্রায় কোটি টাকার উপরে পকেটস্থ করেছেন হাইওয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা। ভুক্তভোগী সিএনজি মালিকরা জানান, চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারলে সার্জেন্ট শফিক চালকদের মারধর ও গালমন্দ করেন। সুত্রে জানা যায়, গত ৯ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের মনসা বাদামতল এলাকায় বাস ও সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়। চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের এলাকাটি মুলত নিয়ন্ত্রন করে পটিয়া শিকলবাহা ক্রসিং হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি। এ দুর্ঘটনার পর প্রশাসনের পর মহল থেকে সরকারী আদেশ বাস্তবায়নের কঠোর নির্দেশনা এলেই বেশি আয়ের সুযোগ নেন আইসি শফিক।
জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়ক, গ্রামীনসড়ক ও মহাসড়কে প্রায় ৪ হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। তম্মধ্যে প্রতিদিন শত শত সিএনজি অটোরিকশা জ্বালানী গ্যাস নিতে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থিত সিএনজি রিফুয়েলিং ষ্টেশনে আসতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে কর্নফুলী থানার মইজ্জার টেকে অবস্থিত কয়েকটি রিফুয়েলিং ষ্টেশনে তাদের আসতে হয়। কারন এ এলাকা ছাড়া আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, পটিয়া, বোয়ালখালী, লোহাগাড়া উপজেলার কোথাও কোন সিএনজি রিফুয়েলিং ষ্টেশন নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামীন জনপদের অত্যন্ত জনপ্রিয় বাহন সিএনজি অটোরিকশাগুলো মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থিত রিফুয়েলিং ষ্টেশনে না আসলে জ্বালানী সংগ্রহ করবে কি ভাবে।

হাজার হাজার যানবাহনের জ্বালানী সংগ্রহের বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করা সম্পুর্ন অযৌক্তিক এবং হাস্যকর বটে। আর জ্বালানী সংগ্রহের জন্য সিএনজি অটোরিকশাগুলো এলেই সার্জেন্ট শফিকের মত লাইসেন্সধারী চাঁদাবাজদের দৌরাত্ব্য বাড়ে। তার অপকর্মে সহায়তা করেন হাইওয়ে পুলিশ চট্টগ্রাম জোনের সহকারী কমিশনার (এএসপি) গোলাম মোহাম্মদ। যে কারনে সিনিয়র কর্মকর্তাসহ ওসিকে তোয়াক্কা করেন না এ পুলিশ সার্জেন্ট। আনোয়ারা এলাকার সাইফুল নামের এক অটোরিকশা মালিক অভিযোগ করে বলেন, গত শনিবার আমার গাড়ি আটকিয়ে ৮ হাজার টাকা নিয়েছে। এক হাজার টাকা কম দিতে চাইলে সার্জেন্ট শফিক রাজী হয়নি। কর্নফুলী থানা কৃষকলীগের সভাপতি হারুন অভিযোগ করে বলেন, ’অটোরিকশা প্রতি টোকেন দিয়ে ৮ হাজার থেকে শুরু করে ১২/১৪ হাজার টাকা করে নিচ্ছে শিকলবাহা ক্রসিং ফাঁড়ির আইসি শফিক। হাইওয়ে পুলিশের এএসপিও এ টাকার ভাগ নেন।

সরকারী আদেশকে হাতিয়ার বানিয়ে সে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পুলিশের দৌরাত্বের কাছে সিএনজি অটোরিকশা চালক ও মালিকরা মুলত অসহায়। তবে হাইওয়ে পুলিশ চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার গোলাম মোহাম্মদ বলেন, ’পটিয়া শিকলবাহা ফাঁড়ির সার্জেন্ট টাকার বিনিময়ে কোন অটোরিকশা ছাড়েন না। সব অভিযোগ মিথ্যা।’ তবে হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রেঞ্জের এসপি রেজাউল করিম বলেন,’নানা সময়ে আমরা ফাঁড়ির আইসিকে চার্জ করি। তারপরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এদিকে অভিযোগ উঠেছে পটিয়া থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। এই থানার দারোগা মোহাম্মদ আলী, এএসআই করিম ও কনষ্টেবল গঠন করেছে পুলিশের থ্রি ষ্টার সিন্ডিকেট। গত ২ মাসে এই সিন্ডিকেটের মুল নায়ক দারোগা মোহাম্মদ আলী কয়েক লক্ষ টাকা সিএনজি মালিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। যাত্রী বা চালক প্রতিবাদ করলেই দারোগা মোহাম্মদ আলী বলেন, ’হ্যান্ডকাপ পরাও।

গত সপ্তাহে পটিয়া খরনা রাস্তার মাথায় দেখা গেছে, শুধু চালক নয়, যাত্রীদেরও নাজেহাল ও অশ্রাব্য ভাষায় তিনি গালাগাল করছেন। এ ব্যাপারে পটিয়া থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,’ আমার পুলিশ চাঁদাবাজি করছে না। প্রমান করতে পারলে তাকে বদলী করে দেব’। এভাবে পুলিশ ফ্রি ষ্টাইলে চাঁদাবাজি করলেও অস্বীকার করেন তার উদ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা। গত ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় পটিয়াতে আমার এক সহকর্মী যাত্রীবেশে পুলিশের চাঁদাবাজি প্রত্যক্ষ করেছেন। যাত্রীদেরও নানাভাবে নাজেহাল করার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে তিনি বলেন,’ সিএনজি চালকদের মামলা ও গাড়ি জব্দের অজুহাতে আদায় করছে হাজার হাজার টাকা। পুলিশের এই আচরনে ক্ষোভ প্রকাশ করছে যাত্রীগন। সরকারের সিএনজি চলাচলের নিষেধাজ্ঞা হাইওয়েতে থাকার সুত্র ধরে পুলিশের রমরমা বানিজ্যে দারোগা মোহাম্মদ আলীরা এখন কোটিপতি। এভাবে চলছে পুলিশের কোটিটাকার বানিজ্য। আর মহাসড়ক কোনটি আর অভ্যন্তরীন সড়ক কোনটি তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।

পুলিশ যেখানে সিএনজি অটোরিকশা দেখছে, সেখানেই মহাসড়ক দাবী করছে। মানুষ সিএনজি রাস্তায় দেখলে তাতে চড়বে স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু পুলিশ চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে আদায় করছে টাকা। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের জরিমানার রসিদে জরিমানার টাকার কোন অংক নেই। যার ফলে যার থেকে যতবেশি আদায় করা যায়, তাই আদায় করছে পুলিশ। এমনকি দর কষাকষিও করে। বিচার বিবেচনাহীনভাবে সরকারী আদেশ জারী ও পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চালক-মালিকরা।

দক্ষিন চট্টগ্রামের ৪ সিএনজি যদি মহাসড়কে এসে জ্বালানী নিতে না পারে, তবে লোহার জঞ্জালে পরিনত হবে বাহনগুলো। চলমান বাজার মুল্যে যার দাম দাড়ায় ১৮শত কোটি টাকা। মানুষের এ টাকার কি কোন মুল্য নেই?

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.