আলুর রোগ ও প্রতিকার

0

কৃষি সংবাদ :  ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান

উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র
ঈশ্বরদী, পাবনা

আলু বিশ্বের অন্যতম প্রধান ফসল। উৎপাদনের দিক দিয়ে খাদ্য ফসল সমূহের মধ্যে আলুর স্থান চতুর্খ। বাংলাদেশে ধান ও গমের পরেই আলুর স্থান। দেশের সর্বত্রই আলুর চাষ হয়। ইহা তরকারী, ভাজি, ভর্তা, ডাল, চপ, চিপস ইত্যাদি তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া ভাতের বদলে আলু খেয়েও ভাতের উপরে চাপ কমানো সম্ভব। আলুতে প্রচুর পরিমান শর্করা বিদ্যমান। কিন্তু আলু উৎপাদনে রোগ বালাই একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। এই রোগসমূহ নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারলে ফলন অনেক বৃদ্ধি পাবে। তাই নিুে আলুর কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষন, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

১। রোগের নাম: আলুর মড়ক বা নাবী ধ্বসা (Late blight)

রোগের কারণ: ফাইটপথোরা ইনফেস্ট্যান্স (Phytophthora infestans) নামক ছত্রাক

রোগের লক্ষন: নাবী ধ্বসা রোগ গাছের পাতা, কান্ড ও টিউবারে আক্রমন ঘটায়। প্রথমে পাতার আগায় ও কিনারায় ছোট ছোট আঁকবাঁকা পানিভেজা দাগ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে দাগগুলো বাদামী রং ধারন করে এবং পরে কালো রং ধারণ করে। অনুকুল আবহাওয়ায় দাগগুলো দ্রুত বাড়ে ও সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক দিনের মধ্যে পাতা মরে যায় ও পাতার নীচে গোলাকার সাদাটে পাউডারের মত অসংখ্য রোগজীবানু লেগে থাকতে দেখা যায়। পাতা থেকে ক্রমান্বয়ে রোগ বোটা ও কান্ডে বিস্তার লাভ করে। কান্ডে ও বোটায় হালকা বাদামী বর্ণের দাগ পড়ে। পরবর্তীতে এগুলো বৃদ্ধি পেয়ে কান্ড ও বোটার চারিদিকে ঘিরে ফেলে। নিু তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্র আবহাওয়ায় সমস্ত গাছ কালো হয়ে দ্রুত ঢলে পড়ে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে মাঠের সমস্ত গাছ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

পাতা ও কান্ড নষ্ট হওয়ার পর মাটির নীচের গোল আলুগুলো রোগজীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত আলুর চামড়ায় হালকা থেকে গাঢ় বাদামী রংয়ের দাগ পড়ে। আলুর খোসার নীচে প্রথমে মরিচা রংয়ের ছোট ছোট দাগ দেখা দেয়। ঐ দাগ ক্রমশঃ অসমানভাবে আলুর ভিতর শ্বেতসারের দিকে বি¯তৃত হতে থাকে। ফলে আক্রান্তস্থান সংকুচিত হয়ে যায় এবং ভিতরের সংকোচন খোসার উপরে ফুটে উঠে। এই পঁচা অংশ বাদামী রং ধারণ করে ও নরম না হয়ে শুকে যায়, এজন্য একে শুকনা পঁচা বলা হয়।

প্রতিকার:

নিম্নতাপমাত্রা, উচ্চ আর্দ্রতা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার নাবী ধ্বসা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী হয। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য নিুের যে কোন একটি পদ্বতি অবলম্বন করতে হবে।
১) ফসল উঠার পর জমির আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশসমূহ একত্র করে পুড়ে ফেলতে হবে।
২) শুকনা আলু রোগমুক্ত এলাকা হতে বীজের জন্য সংগ্রহ করতে হবে।
৩) গাছের গোড়ার মাটি উচু করে দিলে মাটির নীচে আলুকে রোগজীবানু আক্রমন করতে পারে না।
৪) আলু ও টমেটো গাছ পাশাপাশি লাগান উচিৎ নয় এবং আলু ও টমেটো ছাড়া জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
৫) রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে।
৬) বৃষ্টির পর বা মাটি ভিজা অবস্থায় কখনও আলু উঠানো উচিৎ নয়।
৭) হিমাগার বা ষ্টোরে আলু রাখার আগে রোগমুক্ত আলু বাছাই করে সেগুলো রাখতে হবে।
৮) রোগ দেখা দিলে জমিতে সেচ দেয়া উচিৎ না।
৯) রাসায়নিক দমনঃ নিম্ন তাপমাত্রা, উচ্চ আর্দ্রতা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার নাবী ধ্বসা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী হয। মেলোডি ডিউ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ও সিকিউর প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে একত্রে মিশিয়ে গাছের পাতার উপরে ও নীচে ভিজিয়ে ৭ দিন পর পর কমপক্ষে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।

২। রোগের নাম: আগাম ধ্বসা (Early blight)

রোগের কারণ: অলটারনারিয়া সোলানী (Alternaria solani) নামক ছত্রাক

রোগের লক্ষন: এই রোগের লক্ষন পাতায় দেখা দেয় এবং সাধারনতঃ নীচের পাতা প্রথম আক্রান্ত হয়। পাতার উপর প্রথমে অসম গোলাকার বাদামী রংয়ের দাগ পড়ে এবং পবে দাগগুলো কালো হয়ে যায়। দাগের মধ্যে পেঁচানো রিং দেখা যায়। প্রায়শঃই দাগগুলো একত্রিত হয়ে পাতার একটা বড় অংশ দখল করে, ফলে পাতা ঝলসে যায়। রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলে সমস্ত পাতাই ঝলসে যায়। আক্রান্ত স্থান শুকিয়ে যায় কিšত্ত পঁচে না ও সহজে ভাংগে না। এই ধরণের দাগ কান্ড ও পাতার বোটাতেও হতে পারে। পাতা ও কান্ড হতে এ রোগ আলুতে ছড়ায়। এ রোগের জন্য গাছে আলুর আকার ছোট হয়ে যায় এবং শস্যের ফলন অনেক কমে যায়। আক্রান্ত আলু ষ্টোরে থাকলে এ রোগ অন্য আলুতে ছড়ায় ও অন্যান্য আলুর পচন ঘটায়।

প্রতিকার :

১) সুস্থ গাছ হতে সংগৃহীত আলু বীজ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
২) আলু ও টমেটো গাছ পাশাপাশি লাগান উচিৎ নয় এবং আলু ও টমেটো ছাড়া জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
৩) ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ ও আগাছা একত্রিত করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
৪) পাতায় ২/১ টি দাগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোভরাল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হিসাবে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ¯েপ্র করতে হবে।
৫) আলু বীজ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য ষ্টোর করার পূর্বে উপরিক্ত ছত্রাক নাশকের দ্রবনে আলু ডুবিয়ে শুকিয়ে নিয়ে ষ্টোর বা হিমাগারে রাখতে হবে।

৩। রোগের নাম: শুকনা পঁচা (Dry rot)

রোগের কারণ: ফিউজারিয়াম কেরুলিয়াম (Fusarium caerulium) নামক ছত্রাক

রোগের লক্ষন: ছত্রাক সাধারনত ক্ষতস্থানের মধ্যে দিয়ে আলুর মধ্যে ঢুকে। আলুর আক্রান্ত অংশের খোসা একটু ডেবে যায় এবং ইহা গাঢ় রং ধারণ করে। তারপর ধীরে ধীরে আক্রান্ত অংশের খোসায় চক্রাকারে কুঞ্চন দেখা দেয়। রোগ বিস্তারের সংগে সংগে ভিতরের তন্তু শুকিয়ে যেতে থাকে এবং আলু কুঁচকে যায়। শুকনো অংশ শক্ত মনে হয়। কুঁচকানো অংশে অনেক সময় ছক্রাক সাদা তুলার ন্যায় মাইসেলিয়াম উৎপন্ন করে।

প্রতিকার:

১) শিকড় গিট কৃমি দমন করতে হবে কারণ ইহারা ছত্রাকের অনুপ্রবেশে সাহায্য করে।
২) আলু তোলার সময় যাতে ক্ষত না হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে, কারণ ছত্রাক ক্ষতস্থানের মধ্যে দিয়ে আলুর মধ্যে ঢুকে।
৩) আলু উঠানোর পর উপরের খোসা শক্ত হওয়ার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করে উহা ষ্টোর বা হিমাগারে রাখতে হবে।

৪। রোগের নাম: সাধারণ দাঁদ বা মামড়ি (Common scab)

রোগের কারণ: ষ্ট্রেপটোমাইসিস স্ক্যাবিস (Streptomyces scabies) নামক ব্যাকটেরিয়া

রোগের লক্ষন: স্ক্যাব রোগ শুধুমাত্র আলুতেই হয় । প্রথমে আলুর উপর ছোট ছোট বাদামী রংয়ের দাগ পড়ে। এই দাগ দ্রুত বেড়ে আলুর খোসাকে খসখসে করে ফেলে। অনেক গুলো দাগ যখন একত্রে বাড়তে থাকে তখন আলুর উপরিভাগটা খুবই খসখসে হয়ে যায়। আক্রান্ত আলুর চেহারা বিশ্রী হয়ে যায়। ইহার ফলে আলু বাজারে অনেক কম দামে বিক্রয় হয়।

প্রতিকার:

১) বীজ আলু রোগমুক্ত হতে হবে।
২) আক্রান্ত জমিতে সার দেয়ার প্রয়োজন হলে অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহার করতে হবে।
৩) রোগ প্রতিরোধী আলুর জাত চাষ করতে হবে।

৫। রোগের নাম: ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া (Bacterial wilt)

রোগের কারণ: রাল্সটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম (Ralstonia solanacearum) নামক ব্যাকটেরিয়া

রোগের লক্ষন: প্রথমে গাছের দুই একটি পাতা ঢলে পড়ে এবং ক্রমান্বয়ে সমস্ত গাছ ঢলে পড়ে। গাছ খুব দ্রুত ঢলে পড়ে, পাতা সাধারনত হলুদ হয় না। কান্ড কাটলে ভাসকুলার অংশে কিছুটা বাদামী রং দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের গোাড়ার কান্ড কেটে পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে কিছুক্ষন পর সুতার মত ব্যাটেরিয়াল উজ বের হয়ে আসে। এই পরীক্ষা আক্রান্ত আলুতেও করা যায়। আক্রান্ত আলুর চোখে বাদামী রংয়ের রস বের হয়। চোখে মাটি লেগে থাকতে দেখা যায় এবং চোখ কালো হয়ে যায়। আলু কাটলেও ভাসকুলার এলাকা বাদামী থেকে লালচে রংয়ের বলয় দেখা যায়। কিছুক্ষন রেখে দিলে শিশিরের মত হলুদ সাদা রস বের হয়।

প্রতিকার:

১) সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২) গ্রীষ্মকালে কয়েকবার জমি চাষ করে প্রখর রৌদ্রে মাটি শুকিয়ে নিতে হবে যাতে মাটিতে অবস্থিত রোগ জীবানু কমে যায়।
৩) আলু ও টমেটো ছাড়া জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
৪) বীজ কেটে লাগানো যাবে না।
৫) আগাম আলু লাগাতে হবে এবং আগাম আলু উঠাতে হবে।
৬) জমি আর্দ্র রাখা যাবে না।
৭) আলু লাগানোর পূর্বে জমিতে হেক্টর প্রতি ২০-২৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে।
৮) ২০ পিপিএম স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট (অক্সিটেট্রাসাইক্লিন) ৪-৭ দিন পর পর ¯েপ্র করতে হবে।

৬। রোগের নাম: পাতা গুটানো (Leaf roll)

রোগের কারণ: ভাইরাস (Virus)

রোগের লক্ষন: আক্রান্ত গাছের পাতার অনুফলক মধ্যশিরা নীচে রেখে কিনারা হতে লম্বালম্বিভাবে উপরের দিকে গুটিয়ে আসতে থাকে। এই অনুফলক মোটা, শক্ত অথচ চামড়ার মত মনে হয় এবং গাছে উহা আড়াআড়িভাবে থাকতে দেখা যায়। পাতা হাত দ্বারা একটু ঘসা দিলেই ইহা ভেংগে পড়ে। আক্রান্ত বীজ হতে উৎপন্ন চারার পর্বমধ্য ছোট হয়ে যায়, ফলে গাছ খর্বাকৃতি হয়। অনেক সময় আক্রান্ত পাতার আগা ও ধার লালচে অথবা পিঙ্গল বর্ণের হয়। রোগের ফলে আলু ছোট হয় এবং ফলন অনেক কমে যায়। আলু ছোট হওয়ায় বাজারমূল্য কমে যায়।

প্রতিকার:

১) আলুর বীজ রোগমুক্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
২) ছোট সাইজের আলু বীজ হিসাবে ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
৩) রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে।
৪) জাবপোকা (Myzus persicae) দ্বারা এই রোগ ছড়ায় তাই ম্যালাথিয়ন জাতীয় ঔষধ প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার হিসাবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

৭। রোগের নাম: কালো শ্বেতসার (Black heart)

রোগের কারণ: শারীরবৃত্তীয় কারণ (Physiological disorder)

রোগের লক্ষন: এই রোগটি সাধারনত ষ্টোরে হয়ে থাকে। অত্যধিক তাপমাত্রা ও বায়ুর স্বল্পতার কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে। সাধারনত এক স্থানে অনেক আলু গাদা করে সংরক্ষন করলে এই রোগ হয়। উচ্চ তাপমাত্রার কারনে আলুর তন্তুগুলো ভাংগতে থাকে ফলে শ্বসন বেড়ে যায় কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন সরবরাহ না পাওয়ার কারণে আলুর মাঝখানে প্রথমে গোলাপী, তারপর গাঢ় বাদামী থেকে কালো রং ধারণ করে। ফলে আলু খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

প্রতিকার:

১) আলু স্তুপের উচ্চতা কমাতে হবে।
২) ষ্টোরে যাতে বাতাস ঢুকতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.