জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জেলেরা, চলছে নীরব দূর্ভীক্ষ

0

জামাল জাহেদ, কক্সবাজারঃ বর্ষাকালে থেমে থেমে বৃষ্টি যেভাবে হয় ঠিক সেভাবে দিনের পর দিন,মাসের পর মাস বছরের পর বছর কক্সবাজার সমুদ্র উপকুলে ডাকাতি করে যাচ্ছে। চট্রগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের কক্সবাজার জেলার দেড় লক্ষাধিক জেলেদের উপর্যুপরি ডাকাতি করে স্বর্বস ছিনিয়ে জলদস্যুরা ফেরত পাঠাচ্ছে জেলেদের। হয়তো লাশ, নয়তো কাটা শরীরের ছিন্নভিন্ন শরীরের অংশবিশেষ।উপকুলীয় সমুদ্রসীমানার নৌপ্রশাসন সম্পুর্ণ নীরব,ফলে জলদস্যু ডাকাতের মুঠোয় জিম্মি হয়ে আছেন কক্সবাজারের ৫৬হাজার জেলে পরিবার।

বর্তমানে জেলেরা নিরুপায় হয়ে নীরব দুর্ভীক্ষ বুকে নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় জেলার ৪টি আসনের মাননীয় চার সংসদ সদস্যকে।বর্তমান সরকাররে উচ্ছ পর্যায়ে দলমত নির্বিশেষে জেলার মৎস্য সম্পদকে বাচাতে জোর তদবির করার আবেদন জানান জেলেরা।কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণ সাগরের বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমার বঙ্গোপসাগরজুড়ে হাজার হাজার মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকা জলদস্যুদের আক্রমণে শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অপহৃত ও খুন হচ্ছে শতাধিক জেলে, অনেকের ফিরে আসতে হয় বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে।

জলদস্যুদের পাশাপাশি নতুন করে বড় আতঙ্ক হয়ে দাড়িয়েছে ভারতীয় জেলেরা। তারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে ফিশ ফাইন্ডার মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ শিকার করছে।যে মেশিন ব্যবহারে জানা যায়,সমুদ্রের কোন জায়গায় কি মাছ রয়েছে,তার ছবিসহ মনিটরে তোলে সহজে শিকার করে নিচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ কক্সবাজারের জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তারা জলদস্যু নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালন নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।বিষফোড়া হয়ে দাড়িয়েছে কুলে থাকা কোস্টগার্ড, সাগরে অচল জাহাজে নৌ বাহিনীর নোঙ্গর করা দর্শক সসমতুল্য জাহাজ,থেকেও কোন কাজে আসছেনা অথচ জেলেদের দাবি নৌ বাহিনী চাইলেই সাগরে ১০মিনিটে জলদস্যুতা বন্ধ করতে পারে।কিন্তু কেন সচল নয় তা তাদের বোধগম্য নয়।

কক্সবাজার জুড়ে জেলার মহেশখালী,কুতুবদিয়া,উখিয়া,চকরিয়া,রামু,টেকনাফ,খুরুশকুল, রামু,ইনানী হিমছড়ি সহ সদর উপজেলা জুড়ে তথ্যমতে অনিবন্ধীত সহ দেড় লক্ষাধিক জেলে রয়েছেন।যাদের মাছ শিকারই একমাত্র রুজি রোজগারের মাধ্যম। ভারতের শিকারে মৎস্য নিধন,জলবায়ুর প্রভাব, নাব্যতা হ্রাস,প্রাকৃতিক দুর্যোগ,ও পরিবেশ দূষনের কারণে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ইলিশের আকাল চলছে। তার ওপর বঙ্গোপসাগরজুড়ে জলদস্যুদের দাপটে অসহায় জেলার জেলেরা। প্রতিবছর বিভিন্ন এলাকায় সাপ্তাহিক বা মাসিক চাঁদা দিয়ে জলদস্যুদের কাছ থেকে টোকেন সংগ্রহ করতে হয় জেলেদের।যার বেশির ভাগ জলদস্যু চিন্হিত হন বাশখালী,কুতুবদিয়া,মহেশখালীর কালামারছড়া,সোনাদিয়া,উখিয়া,ভোলা সন্দীপ সহ পটুয়াখালী। কোন কোন জেলেরা টোকেন করেও রক্ষা পান না।কারণ প্রতিটি এলাকায় জলদস্যুদের একাধিক গ্রুপ থাকায় নিয়মিত হামলার শিকার হতে হচ্ছে জেলেদের। মৌসুমজুড়ে এসব এলাকায় লক্ষাধিক জেলে ট্রলার ও নৌকা ডাকাতির শিকার হয়। অপহৃত হন অগণিত জেলে। প্রাণহানি ঘটে ৫বছরে ২শতাধিক,বার বার সরকারের চোখে দিলে ও উপযুক্ত কোন পদক্ষেপ না নেওয়াতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জলদস্যুরা।

যদিও জলদস্যু নির্মূলে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টসুত্রে জানা যায়।সম্প্রতি সুন্দরবন এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রেবের হাতে ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছেন অনেক জেলে। গতবছর ভোলার মনপুরায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় এক জেলেসহ ১০ জলদস্যু। গত সপ্তাহে ভোলার তজুমদ্দিনে গণপিটুনিতে নিহত হয় ৪ জলদস্যু। এর পরেও থেমে নেই জলদস্যুদের তান্ডব।সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন বাহিনী গহীন সাগরে ও বনে অভিযান পরিচালনা করলেও কোন অদৃশ্য খুটির কারনে সোনাদিয়ার চরে অভিযান পরিচালনা হচ্ছেনা তা খতিয়ে দেখার বিষয় বলে জানিয়েছেন মাননীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি।জলদস্যু প্রতিরোধে কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মতৎপরতা যথেষ্ট নয় বলে দাবি অনেকের।

অন্যদিকে ভৌগোলিক কারনে কক্সবাজারের দক্ষিনে সাগর আর সাগর।সাগরে মাছ আহরন করার অপার সম্ভাবনা থাকার সে সুযোগে মাছ শিকার করে জীবনধারণ করেন কক্সবাজারের নিবন্ধন ও অনিবন্ধনকৃত প্রায় দেড় লক্ষাধিক জেলে। কিন্তু জলদস্যুদের তাণ্ডবে বর্তমানে ভীত ও অসহায় তারা। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে জেলেদের সবকিছু লুটপাট নির্যাতন ও ট্রলার ও মাঝি জিম্মি করে চাঁদা দাবির ঘটনায় পুরা শহরে জেলেদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। যথাযথ প্রহরা না থাকায় মাঝিমাল্লা ও জেলেদের জিম্মি করে জলদস্যুবাহিনীরা।অনেকে জলদস্যুদের অত্যাচার-শোষণ নীরবে সহ্য করছে আবার অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

অনেকে ডাকাতের কবলের ভয়ে সাগর পথে মালেয়েশিয়া যাচ্ছে সাগর পথে।কক্সবাজার জেলার মৎস্য অফিসসুত্রে,কক্সবাজারের মৎস্য পল্টন ইলিশ, লালা পোহা,কালো পোহা,চুরিমাছ,লইট্টা,চিংড়ি,রুপচান্দা,মুচমাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত বিধায় প্রতি বছর কক্সবাজার জেলা থেকে দেশে ও বিদেশে এসব মাছ রফতানি করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। জেলেরা জীববন জীবিকার দায়ে উত্তাল সাগরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করলেও প্রতিনিয়ত জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করেছেন। আবার অনেক জেলে জলদস্যুদের আক্রমণের নির্যাতন সইতে না পেরে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন।বর্তমানে সোনাদিয়া,বাশাখালী,ধলঘাটা,উখিয়া,কালামারছড়া,হোয়ানক,মাতারবাড়ি,কুতুবদিয়ার প্রায় ১৯টি সন্ত্রাসী বাহিনী,সাগর দখলে রেখেছে বলে বিশেষ সুত্রে জানা যায়।তবে সোনাদিয়ার বাহিরে বেশির ভাগ ডাকাতি সংঘঠিত হওয়াতে সোনাদিয়ার বাহিনীর হাত রয়েছে বলে জানা যায়,যদিও সোনাদিয়ায় নিত্য নতুন জলদস্যু গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।কথিত জলদস্যুরা সোনাদিয়ার বাহিরের সাগর নিয়ন্ত্রণ করে। পুলিশের ক্রসফায়ারে জাম্বু ডাকাত নিষ্ক্রয় হলেও মোনাফ ও আনজু গ্রুপ তান্ডব চালাচ্ছে বলে বোটের মাঝিদের তথ্যে জানা যায়। এ নিয়ে সাম্প্রতিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পরও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ার জেলার বোট মালিক সমিতি আন্দোলনে যাবার প্রস্কুতিপ্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে নিশ্চিত করেন পৌর আঃলীগের সভাপতি মুজিব চেয়ারম্যান।

নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সাগরে কয়েকবার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন,সোনাদিয়ার লুতু মিয়া।এভাবেই জেলেদের রক্ত শোষণ করতে পালাবদলে জন্ম নেয় একেকটি জলদস্যুবাহিনী। আর এদের নির্মূল করতে প্রশাসনের নেই তেমন কোনো কঠোর ভূমিকা। পুলিশ কিংবা কোস্টগার্ডের জলদস্যু দমনে কোনো বড় সাফল্যও।যার প্রেক্ষিতে কক্সবাজার জেলার ৪টি আসনের মাননীয় সংসদ সদস্যের,কক্সবাজার বৃহত্তম স্বার্থে জলদস্যু দমনে এক হয়ে কাজ করার জোর আবেদন জানান হাজার হাজার জেলেরা।

দস্যু কতৃক অপহৃত মাঝিমাল্লা ও নৌকা ও জাল ছাড়িয়ে আনতে দিতে হয়েছে নৌকাপ্রতি ১ লাখ টাকা। মাঝিপ্রতি ২লাখ বিকাশে নেয়,ফলে অনেক জেলে এখন পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। যদিও বিকাশে টাকা নেয় কিন্তু উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমানে যুগে সে সব সিমের লোকেশন বা টাকা ব্লক করার বিষয়টি চিন্তা করারও বিষয় রয়েছে বলে জানান অনেক শিক্ষিত ছেলেরা।

এ ব্যাপারে ককসবাজার জেলার পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার দত্ত সাংবাদিকদের জানান, কক্সবাজার উপকূলের জলসীমায় জলদস্যু নির্মূলে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।কোস্টগার্ড কর্মকর্তা মোঃ আকতার হোসেনের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে কথা বলতে অস্বীকার করেন,তবে নাম প্রকাশ না করা আরেক সদস্য সাংবাদিকদের জানান, জলদস্যু নির্মূলে কোস্টগার্ড সদা সচেষ্ট রয়েছে। কয়েক দিন আগেও জলদস্যুদের সঙ্গে কোস্টগার্ডের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং সেখান থেকে অপহৃত ২জেলেদের উদ্ধার করাসহ দস্যুদের ডাকাতি করা বেশকিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এছাড়া কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল চলছে।

কক্সবাজার ফিশারী ঘাটের ব্যবসায়ী হারুন জানায়,তারা প্রয়োজনে আন্দোলন করবে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেন নৌ বাহিনী সাগরে পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। জলদস্যুদের পাশাপাশি বাংলাদেশি সীমান্তে ভারতীয় জেলেদের তাণ্ডবে এদেশের জেলেরা অসহায়। এর আগেও তারা চুপিসারে এসে মাছ শিকার করত। কিন্তু গত ২-৩ বছর ভারতীয় জেলেরা ঝাঁক বেঁধে বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে ফিশ ফাইন্ডার মেশিন দিয়ে মাছ শিককার করে নিয়ে যাচ্ছে।আবার অনেকে যে এলাকায় অধিক মাছ, সেখানে জাল ফেলে ওইসব এলাকা থেকে বাংলাদেশী জেলেদের তাড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদীদের ওপর নানা নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে।অথচ বাংলাদেশিরা ভারত সাগরে প্রবেশ করলেই বন্দি করে নিয়ে যায়।
এসব অভিযোগের সঙ্গে এক মত পোষণ করে কক্সবাজার বোট মালিক সমিতির সাঃ সম্পাদক মুজিব চেয়ারম্যান বলেন, ভারতীয় জেলেরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে মাছ শিকার করলেও অজ্ঞাত কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

জলদস্যুদের তাণ্ডব নিয়ে তিনি বলেন,সাগরে জলদস্যুদের তাণ্ডবে শহরের হাজার হাজার জেলে অসহায়। প্রতিনিয়ত সর্বস্ব হারাচ্ছে,মারা যাচ্ছে দস্যুদের গুলিতে।দিতে হচ্ছে মোটা অংকের মুক্তিপণ।তিনি জানান, জলদস্যুর প্রতিবাদে প্রতি বছর নানা অান্দোলন-সংগ্রাম করেও বন্ধ হয়নি জলদস্যু ও ভারতীয় জেলেদের তাণ্ডব।কক্সবাজারের দেড় লক্ষাধিক জেলেদের নিরাপত্তার দাবি জানান তিনি।সব শেষে এ বিষয়ে,কক্সবাজারের চকরিয়া পেকুয়া আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ ইলিয়াছ সাথে কথা হলে তিনি বলেন,গত মাসে জেলার আইন শৃঙ্খলা মিটিং এ জলদস্যু বিষয়ে প্রশাসনকে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছেন সকলে,কিন্তু এখনো অভিযান পরিচালনা হচ্ছেনা তা দেখতেছি আগামী মাসের মিটিং এ আবারো তুলবেন বলে জানান তিনি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.