চট্রগ্রামে গ্যাস সংকটে কমছে বিনিয়োগ

0

অর্থবাণিজ্য ডেস্ক :: দেশের বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে ২০১০ সালে নতুন করে নিবন্ধিত ২৯৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১০৬ কোটি চার লাখ টাকা। চলতি বছরে ১২১টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে মাত্র এক হাজার ৩৩৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত ৬ বছর ব্যবধানে চট্টগ্রামে বিনিয়োগ কমেছে ৫৭ শতাংশ। সেই সঙ্গে কমেছে বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থানও।

২০১০ সালে চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই বিনিয়োগ খরায় পড়ে চট্টগ্রাম। বর্তমানে চাহিদার অর্ধেক গ্যাসও সরবরাহ করতে পারছে না কেজিডিসিএল। গ্যাস সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উচ্চ ব্যাংক ঋণ এবং অবকাঠামোগত দূর্বলতার বিষয়টি রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ২০১০ সালে দেশি, বিদেশি এবং যৌথভাবে বিনিয়োগে আসে ২৯৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে তিন হাজার ১০৬ কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার টাকা। নতুন করে কর্মসংস্থান হয় মোট ৩০ হাজার ৬৪৯ জনের। তারমধ্যে চারটি যৌথ শিল্প কারখানায় ৪৩ কোটি ৪২ লাখ ৬০ হাজার ও ৬টি বিদেশি শিল্প কারখানায় ১৫০ কোটি ১ হাজার টাকা বিনিয়োগ হয়। এরপর প্রতি বছরই নিবন্ধিত শিল্প এবং দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকে আশংকাজনক হারে। সেই সঙ্গে কমেছে কর্মস্থানও। ২০১০ সালের তুলনায় চলতি বছরে (জানুয়ারী থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত) নিবন্ধিত বিনিয়োগ ও কর্মস্থান কমে গেছে ৫৭ শতাংশের বেশি। ২০১৫ সালে দেশি, বিদেশি এবং যৌথ নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা হচ্ছে ১২১টি। যাতে বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে মাত্র এক হাজার ৩৩৪ কোটি ১৬ লাখ ৬ হাজার টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৯ হাজার ৩৪২ জনের। অর্থ্যাৎ গেল ৬ বছরে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৭৭২ কোটি ২৭ লাখ টাকা ও কর্মসংস্থান কমেছে ২১ হাজার ৩০৭ জনের। এছাড়া, চলতি বছরে একটি যৌথ ও দুইটি বিদেশি শিল্প নিবন্ধনের মাধ্যমে বিনিয়োগ হয় ৫১ কোটি ৯১ লাখ সাত হাজার টাকা। যা গত ৬ বছরের তুলনায় কমেছে ১৪১ কোটি ৫২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা বা ৭৩ শতাংশ।

চট্টগ্রামে শিল্প কারখানায় দৈনিক ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদা থাকলেও আমরা পাচ্ছি মাত্র ১৬০-১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট
এ বিষয়ে চিটাগং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রামে শিল্প কারখানায় দৈনিক ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদা থাকলেও আমরা পাচ্ছি মাত্র ১৬০-১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় অনেক কারখানা স্থাপনের পর চালু করা যাচ্ছে না। গ্যাস সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে- এমন শুনলেও বাস্তবে এর কোন সত্যতা দেখছি না। এমন পরিস্থিতিতে কেউ নতুন করে শিল্প-কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছে না। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে চট্টগ্রামের এ সংকটটি দ্রুত নিরসন করা উচিত।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) জানা যায়, চট্টগ্রামে আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তার মধ্যে তিন হাজার ৬৮৫টি শিল্প কারখানার চাহিদা দৈনিক ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের। অথচ প্রতিদিন গড়ে ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রীড থেকে যুক্ত হচ্ছে। যা চাহিদার অর্ধেকও কম। চট্টগ্রামের গ্যাসের চাহিদার সিংহ ভাগ যোগান দিয়ে আসা সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে চট্টগ্রামের গ্যাসের চাহিদার সিংহ ভাগ যোগা দিয়ে আসা সাঙ্গু ২০১০ সাল থেকে গ্যাস সরবরাহ হঠাৎ হ্রাস পেতে থাকে। যেখান থেকে ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দৈনিক ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতো, সেখানে ২০১৩ সালে এসে গ্যাস উত্তোলন স্থগিত ঘোষণা দেয় কেজিডিসিএল। তখন থেকেই গ্যাস সংকটে পরে চট্টগ্রাম। যদিও ২০১০ সালের দিকে আবার নতুন সম্ভাবনা জাগিয়েছিলো খাগড়াছড়ির সেমুতাং।সেখান থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবতার কথা জানা যায়। কিন্তু প্রথম থেকে সেখান দৈনিক ১৩ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা যায়নি। যা এখন কমে ৬ মিলিয়ন ঘনফুটে চলে এসেছে। যে কোনো সময় সেমুতাং থেকে গ্যাস ফুড়িয়ে যেতে পারে এমন আশংকা করছে কেজিডিসিএল।

কেজিডিসিএলর জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খন্দকার মতিউর রহমান বলেন, চট্টগ্রামের গ্যাসের চাহিদার অর্ধেকের বেশি উত্তোলন করা হতো সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে। সেটি ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প কোনো উৎস না পাওয়ায় এ সংকট সৃষ্টি হয়। গ্যাস সংকট নিরসনে জাতীয় গ্রিডের সাথে নতুন লাইন সংযোজন অথবা এলএনজি (তরলাকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ দুটি প্রকল্পই বাস্তবায়ন বেশ সময় ও অর্থ সাপেক্ষ বিষয়। এখন চাহিদা অনুসারে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহে সক্ষম এমন লাইন নতুন করে স্থাপন অনেক অর্থ ব্যয় হবে। ইতোপূর্বে নতুন লাইন স্থাপনের বিষয়ে সরকারি উচ্চ মহলে কয়েকবার আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়নে সময় ও অর্থ বিবেচনায় আটকে আছে। তাছাড়া, নতুন লাইন স্থাপনের বিকল্প হিসাবে সম্প্রতি বিদেশ থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানির বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এলএনজি আমদানি করার পূর্বে বঙ্গোপসাগরে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন

তথ্য মতে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামে দেশি, বিদেশি এবং যৌথভাবে বিনিয়োগে আসে ২৯৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ১০৬ কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ হয় এবং নতুন করে কর্মসংস্থান হয় ৩০ হাজার ৬৪৯ জনের। ২০১১ সালে মোট ২৫১টি নতুন প্রতিষ্ঠান দুই হাজার ৮৯৪ কোটি ২১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ করে। নতুন করে কর্মসংস্থান হয় ২৯ হাজার ৯২১ জনের। ২০১২ সালে ২২৮ শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ আসে দুই হাজার ২৫৮ কোটি ৭৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। নতুন করে কর্মসংস্থান হয় আরো ৩৩ হাজার ৩৫০ জনের। ২০১৩ সালে ১৫৬ নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান্ চট্টগ্রামে বিনিয়োগ করে দুই হাজার ৩৪৪কোটি ১৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা। নতুন কর্মসংস্থান হয় ১৬ হাজার ২৪ জনের । এর পরবর্তী বছর ২০১৪ সালে ১৪৮ টি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ আসে এক হাজার ৩০৪কোটি ১৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। কর্মসংস্থান হয় ১১ হাজার ৬২৯ জনের। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত দেশী, বিদেশী এবং যৌথ নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা হচ্ছে ১২১ টি। যাতে এক হাজার ৩৩৪ কোটি ১৬ লাখ ৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ হয় এবং কর্মসংস্থান হয় ৯ হাজার ৩৪২ জনের। অর্থ্যাৎ প্রতিবছরই নিবন্ধিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কমছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ।

চট্টগ্রাম বিনিয়োগ বোর্ডের পরিচালক মাহবুব কবীর জানান, ‘চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করার পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেইন ও বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। আশাকরি খুব শিগগির জ্বালানি সংকট নিরসন হয়ে যাবে এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বাড়বে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.