চট্টগ্রামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক এমপি’র জীবনের ট্র্যাজেডি

0

জুবায়ের সিদ্দিকী –  

অবহেলা আর অনাদর ও সুচিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে পরছেন ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া সংসদীয় আসনের ৮ দলীয় জোট থেকে কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউছুফ। রাঙ্গুনিয়া কলেজ সংলগ্ন পুর্ব সৈয়দ বাড়ির সন্তান ছাত্রজীবনে বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এর পর ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কোন লোভ ও প্রলোভন তাকে নীতিচ্যুত করতে পারেনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পাঠালে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

এই একমাত্র আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন যিনি শুল্কমুক্ত কোটায় গাড়ি নেননি। এমপি হয়েও তিনি রাঙ্গুনিয়া উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসতেন বাসে চড়ে! চালচলনে অতি সাধারন এই মানুষটি পায়ে হেঁটে তার নির্বাচনী এলাকায় পথে প্রান্তরে চষে বেড়াতেন। সকলের সুখেদু:খে পাশে থাকা এই সাবেক জনপ্রতিনিধি এখন রোগে শোকে দু:খের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। চিরকুমরা মোহাম্মদ ইউছুফ তার ছোটভাই সোলায়মানের আশ্রয়ে থেকে এখন কঠিন নিয়তির কাছে সমর্পিত। ক্ষমতায় থেকেও যিনি ক্যাডার লালন পালন, বিলাসী জীবন, ভোগ বিলাস, লুটপাট, দালালী, কমিশন বানিজ্য, দাপট দেখানো থেকে সম্পুর্ন বিরত ছিলেন সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ ইউছুফ। অভাবে থাকলেও কখনো তাকে মানুষের কাছে হাত পাততে দেখেনি কেউ।

নব্বই দশকের দিকে তাকে দেখেছি নগরীর চশমা হীলে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন শত ব্যস্ততার মাঝেও বসিয়ে রাখতেন পাশের চেয়ারে। একদিন ইউছুফ ভাইকে বললাম, ’আপনাকে দেখিনা অনেকদিন, কেমন আছেন? কিন্তু ইউছুফ ভাই উত্তর দেওয়ার আগেই মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, ’অডা ইউছুপ্যারে ডিষ্টাব ন’গরিস। এবা ভালা মানুষ। এমপি হইলেও আকাম কুকামত নাই। পকেটত মাল ন’থাইলেও মনোবল আছে।’’ এভাবে অনেক সময় এমপি থাকা অবস্থায় অনেকবার তার মুখোমুখি হয়েছি। আজকের সুর্যোদয়ে তার সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছি। এখন তিনি মৃত্যুর পথে এগুচ্ছেন।

তাকে দেখার যেন কেউ নেই পৃথিবীতে। অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ, সাহসী, নিষ্টাবান একজন এমপি আমি জীবনে আর দেখিনি। নব্বই দশকে তার গ্রামের বাড়িতে এমপি থাকা অবস্থায় দেখেছি বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনির ঘর। লুঙ্গির উপর সাদা পাঞ্জাবী পড়ে ঘর থেকে বের হয়ে বলেছিলেন,’ আপনি কি মোজাম্মেল ভাইয়ের পত্রিকায় কাজ করেন? আজকের সুর্যোদয়ের নিয়মিত পাঠক ছিলেন ইউছুফ। রাঙ্গুনিয়াতে যখন আওয়ামী লীগের বেহাল অবস্থা তখন তিনি মাঠে কাজ করেছেন। ধরে রেখেছেন দলের অবস্থান। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তাকে চেনেনও না। রাঙ্গুনিয়াতে অনেক বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ধর্নাট্য প্রবাসী ও রাজনীতিবিদ আছেন কিন্তু সাবেক এমপি মোহাম্মদ ইউছুফের চিকিৎসার জন্য কেউ এগিয়ে আসেননি। এমনকি তাকে দেখতে কেউ বাড়ির সীমানায়ও যান না। দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে শুয়ে বসে দিনযাপন করছেন তিনি। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাঙ্গুনিয়ার সন্তান আনিছুর রহমান চৌধুরী বলেন,’ ইউছুফ ভাই একজন সৎ ও নিষ্টাবান মানুষ।

তাকে দেখতে যাব। একান্নব্বই এর নির্বাচনে তার পক্ষে ধামাইরহাটে কাজ করেছি। ওমান প্রবাসী ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারন সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন,’ শুনেছি তিনি অসুস্থ। তাকে সাহায্য করা আমাদের উচিত। আপনি এমন একজন অসহায় মানুষকে নিয়ে লিখছেন। আপনাকে ধন্যবান। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আলী শাহ জানান, আমি এবং মাননীয় সাংসদ অনেকবার তাকে দেখতে গিয়েছি তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিআকর্ষন করে বলবো, রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় যাতে উনার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি শুধু একজন সাবেক সাংসদই নন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাঙ্গুনিয়ার সন্তান শেখ ফরিদ বলেন,’ তিনি একজন নিবেদিত প্রান। তিনি কখনো কারো কাছে বিক্রি হননি। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কান্ডারী সাবেক সাংসদ ইউছুফকে সরকারীভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা, ত্যাগী ও সৎ মানুষের জন্য বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত।

একাত্তরের রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউছুফ অর্থের অভাবে আজ সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। ১৯৯১ সালে সাকা চৌধুরীর ছোটভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের কে ব্যালটের মাধ্যমে পরাজিত করে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাথে বেঈমানি করে বিএনপির লোভনীয় প্রস্তাবেও তিনি যাননি। নীতি ও আদর্শকে সব সময় সমুন্নত রেখেছেন। এমপি থাকা অবস্থায় তিনি ইচ্ছে করলে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন। না, বর্তমান সময়ের এমপি মন্ত্রীদের মত টাকা ও বিলাসিতায় জীবনকে ভাসিয়ে দেননি। মানুষের সুখে দু:খে যে জীবন ছিল সদা জাগ্রত সে জীবন এখন নিভে যেতে বসেছে শুধু আর্থিক ও সহানুভুতির অভাবে। আজ এই অসহায় মানুষের পাশে কেউ নেই। অথচ দল ক্ষমতায়, কিন্তু দল বা সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে না। একাত্তরের দু:সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সাংসদ ইউছুফের সততা, ত্যাগ, শ্রম মেধা ও আদর্শ বর্তমান সময়ের কাছে রুপকথার কাহিনী।

যে সমাজে এমপি মন্ত্রীদের কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে উঠে। দাপট ও ক্ষমতার কাছে জনগন যখন অসহায় তখন একজন ইউছুফের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে হবে কাল্পনিক। অথচ এটাই ছিল বাস্তব। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট একটি কমিউনিটি সেন্টারে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পুর্বে দেখা হয়। সাথে ছিলেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অনুষ্টানটি ছিল মেজবানের। খাবার টেবিলেও আমার পাশে। সামনের সারিতে বসা মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন,’ওডা গোস্ত কম খাঁ, ইউছুপরে বেশি গরি দে! আমি তাই করেছিলাম। সাবেক এমপি ইউছুফকে খুব আদর ¯েœহ করতেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। অসহায় এই মানুষটি আজ যখন শুনি অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না, সময়মত খাবার জুটছে না। তখন নিজেকে অসহায় ও অপরাধী মনে হয়। যাদের ত্যাগে এই দেশের মাটি শত্রুমুক্ত হল, তাদের এই বেহাল কি জাতির জন্য দু:খজনক ও লজ্জাজনক নয়।

আজ সমাজে একাত্তরের রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মুল্যায়ন হচ্ছে না। এখনও শহরে, গ্রামে, গঞ্জে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অর্থের অভাবে কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ সদস্য ইউছুপের সুচিকিৎসা ও আর্থিক সমস্যা সমাধানে সরকার আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবেন বলে আমরা আশাবাদী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে অনেকে আজ কোটিপতি হয়েছেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে ফ্রি-ষ্টাইল চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। করছে ধান্ধাবাজি। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হচ্ছে উল্টো। এদের অনুষ্টানে অতিথি হয়ে যাচ্ছেন এমপি-মন্ত্রীরা। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজ বড় অবহেলিত। সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত ইউছুফের মত সৎ ও মহৎ ব্যক্তির সাহায্যে। দুষ্টচক্রের অবৈধ অর্থের দাপটের কাছে, পেশিশক্তির রাজনীতির ভীড়ে আমাদের নাসপটে এখনও উজ্জ্বল তারকা বীর মুক্তিযোদ্ধ্ াসাবেক সাংসদ ইউছুফরা। ওদের ত্যাগ ও দেশপ্রেম জাতির কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.