চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের রিপোর্ট কার্ড  

0

জুবায়ের সিদ্দিকী –  

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু ন্যাক্কারজনক ঘটনা হৃদয়কে রীতিমত নাড়া দিয়ে উঠে, আস্তে আস্তে প্রতিবাদের সুর যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলেও তা হয়ত করা যাবে না নীরবে সব কিছু বোবার মত চেয়ে থাকতে হবে। বোবা যেমন চেয়ে থাকে নিরবে কষ্টে কাঁদে তেমনি পরিস্তিতির উত্থান যেন আমাদের এই দেশে। কিছু মানুষের আন্দোলন দেখে অবাক হতে হয়। দেশের কোন খাতে এ ধরনের অন্যায় আন্দোলন দেখা যায়নি। রাজনীতিবিদ, শিক্ষকসমাজ, সংবাদকর্মী, মানবাদিকার কর্মী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা যে হোক অন্যায় করলে, ভুল করলে তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা বা আইনের আওতায় প্রচলিত নিয়মে আসছেন। চিকিৎসকদের একটা ভাল অবস্থান রয়েছে। মানুষ মাত্রেই ভুল। ভুল সবার হতে পারে। তার জন্য রয়েছে সংশোধন, অনুশোচনা, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি।

আইন সবার জন্য সমান। আইনের সঠিক প্রয়োগ সবাই চায়। যদি দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে তাহলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কেন নয়? তারা দোষ করলে কি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। সংগঠন মানেই কি ন্যায় অন্যায় তোয়াক্কা না করা, এভাবে যদি সংগঠনের ধারাকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করা হয় ত্হালে সংগঠনের মুলধারা কি হুমকির মুখে নয়? এই দেশ গনতন্ত্রের দেশ, এই দেশ অন্যায়কে অন্যায় বলার পথটি খোলা রাখুন, সাধারন জনতাকে যেন কেহ হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবেন না। এমন আদেশ আমাদের আদালতের এক আদেশেও বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, রোগীদের জিম্মি করার অধিকার চিকিৎসকদের সংগঠন সংরক্ষন করে না। চিকিৎসকদের অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলবে না এটি গোষ্টীগত দাম্ভিকতা।

গোষ্টীগত স্বার্থে অপরাধীকে আড়াল করা যাবে না। আদালত পর্যবেক্ষনে বলেন, এক দুইজন চিকিৎসদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সব চিকিৎসককে জনগনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া এবং বেসরকারী হাসপাতাল বন্ধ করা, চিকিৎসক পেশাকে লাঞ্চিত করার সামিল বলে প্রতিয়মান হয়। যা গ্রহনযোগ্য নয়। চিকিৎসকদের যে কোন মানুষ একটি বিচ্যুতির উদ্ধে নয়। পর্যবেক্ষনে বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা রাষ্ট্রীয় আইনের উদ্ধে নন। রোগীকে জিম্মি করে মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারকে অগ্রাহ্য করা রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের অনেকগুলো ধারায় বিচার্য অপরাধ। এই কাজের সঙ্গে সংখ্যায় যত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট থাকুক না কেন কিংবা বাদীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রকাশ্যে সমাবেশ করে হুমকি প্রদানকারীর যত বড় পরিচয় থাকুক না কেন, তারা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন অঙ্ঘনকারী অপরাধী। আদালতের পর্যবেক্ষনে বলা হয়েছে, বিচারক, এমপি, মন্ত্রী, আইনবিদ, পুলিশ সহ সব পেশার ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের আওতাধীন।

চিকিৎসকরা সমাজের সব শ্রেনীর উদ্ধে কোন বিশেষ শ্রেনী নন। মামলা হলে শক্তিশালী বা দুর্বল যে কেউ আদালতে এসে জামিন চাইবেন। সঠিক তদন্ত হবে এবং ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় তৎপর হবেন। তা না করে মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দেওয়া, মেডিকেল বন্ধ করে দেওয়া রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনেই অস্বীকার করা। একজন আইনবিদ বলেছেন, বিগত ১০ বছরে চট্টগ্রাম আদালতে চিকিৎসক ও বিএমএ সম্পর্কে কোন আদেশ দেওয়া হয়নি। আদালত সাম্প্রতিক সময়ে যে পর্যবেক্ষন দিয়েছেন তা চিকিৎসকদের জন্য শিক্ষনীয়। সবাইকে আইন মেনে চলা উচিত। আদালতের প্রতি সবার আস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরী। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন পেশিবিদের উপর ভর করেছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে চলে আসা যে কোন দাবী আদায়ে রাস্তা বন্ধ, সভা সমাবেশ গাড়ী ভাংচুর আগুন, মানুষ হত্যা, সরকারী সম্পদ বিনষ্ট ও ধর্মঘট ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের নাগরিক অধিকার হরন করে নিজেদের ব্যক্তি ও দলীয় স¦ার্থের জন্য এসব কর্মসুচী যেন সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।

জনগন মনে করে, চিকিৎসকদের এই কর্মসুচী চরম অমানবিক ও আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা। বেসরকারী হাসপাতালে যারা চিকিৎসা দেন তাদের অধিকাংশই সরকারী হাসপাতালে চাকুরীজীবি। একদিকে সরকারী কোষাগার থেকে বেতন ভাতা নেয়া হয়। অপরদিকে রাতদিন প্রাইভেট প্যাকটিস বা বেসরকারী হাসপাতালে রোগী দেখা হয়। কোন নাগরিক যদি মনে করেন, চিকিৎসা নিতে এসে তারা সঠিক চিকিৎসা পাননি, চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগী মারা গেছেন, তাতে রোগী বা তার প্রতিনিধি থানায় বা আদালতে অভিযোগ বা মামলা করতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের উচিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মামলার মোকাবেলা করা। কিন্তু মামলার অযুহাতে কোন মানবিক সচেতন চিকিৎসক বা গোষ্টী একটি নগরের সকল পর্যায়ের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করতে পারেন না। সরকারের আইন করে চিকিৎসকদের এমন অমানবিক ও ধর্মঘট বন্ধ করা উচিত। ডাক্তারদের এমন ঘর্মঘটে রোগীরা বঞ্চিত চিকিৎসাসেবা থেকে। এভাবে মানুষকে জিম্মি করে দাবী আদায় করার কোন যুক্তিতে পড়ে না। চিকিৎসকদের আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাই আজ স্পষ্ট হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা য়ায়, চট্টগ্রামে প্রায় এক কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবার কোন মানসম্মত ব্যবস্থা নেই। সাধারন মানুষ সরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যান রোগ নিরাময়ে। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলো চলছে নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে। রোগের পরীক্ষা নীরিক্ষার মুল্য একেক জায়গায় একরকম। এ ছাড়া আছে কাকড়াকা ভোরে সিরিয়াল নেওয়া, খারাপ ব্যবহার সহ নানা অনিয়ম আচরন সত্যই দু:খজনক। চট্টগ্রামে বেশিরভাগ চিকিৎসক নিয়মিত সরকারকে ট্যাক্স দেন না। নয়ছয় হিসাবে চলেন সবসময়। এদের গাড়ি বাড়ি সহ বিলাসী জীবনযাত্রায় মানুষকে মানুষ মনে করে না অনেক চিকিৎসক। তারা মনে করেন, তারাই দেশের মা-বাপ, তারা আইন মানেন না, মানুষকে মানুষ মনে করেন না। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা যাবে না। এদের এতই ক্ষমতা যে, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাতেই তাদের কোন দ্বিধা নেই। চট্টগ্রামে যেখানে সেখানে এমনকি আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে ক্লিনিক । সরকারী কোন নিয়ম এরা মানে না। প্যাথলজিতে কোন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তার না রেখে নার্স বা আয়া দিয়ে অধিকাংশ প্যাথলজি চালানো হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে একটি ভবন নির্মান বা ভাড়া করে ডাক্তারদের চেম্বার ব্যবসা এখন জমজমাট। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হলে তো কথা নেই। যার যেমন খুশি ফি আদায় করছেন। কোন নিয়ন্ত্রন নেই সরকারের।

এদের এই বেপরোয়া ভাবের লাগাম টেনে না ধরলে জনগনের কপালে আরও দু:খ রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। নগরীর সিএসসিআর এ একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সিরিয়াল নিতে হয় মধ্য রাতে। রোগীকে নানা পরীক্ষাগারে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাঠিয়ে সেখান থেকে কমিশন নেওয়া এখন আইন হয়ে গেছে। কমিশন বানিজ্য, ক্লিনিক বানিজ্য সহ নানা বানিজ্য বেহাল অবস্থা চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা। চট্টগ্রাম মহানগরীতে মানুষ সঠিকভাবে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না।

চিকিৎসা বঞ্চিত এসব মানুষের কথা কোন সরকারের আমলে শুনেননি। চট্টগ্রামের হালিশহর নিবাসী ব্যবসায়ী ইসহাক নগরীর একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিডনির পাথর অপসারন করতে। দেখা গেছে, পাথরের সাথে একটি কিডনি সুকৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এ ব্যাপারে পাঁচলাইশ থানায় মামলা হলেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা এক হতভাগা দুর্ভাগ্য জাতি, অবহেলা, অনাদরে কোন রোগীর মৃত্যুর চিকিৎসকের কারনে হলেও প্রতিবাদ করা যায় না। আইনের আশ্রয় দেয়া যায় না। হলেই হল, ধর্মগট, হুমকি, ধামকি এদের এত ক্ষতা কোথায় থেকে এল। প্রধানমন্ত্রী, এমপি মন্ত্রীরা যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আদালতে যেতে পারেন তবে চিকিৎসকরা যেতে পারেন না কেন? তাহলে এক তাদের জন্য সবকিছু মাফ হয়ে যাবে।অভিযুক্ত ব্যক্তি যে যত প্রভাবশালী হোক না কেন অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.