ভোট কারচুপি ও সহিংসতায় কূটনীতিকদের অসন্তোষ

সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতায় বিস্মিত কূটনীতিকরা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা ভোটে অনিয়মের বিষয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন কূটনীতিকরা। তারা বিএনপির ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তেও হতাশা ব্যক্ত করেন।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর পরই ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ভোট কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা আজ (মঙ্গলবার) ভোট কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতার কথা জেনে অসন্তোষ্ট হয়েছি। এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনে বিএনপির সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে অনিয়ম তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সব দলকে আইনের মধ্যে সম্পৃক্ত হওয়া এবং যে কোনো মূল্যে সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানাই। আমরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত যে কোনো সহিংসতার বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় নিন্দা জানাই। এদিকে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট দিনের বিভিন্ন সময়ে টুইটারে নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, যে কোনো উপায়ে জেতা, জেতা না। দুপুরে বনানীর একটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল।

নির্বাচন সম্পর্কে ব্রিটিশ হাইকমিশন পৃথক এক বিবৃতিতে বলেছে, আজ (মঙ্গলবার) দুপুরে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে মাঝ পথে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সরে দাঁড়ানোর ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এ সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে আজ রাতে এবং আগামী কয়েকদিন সহিংসতা বা শান্তিবিঘন্ন  সৃষ্টিকারী কোনো ঘটনা ঘটবে না।

ব্রিটিশ হাইকমিশনের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আজকের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত সব রাজনৈতিক দলের। অনিয়মের সব অভিযোগ দ্রুত এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হওয়া জরুরি। সব ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করা সব রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃংখলা বাহিনীসমূহের দায়িত্ব। যারা নির্বাচনে জিতবেন তাদের স্ব স্ব শহরের অধিবাসীদের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের সেবা প্রদানের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।

টানা তিন মাসের সহিংস রাজনীতির পর সিটি নির্বাচনকে সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ বলে মনে করেছিলেন বিদেশী কূটনীতিকরা । স্বাভাবিক কারণেই এ নির্বাচনের প্রতি তাদের কৌতূহল ছিল প্রবল। ফলে ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকরা ভোটের দিন সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন শুরু করেন।

ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন সকাল ৯টার দিকে গুলশান মডেল স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তিনি যান বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে। সকাল ১০টায় তিনি ধানমণ্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনের পর বলেন, আমি বেশ কিছু কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। নির্বাচন কীভাবে কাজ করে সেটা সম্পর্কে নিজের জানার জন্য আমার এ পরিদর্শন। আমি আরও কিছু কেন্দ্র পরিদর্শন করব।

সকালের দিকে তিনি যেসব কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন, ওই সময়ে সেসব কেন্দ্রে পরিস্থিতি ছিল শান্তিপূর্ণ। এ কথা উল্লেখ করে গিবসন বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ বেশ শান্তিপূর্ণ দেখতে পাচ্ছি। আশা করছি, এ শান্ত পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে।

ধানমণ্ডি বালক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের পরিদর্শনকালে সাংবাদিকরা পোলিং বুথগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের পোলিং এজেন্টের উপস্থিতি দেখতে পেলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাসের কোনো এজেন্ট তখন দেখতে পাননি। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের মন্তব্য চাইলে তিনি বলেন, পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দেবেন কিনা সেটা সম্পূর্ণ প্রার্থীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।

ধানমণ্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে সকালে ভোটারের উপস্থিতি যখন কম; তখন বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বনানীর এ বৃহৎ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেড়ে যায়। সেখানে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিস্থিতির মধ্যে বেলা সোয়া ১১টার দিকে কেন্দ্রটির গেটে পৌঁছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তবে তিনি গাড়ি থেকে নামেন অনেক পরে। বনানী বিদ্যানিকেতনের গেটে গাড়ির মধ্যে বসে থাকেন প্রায় আধা ঘণ্টা।

মার্শা বার্নিকাট এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মার্শা বার্নিকাট সাংবাদিকদের বলেন, আমি এ ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করতে পেরে খুব খুশি হয়েছি। আমার মা একজন পোলিং অফিসার ছিলেন। এখানে অনেক মানুষ ভোট দিতে এসেছেন। নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্য যে সব নাগরিক ভোট দিতে এসেছেন; তাদের ভোট দিতে পারার অধিকার রয়েছে। সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার অঙ্গীকার করেছিল। সেটাই জনগণ আশা করছে। আমরা যখন দেখি যে, নির্বাচনের আগে সহিংসতা হয়েছে, তখন আমরা খুবই হতাশ হয়েছিলাম।

র্নির্বাচনে বিএনপি সমর্থক পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগে ততক্ষণে বিএনপি চট্টগ্রামে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে এবং ঢাকায় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বার্নিকাটের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আসলে আপনাদের এখানকার নির্বাচনের বিষয়ে একজন ছাত্রী। আমার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোট চলাকালে বিদ্যুৎ না থাকলে কিংবা অন্য কোনো কারণে ভোট দিতে না পারলে পরে সেই ভোট দিতে পারেন। এখানে কি সেটা পারেন?

এখানে এমন সুযোগ নেই জানিয়ে সাংবাদিকরা বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করছে না। বিএনপির অভিযোগ তাদের সমর্থক প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। এ প্রশ্নের জবাবে মার্শা বার্নিকাট বলেন, এটা তারা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করতে পারে।

বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আবার সহিংসতার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি আশা করি, জনগণ সহিংসতার আশ্রয় নেবে না। এ দেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং জনগণের উচিত হবে গণতান্ত্রিক স্পেসের ব্যবহার করা।

মার্শা বার্নিকাট বনানীর ওই স্কুলে থাকাকালেই সেখানে নির্বাচন দেখতে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক গ্র“প ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সর (ফেমা) হয়ে ভোট দেখতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরছেন। দুপুর ১২টার দিকে তার কাছে ভোটের চিত্র জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকাল ৮টায় আমরা যখন বের হই, তখন ভোটার সংখ্যা কম ছিল। পরে ভোটারদের উপস্থিতি কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু ভোট কেন্দ্রের ভেতরে দুই বড় দলের সমর্থক মেয়র প্রার্থীর মধ্যে একজন প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট আছে। অন্য প্রার্থীর নেই। এটা এ পর্যন্ত আমার দেখা সবগুলো ভোট কেন্দ্রের সাধারন চিত্র। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ফেমার আরেক পর্যবেক্ষক ফরেন চেম্বারের সাবেক সভাপতি একেএম শামসুদ্দীন আহমেদ বলেন, কোথাও বিএনপি সমর্থক এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। অন্য এক পর্যবেক্ষক গ্র“প ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্র“পের পরিচালক ড. মো. আবদুল আলীম বলেন, ভোটার কম, অনেক এজেন্ট নেই। এ ধরনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

একদল কূটনীতিক পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজ কেন্দ্রে ভোট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন দুপুরের দিকে। সেখানে গিয়ে তারা সহিংসতার ভয়াবহতায় হতভম্ব হয়ে পড়েন। কূটনীতিকদের উপস্থিতিতেই শুরু হয় দুই গ্রুপের সংঘর্ষ। লাঠিসোঠা নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলে কূটনীতিকরা দৌড়ে আত্মরক্ষা করেন। বিকাল ৪টার দিকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে কালাচাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে পাওয়া গেল ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের রাজনৈতিক বিভাগের উপপ্রধান সুয়োসি হিকিতাকে। তার ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনকালে গোটা কেন্দ্রেজুড়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অবাধে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। বুথে সরকার দলের সমর্থকরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে জমা দিচ্ছে এমন দৃশ্যও দেখা গেছে। হিকিতার কাছে জানতে চাইলাম, ভোট দেখে তার প্রতিক্রিয় কী? হিকিতা বলেন, আমি কোনো মন্তব্য করব না।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.