“মহান মে দিবস”শ্রমিকদের উৎসবের দিন

সিটিনিউজবিডি: আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন পহেলা মে।খেটে খাওয়া শ্রমিকদের উৎসবের দিন। মে দিবস সম্পর্কে দেশের বেশিরভাগ শ্রমিকই অবগত নন। যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন বাংলাদেশের সেসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে দিনটির তাৎপর্য আজও ভালভাবে পৌঁছায়নি। অনেক দিনমজুর, গৃহশ্রমিক জানে না মে দিবস কি। ফলে তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা এখনও রয়েছে অন্ধকারে।
১২৯ বছর আগে শ্রমিকের রক্তে অর্জিত অধিকারের জন্য আজও সংগ্রাম করে চলেছে শ্রমিকরা। আজও তারা ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
দেশের শিল্প কারখানায় ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা এখনও ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অমানবিক ভাবে খেটে চলেছেন। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, মারধর, নারী শ্রমিকদের প্রতি চরম অপমান-গঞ্জনা কারখানাগুলোর সাধারণ চিত্র।
আর এসব অবর্ণনীয় শোষণ, নির্যাতনে শ্রমিকদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন শ্রমিকরা ফেটে পড়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আন্দোলনে। শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনের ওপর নেমে আসে দমন নির্যাতন।
দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এ দিন শিকাগোর হে মার্কেটে বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকরা। দিনটির তাৎপর্য স্মরণ করে সারাবিশ্বেই যথাযথ মর্যাদায় পালিত হবে মহান মে দিবস।
বাংলাদেশেও দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।

‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলা গড়ে তুলি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পহেলা মে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে মহান মে দিবস পালন করবে সরকার।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দিনটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ঐতিহাসিক মে দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করে শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা, কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন।

প্রতিবছর মে দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকলেও এবার ১ মে পড়েছে শুক্রবার। এ দিন দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও কল-কারখানাসহ যেসব প্রতিষ্ঠান শুক্রবারেও খোলা থাকে সেগুলো আজ মে দিবসের বাড়তি ছুটি পেয়েছে।

দিবসটি উপলক্ষে দেশের শীর্ষ অনলাইন পত্রিকা, মুদ্রিত দৈনিকসমূহ আলাদা আয়োজন এবং রেডিও টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। এ উপলক্ষে দেশের সব মুদ্রিত সংবাদপত্র বন্ধ থাকবে। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় শীর্ষ অনলাইনগুলোর কার্যক্রম চলবে।

মহান এ দিনটির পেছনে রয়েছে এক রক্তভেজা ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় এদিনটির রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মে দিবস এলেই মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এদিন প্রমাণ করে দিয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য দাবিকে গলা টিপে হত্যা করা যায় না। তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়। শ্রমিকের আন্দোলনের কারণে আজ ৮ ঘণ্টা কাজ করার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই শ্রমিকের এ দাবিকে আইনে পরিণত করেছে।

মে মাসের প্রথম দিনটি বিশ্বের অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এ দিনটি মে দিবস নামে পরিচিত। কিন্তু কিছু দেশে মে দিবসকে লেবার ডে বা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে ১১ জন শহীদ হয়। হে মার্কেটের ওই শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মে দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে।

দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার আগে শ্রমিকদের দিন রাত অমানবিক পরিশ্রম করতে হতো। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন। বিপরীতে মজুরি মিলত নগণ্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত। ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়েও পড়ত।

১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেধে দেয় দেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে।

কিন্তু কারখানা মালিকরা এ দাবি মেনে নেয়নি। ৪ মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশে একত্রে জড়ো হয়। ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই এটি করা হয়েছিল। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশ বাহিনী তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা সংঘাতে রূপ নেয়। এতে ১১ শ্রমিক শহীদ হয়। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অন্য একজনের পনের বছরের কারাদণ্ড হয়।

ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ২৬ জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন। এ আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি স্বীকৃতি পায়। এর পর থেকেই মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.