পার্বত্য চট্রগ্রামে বৈসাবি’র আনন্দ

শ্যামল রুদ্র, রামগড় : ১৪২৩ বাংলা শুভ নববর্ষে বর্ষবরণের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে আদিবাসীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। আদিবাসিরা প্রতিবছর ধর্মীয় ও সামাজিক নানা লোকজ অনুসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এ দিবস ঘিরে জাঁকজমক ভাবে উদ্যাপন করেন। বৈসাবি উপলক্ষে পুরো পার্বত্যাঞ্চল এখন উৎসবমুখর। ঐতিহ্যবাহী গ্রাম্য খেলাধুলায় মুখরিত এখন আদিবাসী পল্লিগুলোয়। সব বয়সীরাই মেতেছেন বৈশাবি’র অমলিন আনন্দে। সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজনে ধর্মীয় নানা আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে গ্রামে গ্রামে প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন খেলাধুলা।

খাগড়াছড়ি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. রাজেন্দ্র ত্রিপুরা ও বিমা কর্মকর্তা নব কুমার চাকমা জানান, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আদিবাসি ছাড়াও সকল শ্রেণী,সম্প্রদায়ের মানুষ পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করেন। এই সময় শেকড়ের টানে সবাই নিজ নিজ এলাকায় আসেন। পরিবার পরিজন নিয়ে আত্বীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে একে অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। বৈসাবির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের করেন। এ সময় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন সবাই। প্রত্যেকেরই যেন পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকে এ বৈসাবিকে ঘিরে, আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা জমানো, সে-তো না হলেই নয়। বৈসাবি নামের তাৎপর্য তুলে ধরে তাঁরা বলেন, ত্রিপুরাদের বৈসুক,মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজুÑ তিন স¤প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর-ই বৈসাবি। বৈসাবির প্রথম অক্ষর বৈ- ত্রিপুরাদের বৈসুক। তাঁরা বৈসুক উদযাপন করে তিন দিন। প্রথম দিন ছেলেমেয়েরা অতি প্রত্যুষে ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। ভোরবেলা গবাদিপশু গুলোকে ছেড়ে দেয়। পরে স্নান করিয়ে ফুলের মালা পরায়। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরা নিমপাতা ও কাঁচা হলুদ বাটায় স্নানের পর বৈচিত্রময় নতুন পোশাক পরিধান করে একে অন্যের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। আদিবাসী নারীরা নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে পিনন খাদি পরিধান করে। লোকজ সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরে প্রথম দিনই গরইয়া নাচের দল বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বাড়ির আঙ্গিনায় নৃত্য পরিবেশন করে। ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের কাছে এ নাচ গরইয়া নৃত্য নামে পরিচিত। বৈসাবির মধ্যের অক্ষর সা- মারমাদের প্রিয় উৎসব সাংগ্রাই।

সাংগ্রাই উপলক্ষে মারমা তরুন তরুনীরা নিজহাতে পিঠাপুলি, মিষ্টি পায়েস বানিয়ে অতিথিদের পরিবেশন করেন। তাদের এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ পানি খেলা। মারমা তরুন তরুনীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে সাংগ্রাই উদযাপন করে। ফুল বেলপাতা বিভিন্ন ধরনের ফলফলারি নিয়ে মন্দিরে গিয়ে পুজা করে। গুরুজনদের প্রণাম করে আর্শীবাদ নেয়।
নব কুমার চাকমা জানান, বৈসাবির শেষ অক্ষর বি- চাকমাদের বিজু। বিজুর তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম দিন ফুল বিজু,দ্বিতীয় দিন মূল বিজু এবং শেষ দিন গেজ্যা পেজ্যা দিন নামে অভিহিত। ফুল বিজুর দিন চাকমা তরুনতরুনীরা দলবদ্ধভাবে ফুল সংগ্রহ করে নদীতে ভাসিয়ে উৎসবের সূচনা করে। ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলে পুরো ঘর। দল বেঁেধ বাড়ি বাড়ি ঘুরে তরুণতরুনীর দল। চলে অতিথি আপ্যায়ন। বিজুতে আপ্যায়নের প্রধান আকর্ষণ নানা প্রকার সবজির মিশ্রনে তৈরি পাচন। অপূর্ব স্বাদের পাচন প্রতিটি ঘরেই রান্না হয়। উপাদেয় এই পাচন সকলের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত।

রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) মো. ইকবাল হোসেন নববর্ষের নানা আয়োজন প্রসঙ্গে বলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামে বৈসাবি মানে অনাবিল আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। অতীতের দু:খ বেদনা ভুলে নব বর্ষে পার্বত্য চট্রগ্রামে সকল স¤প্রদায়ের মাঝে সম্প্রীতি আর ভ্রতৃত্ববোধের বন্ধন চির অটুট রাখতে কায়মনে সৃষ্টিকতাকে স্মরণ করা। তিনি বলেন,এই শুভ দিনে আমরা যেন সকল দুর্বলতা,সঙ্কীর্ণতা ও স্বার্থবুদ্ধিকে অতিক্রম করে আমাদের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত রাখতে পারি।

বিশিষ্ট উপজাতি নেতা পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পরামর্শক সদস্য ভূবন মোহন ত্রিপুরা বলেন,আদিবাসীদের প্রাণের উৎসবে আদ্যক্ষর দিয়ে যেমন বৈসাবি নামের মাধ্যমে বন্ধন সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনি আমরাও চাই পার্বত্য চট্রগ্রামের বৈসাবি শব্দের মতো সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে সৃষ্টি হোক শান্তি ও স¤প্রীতির বন্ধন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা,স্নেহ,ভালোবাসা,বিনয় নম্রতা,শিষ্টাচার,সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাবই পারে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে। জাতির কল্যাণে মানুষে মানুষে স¤প্রীতি, ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠাই হোক এই শুভদিনের কামনা।
এ দিকে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে খাগড়াছড়ির রামগড়ে পাহাড়ি বাঙ্গালিদের সমন্বয়ে বৈশাখি উৎসবের ব্যাপক আয়োজন করা হয়।

রামগড় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিনকে আহবায়ক করে গঠন করা হয় নববর্ষ উৎযাপন পরিষদ। পহেলা বৈশাখ নববর্ষের দিন রামগড় পার্বত্যাঞ্চল দিনব্যাপি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন আন্দোলিত করে সকলকে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে উপজেলা প্রশাসন ও নববর্ষ উদযাপন পরিষদের পক্ষে সকালে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। পরে থাকে পান্তা ইলিশ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উদযাপন পরিষদের আহবায়ক মো. নাসির উদ্দিন নতুন বছরে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন,পাহাড়ি বাঙ্গালীর পরম আকাক্সিক্ষত শুভদিনের এই শুভলগ্নে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা-উৎসবের দিনগুলো যেন আমরা শান্তি ও আনন্দে,প্রীতি ও শ্রদ্ধায়,সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ে অতিবাহিত করতে পারি। তিনি বলেন, বৈসাবি পার্বত্য চট্রগ্রামের শান্তির প্রতীক। আমাদের প্রত্যাশা বৈসাবি উৎসবের আমেজ পুরো বছর জুড়ে এলাকায় বিরাজ করুক। অশান্তি চিরতরে দূরীভূত হোক, আসুরিক শক্তির পরাজয় ঘটুক- পার্বত্যাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি আসুক। প্রত্যেক স¤প্রদায়ের মানুষ প্রশান্তি নিয়ে সুখে শান্তিতে এলাকায় বসবাস করুক – আজকের এই শুভদিনে এটাই প্রত্যাশা।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.