চট্টগ্রামে ছাত্রলীগকে ফ্রাংকেষ্টাইন দানবে পরিনত করতে রসদ যোগাচ্ছেন কারা !

জুবায়ের সিদ্দিকী –  

কখনো ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগ, কখনো যুবলীগের সঙ্গে যুবলীগ। বিপরীত মতাদর্শের রাজনৈতিক দল নয় বরং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো নিজেরাই এখন নিজেদের প্রতিপক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে দলটির চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতাদের অনুসারীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত প্রকাশ্যে চলে আসায় এমন মন্তব্য করছেন নগরবাসীর অনেকেই। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নগর ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিহত হওয়ার পর নতুন করে চলেছে এই আলোচনা। যদিও দলের বিরুদ্ধে এমন নেতিবাচক সমালোচনায় আক্ষেপ আছে খোদ দলটির অনেক সিনিয়র নেতারও। তারা মনে করেন, দলের ভাবমুর্তি রক্ষায় এসব নিয়ন্ত্রন প্রয়োজন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগর আওয়ামী লীগের পদস্থ নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের কিছু কিছু নেতা-কর্মী পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন।

এ দ্বন্দ্ব্রে কারনে নিজ দলের কর্মীকে খুনের ঘটনাও ঘটেছে নগরীতে। পরস্পরের সঙ্গে প্রকাশ্যে মারামারি হানাহানিতে জড়িয়ে পড়াও যেন স্বাভাবিক ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে নিজ দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যায় অনেককে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের চেয়ে নিজ দলের কর্মী সমর্থকদের পারস্পরিকএ দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারন হিসেবে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে দল ক্ষমতায় থাকায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সেই ক্ষমতাকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি নিয়েই মুলত এসব দ্বন্দ্ব বলে গনমাধ্যমে সংবাদও রেরোয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাই নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী প্রমানে ব্যবহার করেন তাদের অনুগত অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ হলেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে প্রায় বিব্রতবোধ করেন পুলিশ প্রশাসন। এমনকি পুলিশের উপস্থিতিতেও অনেক সময় সংঘটিত হতে দেখা গেছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

সর্বশেষ আজ ২৩ এপ্রিল শনিবার চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি হাজী মুহ‍াম্মদ মহসিন কলেজে আধিপত্য নিয়ে বিরোধে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও মারামারির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং গত মার্চে নাছিম আহমেদ সোহেলের মৃত্যুকে ঘিরে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা ভাংচুর চালিয়েছে পুলিশের সামনেই। পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিভক্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগ চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুসারী হওয়ায় তাদের উপর এক ধরনের চাপ থাকে। সংশ্লিষ্ট সুত্র মতে, নগরীতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের যেসব নেতাকর্মী তারা মুলত নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাধারন সম্পাদক ও মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন, অর্থ সম্পাদক ও সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, সহ-সভাপতি ও প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং সহ-সভাপতি ও সাবেক গনশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীনের অনুসারী।

অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব সংঘাতের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, দলের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছেন অনেক উশ্চৃঙ্খলকারী। তারা জড়িয়ে পড়ছেন মারামারি হানাহানিতে। এসব দেখে অনেক সময় মনে হতে পারে ’হানাহানি লীগ’। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী কিছু লোকই এসব করছেন। অনেক সময় এসব নিয়ন্ত্রন করা যায় না। তবে আমি বলবো, এসব দুষ্কর্ম যারা করছেন তাদেরকে দুস্কৃতিকারী হিসেবে দেখুন। কিন্তু এখন দুস্কৃতিকারীদের দুষ্কর্মের চেয়ে সাংগঠনকে বড় করে দেখা হচ্ছে। এটা ঠিক না। বরং সংগঠনকে প্রধান করে না দেখে, দুষ্কর্মকে দেখা উচিত। কারন বাস্তবতা হচ্ছে সংগঠনের সাথে এসব দুস্কর্মের কোন সম্পৃক্ততা নেই। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানহানী প্রসঙ্গে তিনি বলেন,’ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় যাদের আটক করা হয়েছে তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের স্বীকারোক্তি পাওয়া গেলেই আসল ঘটনা জানা যাবে। অভ্যন্তরীন ক্লেশ ও সংঘর্ষ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বলেন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে যে আলোচনা চলছে সেখানে কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল না। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীর বিরোধ নিয়ে কোথাও কিছু ঘটেনি। আগে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়তো ঘটেছিল।

এখানে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখাতে হবে, ছাত্রলীগ মানে একজন ব্যক্তি নয়। তাই কেউ কিছু করলে তার জন্য ব্যক্তি দায়ী হবেন, ছাত্রলীগ নয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে রনি বলেন, আমরা অঙ্গ সংগঠন। আমাদের গাইডলাইনে রাখতে হবে। অভিভাবকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের নিয়ে যেন রাজনীতি করা না হয়। কেউ যেন নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য আমাদের ব্যবহার না করে। বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত অপ্রীতিকর ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম চলে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বিব্রত। তবে রাজনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে কিছু ঘটলে সেখানে ছাত্রলীগ কেন দায়ী থাকবে? আবার বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে অনেকগুলো ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। সেখানে শেষে লীগ শব্দ রাখা হয়। এরা কিছু করলেও মুল দলের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। তাই এসব বিষয়ে মুল দলের অভিভাবকদের খেয়াল রাখা উচিত। অভ্যন্তরনীন কোন্দল বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ফয়সাল বাপ্পী বলেন, নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এসব নিয়ে মারামারি করা উচিত নয়। কারন এতে রাজনীতির দিকে অনেকের অনাগ্রহ তৈরী হবে।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য অনুষদের বিদায় অনুষ্টানের কতৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যকার সংঘর্ষে গত ২৯ মার্চ মারা যান নগর ছাত্রলীগের কার্যনিবাহী কমিটির সদস্য নাছিম আহমেদ সোহেল। ছাত্রলীগের একটি অংশ এ ঘটনাকে দলীয় বিরোধ মানতে নারাজ। তবে নিহত সোহেলের লাশ নিয়ে ওইদিন নগরীর প্রবত্তক মোড়ে বিক্ষোভ করেছিল ছাতলীগের একটি অংশ। বিক্ষোভকারীরা সেদিন এ হত্যাকান্ডের জন্য নগর আওয়ামী লীগের আরেকটি অংশকে দায়ী করেছিলেন। এর আগে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর খুন হন পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসান বাদল। এ হত্যাকান্ডের জন্য নিহতের পরিবার সেদিন গনমাধ্যমের কাছে একই দলের কয়েকজনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। নগরীর সিআরবিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৪ জুন। ওইদিন দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সাজু পালিত ও আরমান হোসেন নামে দুজন মারা যায়। সিআরবিতে এই নেতার অনুসারীদের মধ্যে প্রায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে গত বছরের ১৬ নভেম্বর, ৭, ১২ ও ৩১ অক্টোবর উভয় গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। ১২ অক্টোবরের ঘটনায় একজন গুলিবিদ্ধ সহ আহত হয়েছিল তিন জন।

এ ঘটনার পর নগর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ নগরীতে শোডাউনও করেছিল। চলতি বছরের ৮ মার্চ মিছিল করাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। এতে নাছির ও রকি নামের দুই ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়েছে। গত বছরের ৩১ অক্টোবর নাছিরাবাদ এলাকায় ফুটপাতের দোকান দখল বেদখল নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। গত বছরের ২৮ জুন টাইগারপাস মোড়ে বিলবোর্ড উচ্ছেদের অভিযান চালিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। অভিযান শেষ করে চসিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় যুবলীগের এক নেতা অপর নেতাকে গুলি করার হুমকি দিলে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিস্কৃত হয়েছিল। অপরদিকে নগর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল প্রসঙ্গে খবর নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে সভাপতি সাধারন সম্পাদক সহ ২৪ জনের নাম ঘোষনা করে নগর ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়। এর পরপরই নগর ছাত্রলীগের একটি অংশ কমিটির বিরোধিতায় নামে। এ নিয়ে পদবঞ্চিতরা বিভিন্ন কর্মসুচীও পালন করে। কমিটি ঘোষনার পর থেকেই বিভিন্ন সময় উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারী সার্কিট হাউজের ভেতরেই ছাত্রলীগের এক নেতাকে প্রতিপক্ষের গ্রুপের নেতাকর্মীরা কুপিয়ে জখম করে। ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারী নগরীর পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট ছাত্র সংসদের জিএস আবদুল্লাহ আল রুবেল জিয়া আহত হয়েছেন প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায়।এর ৭দিন আগে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। ছাত্রলীগ শফি গ্রুপ হামলা চালায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রায়হানুল হকের উপর। এভাবে দানবীয় ষ্টাইলে চর দখলের মত ছাত্রলীগ, মারামারি, হামলা, দখল, টেন্ডারবাজি ও অস্ত্রবাজি করে সরকারের শর্ত সহঅর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছেন। নেপথ্যে নগরীতে ও কেন্দ্রে বসে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন অনেক আওয়ামী লীগের নেতা। এরাই ছাত্রলীগকে ফ্রাংকেষ্টাইন দানবে পরিনত করতে রসদ যোগাচ্ছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.