চট্টগ্রামে ওয়াসার কোটি টাকার পানি বানিজ্য

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

 চট্টগ্রামে তীব্র গরম শুরু হতে না হতেই দেখা দিয়েছে বাসা বাড়িতে ওয়াসার পানির সংকট। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রতিষ্টার ৫২ বছর পরও নগরীর ৫৮ শতাংশ এলাকা পানি সরবরাহের আওতায় আসেনি। ৪২ শতাংশ এলাকা এর আওতায় থাকলেও চাহিদার তুলনায় পানি সরবরাহ এখনো এক তৃতিয়াংশের কম। সরকারী এই সেবা খাতের আওতায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ৬৮ ভাগ কম থাকলেও অবৈধভাবে প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসা কোটি কোটি টাকার পানি বানিজ্য করছে। আর এই অবৈধ পানি বানিজ্যের সাথে জড়িত খোদ ওয়াসার উর্ধতন কর্মকর্তারা। ওয়াসা সুত্র জানায়, নগরবাসীর পানির চাহিদা পুরনে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্টিত হয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরই মধ্যে ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু নগরীর অধিকাংশ এলাকায় এখনো পানি সরবরাহে সক্ষম নয় ওয়াসা। ফলে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার লেগে আছে। আর এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এক শ্রেনীর প্রভাবশালী মহলকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে চালিয়ে যাচ্ছে পানি বানিজ্য। ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় দৈনিক দেড় থেকে দুই কোটি লিটার ওয়াসার পানি অবৈধভাবে বিক্রি হয়। এলাকাভিত্ত্বিক বিভিন্ন সিন্ডিকেট এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে। তারা ওয়াসার লাইন থেকে পানি চুরি করে এ বানিজ্য চালাচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীর দক্ষিণ হালিশহর ইপিজেড এলাকার রেল ক্রসিং থেকে শুরু করে ১ নম্বর মাইলের মাথায় লিমনের দোকান, ব্যারিষ্টার কলেজ, তিন রাস্তার মোড়, আব্দুল মাবুদ সওদাগরের বাড়ির পাশে, ফ্রি পোর্ট, বে-শপিং গন শৌচাগার, বন্দরটিলা জালাল প্লাজা, চক্ষু হাসপাতাল, সিটি ব্যাংকের পাশে, নারকেল তলা, রেইনবো কমিউনিটি সেন্টার, চিটাগাং আইডিয়াল স্কুল সহ বিভিন্ন জায়গায় কমপক্ষে শতাধিখ ব্যক্তি ওয়াসার এই অবৈধ পানি ব্যবসায় জড়িত। যাদের সহযোগিতায় রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ছাড়া নগরীর আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা সংলগ্ন মোগলটুলি, পশ্চিম মাদারবাড়ি, মাঝিরঘাট, আগ্রাবাদ হাজিপাড়া, বেপারী পাড়া, মুহুরী পাড়া ও হালিশহর হাউজিং এষ্টেট এর একাধিক ব্যক্তি ওয়াসার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চালাচ্ছে অবৈধ পানি বানিজ্য। দিনের পর দিন ওয়াসার বৈধ গ্রাহকরা পানি বঞ্চিত হচ্ছে, বিভিন্ন ঘনবসতিপুর্ন এলাকায় পানির আহাজারি চললেও পানি দিতে ব্যর্থ হয় ওয়াসা। তদুপরি থেমে নেই ওয়াসার পানি বানিজ্য। বাড়তি টাকা দিলেই পাওয়া যায় ওয়াসার পানির ভাউচার।

পানির অভাব নেই, টাকা দিলে ঘরে চলে আসে ভাউচার গাড়ি। নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার এক পানি বিক্রেতা জানায়, তিনি প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ ভ্যান পানি বিক্রি করা হয়। ভ্যানগাড়ি করে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পানি পৌছে দেন তিন। জানা যায়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এ রকম পানি বানিজ্য চলছে। সেই হিসেবে নগরীর সহস্রাধিক পয়েন্টে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পানি অবৈধপথে বিক্রি হয়। ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, নগরীর পুরো এলাকা ওয়াসার আওতায় আনতে হলে নতুন লাইন সম্প্রসারন ও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু অর্থ সহ নানা কারনে এখনো তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সরবরাহ লাইন ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে আওতাধীন এলাকায়ও পানি সরবরাহ ব্যাহত হয়। অথচ অভিযোগ রয়েছে, আবাসিক এলাকার গ্রাহকদের দিনের পর দিন পানি বঞ্চিত করে, চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তা কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ভাউচার গাড়ির মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্প কারখানা, ডাইং, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরা, কমিউনিটি সেন্টারে বেশিমুল্যে পানি সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যে কারনে নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে পারছে না চট্টগ্রাম ওয়াসা।

প্রতিদিন চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ পানি সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এ প্রতিষ্টানকে। তবে কারন হিসেবে ওয়াসা বলছে,’অতিরিক্ত লোডশেডিং, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারন দেখিয়ে ওয়াসা দায় সারলেও প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। চট্টগ্রাম ওয়াসা সুত্র জানায়, নগরীতে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের দৈনিক পানির চাহিদা ৫০ কোটি লিটার। কিন্তু ওয়াসা সরবরাহ করতে পারছে মাত্র ২০ কোটি লিটার। পানির লাইনের লিকেজের কারনে তাও নিয়মিত সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বশীল একজন প্রকৌশলী বলেন, গরমের কারনে নগরীতে পানির চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কমে যায়। অতিরিক্তি লোডশেডিং, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও কোন নলকুপ সাময়িক বন্ধ রাখার পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই পানির জন্য হাহাকার চলছে। বিশেষ করে বস্তি ও কলোনীতে এ অবস্থা চরম আকার ধারন করেছে। ওইসব এলাকায় ওয়াসা স্থাপিত বিভিন্ন টিউবোয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করতে দীর্ঘ লাইন দিতে দেখা যায়।

নগরীতে পানি উৎপাদন এবং সরবরাহে ব্যর্থতার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করে প্রতিষ্টানটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায়ই বন্ধ থাকায় পানি সরবরাহ সংকটের মুখে পড়েছে। এদিকে বিউবো বলছে, গ্যাস সংকট সহ বিভিন্ন কারনে কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। পানি নিয়ে হাহাকার চলছে, আগ্রাবাদ বেপারী পাড়া, হাজি পাড়া, মুহুরী পাড়া, আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা, সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর হাউজিং এষ্টেট ও শান্তিবাগ এলাকার গ্রাহকদের মাঝে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ৬১ হাজার ৭১৭ আবাসিক গ্রাহক এবং ৭ হাজার ৩৮৭ বানিজ্যিক গ্রাহক রয়েছেন। চাহিদা আর সরবরাহের বিশাল এই ঘাটতির মধ্যে নগরীতে পানির জন্য ত্রাহী অবস্থা চলছে। সিটি কর্পোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে এখনও ১৩টি ওয়ার্ডে পানি সরবরাহ দিতে পারেনি ওয়াসা। উৎপাদন বাড়াতে না পারলেও বিগত পাঁচ বছর ধরে পানির দাম বাড়িয়ে চলেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, প্রতি হাজার লিটার পানিতে খরচ পড়ে ১৫ টাকা করে। বর্তমানে আবাসিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম নেয়া হচ্ছে ৭টাক২৫ পয়সা এবং বানিজ্যিকে ২০ টাকা ৫৩ পয়সা। এ অবস্থা ওয়াসা ফের পানির দাম বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির উৎসের মধ্যে রয়েছে মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পটি চালু করা হয়। ২৮ ব্ছরেও ওয়াসা কোন প্রকল্প চালু করতে পারেনি। এ ছাড়া বেশ কয়টি প্রকল্প ওয়াসা হাতে নিলেও তা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় নগরবাসীর পানি সংকট থেকে মুক্তি মিলছে না। অভিযোগ রয়েছে,’ওয়াসার অভ্যন্তরে পানি চুরি ও মিটার রিডারদের অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়ে সুবিধা নিচ্ছে উপর মহল।ওয়াসা বলছে,’চট্টগ্রামে পানি সংকট দীর্ঘদিনের। ওয়াসা প্রতিমাসে প্রায় ৮০ লাখ টাকা করে লোকসান দিচ্ছে। কর্নফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তাদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পানি সংকট অনেকাংশে কমে আসবে।

খবর নিয়ে জানা যায়, বন্দর থানাধীন সল্টগোলা ক্রসিং থেকে শুরু করে ইপিজেড, এমটিভি গেইট, বন্দরটিলা এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসা ও এলাকার রাজনৈতিক নেতা, বিদ্যুৎ অফিস ও পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে অবৈধভাবে পানি বানিজ্য চালাচ্ছে একাধিক সিন্ডিকেট। সিমেন্ট ক্রসিং এলাকার আয়ুব সওদাগর প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টি ভ্যান দিয়ে ৫ থেকে ৬’শ হাজার লিটার পানি সাপ্লাই দেন। মাইলের মাথায় রয়েছে রিমন, রাকিব ও জসিম সিন্ডিকেট। তারা ৫০টি বড় জারে করে ২ থেকে ৩ হাজার লিটার পানি বাসাবাড়িতে সাপ্লাই দেন।

সিমেন হোষ্টেল এলাকার আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন ও জাবেদ এলাকার বাসাবাড়িতে হোম ডেলিভারীর মাধ্যমে চালাচ্ছে পানি বানিজ্য। বন্দরটিলা এলাকার আলমগীর (প্রকাশ ভোলা) ও জসিম পানি বিক্রি করে মধ্যরাতে। ইপিজেট চক্ষু হাসপাতালের কেয়ারটেকার খোকন ও জাহাঙ্গীর পানি বানিজ্য করে ইপিজেট এলাকায়। কমিশনার লেইনে রাসেল স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সকল সরকারী পাম্পকে ম্যানেজ করে চালাচ্ছে পানি বানিজ্য। বিশ থেকে ত্রিশটি ভ্যানে করে তিনি ত্রিশটি ভ্যানগাড়ি করে তিনহাজার থেকে ৭ হাজার লিটার পানি বিক্রি করে। এ ছাড়া নুর নবী, রাসেল, কাসেম, আবদুল, নাছির, হারুন, বাবর আরও অনেকে অবৈধ ওয়াসার পানি বিক্রির সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব সিন্ডিকেট থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পায় কোটি কোটি টাকা।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.