রবীন্দ্র সংগীতে চট্টগ্রাম

আবছার উদ্দিন অলি – 

রবীন্দ্র সঙ্গীত বানী প্রধান গান। এখানে স্বরলিপির বাইরে গিয়ে গাওয়ার সুযোগ নেই। তাই রবীন্দ্র সঙ্গীত শুধু শুনে শেখার নয়। এটি স্বরলিটি দেখে, কথা বুঝে এবং আবেগ মিশিয়ে (প্রয়োজনবোধে) গাওয়া উচিৎ। রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া সংগীত চর্চা যেন অর্থহীন। প্রবাদ আছে, যে শিল্পী রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে সে নাকি অন্যসব গান গাইতে পারে, আসলে কথাটি সত্য। রবীন্দ্র সংগীত চর্চা যারা করেন, তাদের মাঝে এর উত্তর সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। চট্টগ্রামে রবীন্দ্র সংগীত চর্চায় ও সংগীত পরিবেশনা ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। এখানকার শিল্পীরা রবীন্দ্র সংগীতের সুরের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথের গানগুলো চমৎকার করে গেয়ে চলেছেন। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সংস্থা চট্টগ্রামের আয়োজনে প্রতিবছর পালিত হয় রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান। এছাড়াও বেতার টিভিতে নিয়মিত রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান ধারণ ও প্রচার হয়ে আসছে।

গীতবিতান পড়তে পড়তে আমরা হারিয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতে। হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ সবটা জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ। প্রতিটি সকালে ঘুম থেকে উঠেই মায়ের মুখ দেখতে চাই। তাই বিছানা ছেড়ে সোজা চলে যাই মায়ের ঘরে। রাতে ঠিকমতো ঘুম হলো কি-না, সকালে কী খাবে সে বিষয়ে খোঁজখবর নিই। ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক । রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমাদের জীবনের সবকিছু খুঁজে পাই। হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ, জীবন-যাপনের সবটা। জুড়েই থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ২৫ বৈশাখ তার জন্মদিন, কিন্ত তার অস্তিত্ব সারাক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত মানেই যে পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে হবে এমনটা কিন্ত নয়। রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে ধারণ করতে হবে।

বাংলা সাহিত্যের মতোই বাংলা গানের ভুবনেও ধ্র“বতারা রবীন্দ্রনাথ। অনেক গানের কথামালা তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের। তার গানের পসরা অনেক বিশাল। এখনো যখন রবীন্দ্রনাথের কোনো গান যখন কোন শিল্পী গলায় ধারণ করতে যান, তখন যেন সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হারিয়ে যান। আমরা তার গানের ভাণ্ডারে ডুবে আছি। প্রতিটি বাণীই জীবনের সুন্দর বোধ। নিজের মন, সংসার ও সমাজ-সবখানেই রবীন্দ্রনাথের দর্শন চমৎকার।

পাগলা হাওয়াা বাদল দিনে, পাগল আমার মন, তোমার গোপন কথাটি সখি রেখোনা মনে, দু’জনে দেখা হলো মধু যামিনীরে, মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেই ভালো সেই ভালো, আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি, জাগরনে যায় বিভাবরী, আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্ক ভাগী, মধুর বসন্ত এসেছে, জানি জানি তুমি এসেছো এ পথে মনের ভুলে, এসো হে বৈশাখ, দিবস রজনী আমি যেন কার, কেটেছে একেলা, ছুটির বাঁশী বাজলো, ভালবেসে যদি সুখ নাহি, আমার পরান যাহা চায়, আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, তুমি কেমন করে গান, আকাশ ভরা সূর্য্যতারা, এ.কি লাবন্যে পূর্ণ, মোর ভাবনারে কি হাওয়ায়, তুমি সন্ধ্যায় মেঘমালা, অনেক কথা যাওরে বলে, ওরে সাবধানী পথিক, আগুনের পরশ মনি, তোমার গীতি জাগানো স্মৃতি ইত্যাদি। রবীন্দ্র সংগীতগুলো প্রতিটি সংগীত প্রেমী মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। এমন গান শুনতে সবার ভাললাগে।

চট্টগ্রামের বেতার টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীরা হলেন- চমন আফরোজ কামাল, রাজিয়া শাহীদ, কাবেরী সেন গুপ্তা, বিলকিস বানু, আইরিন সাহা, নিলুফার বেগম, প্রভা দেবী, মাহবুবা কামাল, শীলা মোমেন, প্রতিমা ঘোষ দস্তিদার, শাশ্বতী তালুকদার, মার্গারেট বেবী সাহা, সন্ধ্যা ঘোষ দস্তিদার, মীরা ধর, রানী দাশ, সাকিনা সুলতানা, ইন্দিরা সাহা, শামসুন্নাহার রোজী, সংহিতা বনিক, নাসরিন ইসলাম, শিরানী ধর, বনানী দত্ত, রীতা দে, রাশিদা খানম, দসিনা লাবনী, ইন্দিরা চৌধুরী, ফারহানা ফেরদৌস (মিমি), শিপ্রা চৌধুরী, দিলরুবা আহমেদ, শিলা চৌধুরী, মিতা চৌধুরী, জয়শ্রী নন্দী, উষা আচার্য্য, শারমীন নাহার সুলতানা, তাইজিন রহমান, নাসিমা আকতার ডেইজী, লুনা চৌধুরী, আন্না দাশ, মাকসুদা খানম আরজু, সৈয়দা শাহানা পারুল, শুক্লা চৌধুরী, জয়া শহীদ, সীমা রক্ষিত, পল্লবী বড়–য়া, চিত্রা দাশ, রাহনুমা হাসান, সেলিন রডিকা, মোঃ মোস্তফা কামাল, প্রদীপ কুমার চৌধুরী, তুষার কান্তি বড়–য়া, প্রমোদ দত্ত, মোহিতুল আজম, চন্দ্র শেখর দত্ত, গাজী মওদুদুর রহমান, সহিদুর রহমান, অনিরুদ্ধ সেন গুপ্ত, মোঃ আলমগীর কবির, আশীষ কুমার দাশ, প্রদীপ কুমার দাশ, মোঃ আবদুল আউয়াল হেলাল, অজয় দাশ, দিলীপ মজুমদার, অসীম কুমার দত্ত, মোঃ সাইদুর রহমান, এস.এম. হুমায়ুন কবীর, কৃষ্ণ সখা ভট্টাচার্য্য, মোঃ মশিউল আনোয়ার খান, রতন বিশ্বাস, বিপ্লব কুমার চৌধুরী, অচিন্ত্য কুমার দাশ, ঐশ্বর্য দেবী, বৈশাখী দাশ, সালেহা হাবিব স্বর্ণা, রেহনুমা রহমান দিশা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসংখ্যা গান লিখেছেন। গানগুলোতে জীবনের নির্যাস রয়েছে। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে রয়েছে গভীর দর্শন। নিজের জীবনের বিশেষ মুহূর্তেও কিছু গান লিখেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিটি সৃষ্টিকর্মই অনন্য। তার জীবনের কিছু বাঁক রয়েছে। তিনি যা, তার সৃষ্টিকর্মগুলোতেও তার প্রতিফলন হয়েছে। যেমন সুস্পষ্ট ছাপ এসেছে। রবীন্দ্রনাথের ছেলে মারা যাওয়ার পর তিনি লিখেছিলেন, ‘আজ জ্যোৎস্ন্া রাতে সবাই গেছে বনে’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের গীতি নৃত্যনাট্য ‘মায়ার খেলা’ ও বাল্মীকি প্রতিভা’র গান। আর রবীন্দ্রসংগীত আমাদের অঙ্গে জড়িয়ে আছে। তার দর্শন, তার জীবনবোধ সঙ্গে নিয়ে সারাজীবন চলতে চাই। কারণ, তার প্রতিটি ভাবনাই জীবনে বাস্তবতা কিংবা সর্বকালীন বাস্তবতার জীবন-ভাবনা।

রবীন্দ্র নাথের গান আজ পৃথিবী ব্যাপী পরিচিত। রবীন্দ্র সংগীত যারা গেয়ে থাকেন, কিংবা যারা শুনেন, তারা প্রত্যেকই আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের দাবী রাখেন। রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় প্রেম বিরহ, দুঃখবোধ, মায়া, মমতা, হাসি, কান্না আবেগ কিংবা শাষন শোষণ মুক্তির ব্যাপকতা। সেই সাথে রয়েছে নানা কাব্যময়তা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ নিবন্ধ, কবিতা, গীত রচনা, শিশুতোষ লেখা যাই হোক না কেন রবীন্দ্রনাথের সরব উপস্থিতি লক্ষনীয়। রবীন্দ্র নাথ সাহিত্যের সব শাখায় যেমন পারদর্শী ছিলেন, তেমনি সংগীতের সবক্ষেত্রে তিনি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

কথা, সুর বিকৃতি করে কখনো কখনো কোনো কোনো শিল্পী রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করে থাকেন, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক বটে। চট্টগ্রামে নানা কারণে রবীন্দ্র সংগীত চর্চায় কিংবা সাংগঠনিক কর্মকান্ডে ধীরগতি লক্ষ করা গেলেও কখনো কোন অনুষ্ঠান বাদ যায়নি। ছোট পরিসরে হলেও এখানে রবীন্দ্রনাথ স্মরণে সব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে আমাদের যত চিন্তা ভাবনা চেতনা ভালোবাসা সবটুকু যদি যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, রবীন্দ্র সংগীতে চট্টগ্রামের সুনাম ঐতিহ্য অক্ষুন্ন থাকবে।

রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের চলার পথের পাথেয় হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন বিশ্বকবি। সময়ে সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা ও বোধের পরিবর্তন এবং আমার জীবন সঞ্চালন সবই রবীন্দ্র-ভাবনাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। কারণ কবিগুরুর মতো এত বিশাল মাপের একজন মানুষের কর্মযজ্ঞকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমরা কৃতজ্ঞ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি। কারণ, তার সাহিত্য, গানসহ অমর সব সৃষ্টি আজ বাঙালি সত্ত্বাকে পূর্ণতা আর আমার মত ক্ষুদ্র মাপের একজন মানুষের জীবনে আলোকবর্তিকা জ্বেলে দিয়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.