চট্টগ্রামে ইউপি প্রার্থীর দোটানায় আওয়ামী লীগ : বিএনপি ঐক্যবদ্ধ

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

চট্টগ্রামের উত্তর ও দক্ষিন জেলাধীন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে দুটি দল। দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মত অনুষ্টিত এ নির্বাচনে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলে নেতাদের বিরুদ্ধে উঠেছে মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে নেতাদের মধ্যে বেড়েছে দুরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি ও মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে দলের গ্রুপিং। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরা ধানমন্ডীর দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ের সামনে ব্যানার হাতে বিক্ষোভ করেছে। বঞ্চিতদের কারো অভিযোগ স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে আবার কেউ বা জেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন। খবর নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ ও আনোয়ারা-কর্ণফুলী থানা কমিটির নেতারা এখন সম্পুর্ন বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছেন।

বিরোধের জের ধরে আনোয়ারা ও কর্নফুলীর ১৬ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে দুটি পৃথক তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন দুই পক্ষ। উভয় পক্ষের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনোয়ারা ও কর্নফুলী থানা প্রার্থী তালিকা ১৩ এপ্রিল মনোনয়ন বোর্ডে পাঠানো হয়েছে। এর পর জেলা আওয়ামী লীগের তালিকা পাঠানো হয়। এই বিরোধের এক পক্ষে আছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমেদ ও সাধারন সম্পাদক মফিজুর রহমান। অন্য পক্ষে আছেন ভুমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ’র অনুসারী আনোয়ারা উপজেলা ও কর্নফুলী থানা এলাকার নেতারা। বিরোধের জের দলে দক্ষিন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাংচুর করেন আনোয়ারা উপজেলার বিক্ষুব্ধ নেতারা।

এর পর সংবাদ সম্মেলন করে দক্ষিন জেলার দুই নেতার বহিস্কার দাবীও করেন তারা। দক্ষিন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ’ইউপি পর্যায়ে বর্ধিত সভা না করেই একতরফা ভাবে প্রার্থী যাছাই করেছে আনোয়ারা উপজেলা ও কর্নফুলী থানা আওয়ামী লীগ’। কর্নফুলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ বলেন,’ কেন্দ্রের নির্দেশনা মেনে প্রার্থী যাছাই করার পর জেলার দুই নেতা পুনরায় সাক্ষাৎকার আহবান করেন। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমরা আগেই কেন্দ্রের কাছে প্রার্থী তালিকা পাঠিয়েছি। আবার প্রার্থী তালিকায় স্থান পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগে জানা যায়, জেলার তালিকায় জামায়াতের সমর্থকও আছে। আবার জেলার অভিযোগ,’হত্যা মামলার আসামী ও যুদ্ধাপরাধীর সন্তানকে প্রার্থী বাছাই করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ’।

অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ’মনোনয়ন বানিজ্য’ বন্ধের দাবী জানিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডীতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে মনোনয়ন বঞ্চিত ও তাদের সমর্থকরা । মানববন্ধনে তারা অভিযোগ করেন, ’টাকার বিনিময়ে জামায়াত সমর্থিতদের ’ চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নদের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের অনেকে তৃনমুলের সর্বোচ্চ ভোট পেলেও তাদের প্রার্থীতা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্খা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী এ সময় ’মনোনয়ন বানিজ্য’ বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তাদের অভিযোগকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ বলেন, ’যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলেল স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ডাবলুকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

উক্ত মানবন্ধনে বাঁশখালীর ৬নং কাতারিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন চৌধুরী বলেন,’তৃনমুলের ২২ ভোটের মধ্যে ১৪টি ভোট পেয়েছি। কিন্তু টাকার বিনিময়ে নব্য আওয়ামী লীগারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ২নং সাধনপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান মো: আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ’এমপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন যে, আমি তৃনমুলের সর্বাধিক ভোট পেলেও আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। আমি নিয়ম মোতাবেক প্রার্থী মনোনয়নের দাবী করলে তিনি আমার সাথে খারাপ আচরন করেন। ১নং পুকুরিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের যুগ্ন সম্পাদক মো: আকতার হোসেন বলেন ’দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৃনমুলের ভোটে প্রার্থী নির্ধারন করা হয়নি। সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে তারা প্রার্থী নির্বাচন করেছে। আমার জানা মতে, ৩০-৪০ লক্ষ টাকা নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকদের কাছে মনোনয়ন বিক্রি করা হয়েছে। বোয়ালখালী উপজেলার করলডাঙ্গা আহল্লা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন’ টাকার বিনিময়ে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, শুনেছি সে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৫৫নং স্বাক্ষী আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। সে থানার দালাল হিসেবে পরিচিতি। তাদের বাবা চাচারা আলবদর বাহিনীর সদস্য। ১১ নং কালিহাস ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হাফেজ আহমেদ রাজাকার সমর্থিত পরিবারের সন্তান। এ অভিযোগ করেন সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবু তাহের এলএমজি।

দক্ষিন জেলাধীন বিভিন্ন উপজেলায় ও পৌরসভা বিএনপির কমিটি বাতিলের দুই মাস পার হলেও কোন উপজেলা এবং পৌরসভায় বিএনপি আহবায়ক কমিটি পর্যন্ত করতে পারেনি। কমিটি না থাকায় ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির তৃনমুলে দেখা দিয়েছে অষন্তোষ। তৃনমুল বিএনপিকে নিয়ন্ত্রন করার মত উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কর্মকান্ডে বিএনপি ঝিমিয়ে পড়লেও নেতাদের দ্বন্দ্বের শেষ নেই। তবে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক গাজী শাহজাহান জুয়েল পাল্টাপাল্টি দুটি তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন।

জানা যায়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারী বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম.মোরশেদ খানের সভাপতিত্বে বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব মুহাম্মদ শাহজাহান ও তৎকালীন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার, দক্ষিন জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী , সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম, সাবেক সংসদ সদস্য গাজী শাহজাহান জুয়েল, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ সাদাত আহমদ, জেলার সহ-সভাপতি মো: ইদ্রিস মিয়া ও এনামুল হক এনাম, শেখ মো: মহিউদ্দিনের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঢাকার বনানীতে বৈঠক হয়। এ বৈঠকে কমিটি বাতিল করে চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলা বিএনপির আওতাধীন পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ , লোহাগাড়া, বাঁশখালী সহ সকল উপজেলা ও পৌরসভার মেয়াদোত্তীর্ন কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। তবে তুলনামুলক বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।

সম্প্রতি দক্ষিন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক দুজনে ঐক্যবদ্ধভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বসে ঠিক করেছেন জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রার্থী তালিকা। জানা গেছে, পঞ্চম ধাপে সারাদেশে ৭৩৩টি ইউপির মধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় ১২, বোয়ালখালীর ৭ ও চন্দনাইশের ৭ টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্টিত হতে যাচ্ছে। আগামী ২৮ মে অনুষ্টিতব্য এ নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগে যখন হযবরল অবস্থ তখন বিএনপি এক ঘা দেখিয়ে দিলেন! তাদের প্রার্থী তালিকায় রাঙ্গুনিয়ার উত্তর রাজানগর ইউপিতে করিম সওদাগর, পারুলিয়াতে জহির আহমদ, পোমরায় আজিজুর রহমান, বেতাগীতে কাজি নাজিম, সরফভাটায় সৈয়দ নুর, পদুয়ায় নইম উদ্দিন, কোদালায় বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল আজিম, ইসলামপুরে মো: পেয়ার চেয়ারম্যান, দক্ষিন রাজানগরে আলমগীর শাহ, লালানগরে মিজানুর রহমান ও হোসনাবাদে সেকান্দর হোসেন পেয়েছেন বিএনপির মনোনয়ন।

বোয়ালখালী উপজেলায় শাকপুরায় শওকত আলী, সরোয়াতলীতে এম নুর মোহাম্মদ চেয়ারম্যান, পোপাদিয়ায় জাবেদ হাসান মেহেদি. চরনদ্বীপে মজিবুত উল্লাহ মজু, শ্রীপুর খরনদ্বীপে হাজী ইকবাল, আমুচিয়ায় মোসলেম উদ্দিন, আহলা করলড্ঙাায় হামিদুল হক মনোনয়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া পটিয়ার আশিয়ায় মোজাম্মেল হক চৌধুরী, কচুয়াইয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বাবু, ধলঘাটে নুরুল ইসলাম করিম, হাইদগাঁয়ে ইউনুচ মিয়া, কেলিশহরে বর্তমান চেয়ারম্যান মাষ্টার জসিম উদ্দিন, ছনহরায় আবদুর রশিদ, দক্ষিন ভুর্ষিতে নুরুল আকতার, ভাটিখাইনে রিদুয়ানুল হক, কাশিয়াইশে মোহাম্মদ কায়েস, জঙ্গলখাইনে আবুল মনছুর শরীফ, খরনায় বর্তমান চেয়ারম্যান মফজুল আহমদ চৌধুরী, কোলগাঁওয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম, বড়লিয়ায় কাউচার আলম রনি, জিরিতে আবুল হোসেন বাবুল, হাবিলাশদ্বীপে বর্তমান চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, কুসুমপুরায় বর্তমান চেয়ারম্যান রেজাউল করিম নেচার, বড় উঠানে মোহাম্মদ আলী মুন্সি, জুলধায় আবদুল কাদের, চরলক্ষ্যায় ইব্রাহীম মিয়া, চর পাথরঘাটায় এম মইন উদ্দিন, শিকলবাহায় ফারুক সওদাগর ও শোভনদন্ডীতে শামসুল আলমকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া চন্দনাইশে কাঞ্চনাবাদে সাইফুল করিম, জোয়ারায় মোসলেম উদ্দিন, বরকলে এডভোকেট আমিনুল হক চৌধুরী, বরমায় আ.খ.ম মোজাম্মেল হক, বৈলতলিতে মফিজ উদ্দিন, হাশিমপুরে আবদুল মজিদ, ধোপাছড়িতে জে এইচ সেলিমকে বিএনপির দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, বিএনপির প্রার্থী মনোনয়নে প্রায় ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যানদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগে প্রায় সব ইউনিয়নে এসেছে নতুন মুখ।

অভিজ্ঞ, দক্ষ, ত্যাগী রাজনীতিকদের প্রতি করা হয়েছে অবজ্ঞা। এর খেসারত দিতে হতে পারে ভবিষ্যতে। ইতিমধ্যে জানা গেছে, ’বাঁশখালীর সাধনপুরের বর্তমান চেয়ারম্যান আহছান উল্লাহ চৌধুরী ও পুকুরিয়ার বর্তমান চেয়ারম্যান আকতার হোসেন আরও কয়েকটি ইউনিয়নে বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানদের অনেকে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একই ভাবে আনোয়ারা, পটিয়া, কর্নফুলী, বোয়ালখালী, সাতকানিয়া-লোহাগাড়াতে একাধিকর বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন। চন্দনাইশের ৫টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, ’দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত প্রার্থীরা মনোনয়ন না পাওয়া, হাইব্রীড় আওয়ামী লীগারদের প্রার্থী করা, বিএনপি-জামায়াত পন্থীদের কদর, মনোনয়ন বানিজ্য এসব কারনে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিনের আওয়ামী লীগের জন্য অপেক্ষা করছে চরম দু:সময়।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.