চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) রাজস্ব বিভাগ প্রণীত ১০৩৩টি অবৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন নবনির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, এই পরিসংখ্যান শতভাগ সঠিক নয়। প্রতিদিনই তো বিলবোর্ডের সংখ্যা বাড়ছে। এসময় মেয়র নগরীতে বিদ্যমান ৪২৯টি বৈধ বিলবোর্ডের ক্ষেত্রে অনুমোদিত আকারের চেয়ে বড় এবং নির্ধারিত স্থানের পরিবর্তে অন্য স্থানে স্থাপন করা হয়েছে কী না তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। মেয়র বলেন, অনুমোদিত আকারের চেয়ে বড় বা নির্ধারিত স্থানের বদলে অন্য কোন জায়গায় স্থাপন করা বিলবোর্ডকেও অনুমোদনহীন বলে গণ্য করা হবে। এ সময় তিনি নগরীর সবগুলো বিলবোর্ডই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।
নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউটে গতকাল সকালে চসিকের রাজস্ব ও স্টেট বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময়কালে এমন কথা বলেন নবনির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এসময় তিনি দায়িত্বগ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত নতুন করে কোন বিলবোর্ড অনুমোদন এবং নবায়ন না করার নির্দেশ দেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে। সভায় চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আহমুদুল হক বলেন, বিলবোর্ড উচ্ছেদ করতে গেলে অনেক প্রতিষ্ঠান মামলা করে। বন্দর এবং রেলওয়ের জায়গাও অনেক বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এসময় মেয়র বলেন, ‘মামলা করলে এসব আমি নিজে মোকাবেলা করব। বিলবোর্ড উচ্ছেদের বিষয়ে আপনারা কঠোর হন। এ বিষয়টা দ্রুত সমাধান করতে হবে। বন্দর, রেলওয়ে ইচ্ছে করলেও বিলবোর্ডের অনুমোদন দিতে পারবে না। শহরের মধ্যে বিলবোর্ডের অনুমোদন দিবে সিটি কর্পোরেশন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে উদ্দেশ্য করে মেয়র বলেন, আপনাকে কঠোর হতে হবে। যত প্রভাবশালীই হোক না কেন বিলবোর্ড উচ্ছেদে কাউকে ছাড় দিবেন না। আপনি অভিযান শুরু করেন। প্রয়োজনে আগামীকাল থেকে শুরু করেন। কে মন্ত্রীর স্বজন বা কে প্রভাবশালীর স্বজন তা দেখবেন না। এ ক্ষেত্রে আপনাকে মাইন্ড সেটাপ করতে হবে। অবৈধ বিলবোর্ড হলেই উচ্ছেদ।
সভায় বিলবোর্ড খাতে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আহমদুল হক জানান, গত দুই বছর ধরে বিলবোর্ড নবায়ন করা হচ্ছে না তাই রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। তখন মেয়র বলেন, নবায়ন না করলে তো সব অবৈধ হয়ে গেছে।
সাবেক মেয়রদের মধ্যে কার আমলে কয়টি বিলবোর্ড অনুমোদন দেয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তালিকা করার নির্দেশ দিয়ে মেয়র বলেন, মনজুর আলম আমাকে জানিয়েছিলেন তিনি কোন বিলবোর্ড অনুমোদন দেন নি।
রাজস্ব কম আদায় হওয়া প্রসঙ্গে :
চলতি অর্থ বছরে এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয় নি উল্লেখ করে মেয়র বলেন, অবশিষ্ট ৩৫ দিনের মধ্যে যে কোন উপায়ে টার্গেট পূরণ করতে হবে। জুনের পর আমি কড়াগণ্ডায় বুঝে নেব। তাই এখন থেকে শুধু নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করলে হবে না। ঘুম হারাম করে কর আদায় করেন। আ জ ম নাছির আরো বলেন, সিটি কর্পোরেশনের প্রাণ হচ্ছে রাজস্ব বিভাগ। এটার উপর নির্ভর করছে সবকিছু। ঠিকভাবে রাজস্ব আদায় করতে না পারলে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা তো দূরের কথা আপনাদের বেতনও বন্ধ হয়ে যাবে।
এ সময় রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা লোকবল সংকট রয়েছে বললে, সচিব রশিদ আহমদ বলেন, “আমার জানা মতে দুইজনকে লাইসেন্সে পদায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু পদ খালি না থাকায় তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। বর্তমানে তারা পরিচ্ছন্ন বিভাগে আছেন। অথচ আজ বিভিন্ন সার্কেলে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে’। এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তাদের ইঙ্গিত করে বলেন, আদায়কারীদের তদারক করা হয় না বলেই কর আদায় হয় না। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ জানে না কোন এলাকার নির্ধারিত ট্যাক্স কত। জানলে নিজেরাই নিজেদের এসেসমেন্ট করতে পারতো। এ বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। লিফলেট, মাইকিং এবং পোস্টারিং করা হবে।
সভায় সার্কেল কর্মকর্তারা কয়েক মাস ধরে উত্তর পতেঙ্গা এবং মুনির নগর এলাকায় কর আদায়কারীর কর্মচারী নেই জানালে সচিব বলেন, ‘অনেকে অনেক বিষয় গোপন করেন। আপনারা আমাদের কাছে রিপোর্ট করেন নি। কর্মক্ষেত্রে ১০দিন অনুপস্থিত থাকলে অব্যাহতি দিই’।
কর কর্মকর্তাদের প্রস্তাব :
জুন মাসে সারচার্জ মওকুফ করার প্রস্তাব দেন কর কর্মকর্তা একেএম সালাউদ্দিন। এরপরেও কর পরিশোধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে ক্রোকি পরোয়ানা জারির নির্দেশনা চান তিনি। এসময় উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বনানী কমপ্লেক্সে ক্রোকি পরোয়ানা জারির পর শহরের অনেকেই ভীত হয়ে হোল্ডিংয়ের পুরোনো বকেয়া পরিশোধ করে। তিনি বর্তমান কর দাবি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নয় দাবি করে বলেন, এটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে হবে। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ারও অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, এখানে কেউ কাউকে মানে না। চেইন অব কমান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তিনি মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানান। একইসাথে সব কর্মকর্তা–কর্মচারির একই মোবাইল কোম্পানির নম্বর থাকতে হবে যা কেন্দ্র থেকে ট্রেকিং হবে। কর আদায়ের জন্য তিনি প্রত্যেক ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে প্রভাবশালীদের সাথে নিয়ে কমিটি করারও প্রস্তাব দেন। আর সরকারি হোল্ডিংগুলোর কর আদায়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রী পর্যায়ে যোগাযোগ করতে হবে।
মেয়র তার প্রস্তাবগুলির সাথে একমত পোষণ করে বলেন, যারা বেশি প্রভাবশালী তাদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে একবার যোগাযোগ করে কর পরিশোধের অনুরোধ করব। তারা যদি এই সুযোগ না নেন। তখন আইনগতভাবে ক্রোকি পরোয়ানা জারি করা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ গাড়ি না থাকার অভিযোগ করেন। কেউ বলেন, তাদের কনভেন্স প্রয়োজন। কেউ অস্থায়ী থেকে স্থায়ী হতে চান। কেউ বলেন কর্মক্ষেত্র দূরে। তখন মেয়র বলেন, আপনারা জেনে বুঝে এই চাকুরিতে প্রবেশ করেছেন। কর্পোরেশন আপনাদের কাউকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে চাকরি দেয়নি। তাই দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এখানে কোন অজুহাত চলবে না। চলতি অর্থ বছরে যে সময়টুকু আছে তাতে দিনরাত কাজ করে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে হবে। উপস্থিত কর্মকর্তা–কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের আইনগত সুযোগ–সুবিধা আমি যথাসম্ভব নিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদনে অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলব।
বিরোধপূর্ণ জায়গা প্রসঙ্গে :
যাচাই–বাছাই না করে চসিকের এস্টেট শাখায় বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ জায়গা বায়নানামা করায় প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে এর কারণ জানতে চান মেয়র। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আহমুদুল হককে উদ্দেশ্য করে মেয়র বলেন, বাইরে আপনাকে নিয়ে প্রচুর কানাঘুষা আছে। কোন কিছুই আমার অজানা থাকবে না। অনেক কিছু জানি। যা জানিনা তা–ও জেনে নিত পারবো। তবে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করব না। নির্বাচনের পর থেকে কোন ধরনের অনিয়ম করলে রক্ষা পাবেন না। প্রতিত্তুরে আহমুদুল হক বলেন, সাবেক মেয়রের আমলে এমনটি হয়েছে। এ সময় মেয়র ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আপনি কি করেছেন তখন। আপনি তো দায়িত্বে ছিলেন। বিরোধপূর্ণ জায়গা বায়না নামা করায় মামলা হয়েছে। চসিক কেন মামলার ব্যয় বহন করবে? এ সময় তিনি কোন মেয়রের আমলে কোন জায়গাটি বায়না করা হয়েছে তা প্রতিবেদন আকারে জানানোর নির্দেশ দেন। একইসাথে কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে চুক্তি বাতিল ও টাকা ফেরত নেয়ার নির্দেশ দেন মেয়র। মেয়র বলেন, নিষ্কণ্টক না হলে জায়গা নেব কেন? টাকা দিয়ে ঝগড়া কিনব কেন?।
সভায় মেয়র বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের নির্মাণ কাজ বন্ধের কারণ জানতে চান। মেয়র বলেন,‘ মানুষের অভিযোগ রয়েছে, কর্মকর্তাদের কারণেই কাজ বন্ধ আছে। কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রকল্পগ্রহণের আগে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চবিলাসী কোন কিছুই ঠিক নয়। এ সময় মেয়র চসিকের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন মার্কেটগুলোর সর্বশেষ অবস্থা প্রতিবেদন আকারে জানাতে নির্দেশ দেন।
ঠিকাদারদের ক্ষমতা রহিত :
সভায় মেয়র ঠিকাদারদের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের প্রত্যায়নপত্র দেয়ার ক্ষমতা রহিত করা হবে বলে ঘোষণা দেন।
সিজেকেএস এর বকেয়া প্রসঙ্গে :
সিজেকেএস এর কাছে কর্পোরেশনের প্রায় দুই কোটি টাকা পাওনা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, এব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করুন। আইনগতভাবে যা দিতে হয় তা দিব। অতীতেও আমি এ বিষয়ে সাবেক মেয়রের সাথে বসে বিষয়টি সমাধান করতে চেয়েছিলাম। এসময় মেয়র বলেন, পত্রিকায় সিজেকেএসের বকেয়া প্রসঙ্গে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। উনারা মজা পান বলেই এটা বোল্ড করে দেন। প্রসঙ্গত, গত ১৭ মে দৈনিক আজাদীর প্রতিবেদনে চসিক সিজেকেএস এর কাছে কর বাবদ ১৭ কোটি ৭৯ লক্ষ ২৩ হাজার ১৭৫ টাকা বকেয়া পাবেন উল্লেখ করা হয়েছিল। মেয়র সিজেকেএস এর সাধারণ সম্পাদক।
আমি বিকৃত মানসিকতার নয় :
সভায় মেয়র আরো বলেন, আমি বিকৃত মানসিকতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ নই। তবে আমার কাজে কেউ বাধা দিলে, নির্দেশ না শুনলে তখন আমি চুল পরিমাণ ছাড় দিই না। আমি নিজেও চুল পরিমাণ অনিয়ম স্বজনপ্রীতি করব না। আজ একথাগুলি বলছি একারণে যে, আমাকে সবাই ভালভাবে জানেন না বা একেকজন একেক রকমভাবে জানেন।
আ জ ম নাছির আরো বলেন, কেউ যদি মনে করেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কিংবা এম মনজুর আলমের সঙ্গে আত্মীয়তা বা ঘনিষ্টতা থাকায় অন্যায় করেও পার পাবেন। তাহলে আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আল্লাহ এবং রসুল(দ.) এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আমি আর কারো কথা শুনি না।
নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, অতীতে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী যতবার মেয়র নির্বাচন করেছেন, ততবারই তিনি নিজেকে নিজেই প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তাই আমাকে সফল করার জন্য যা যা দরকার তিনি সবকিছুই করবেন।
প্রসঙ্গক্রমে মেয়র বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ চসিকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুইটি বিভাগ চসিক না করলেও সরকার করতো। এই দুইটি বিভাগ যখন গঠন করা হয়, তখন হয়তো সবার ভাল লেগেছিল।
ঠেলাগাড়ি ও ভ্যান প্রসঙ্গে :
ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি চালক–মালিকদের কাছ থেকে কর আদায় না প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে ওরা অনেক কষ্ট করেন। মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের কর মওকুফ করা যায় কী না ভেবে দেখা উচিত। এ সময় তিনি ঠেলাগাড়ি ও ভ্যানগাড়ির কর মওকুফ করার বিষয়ে আইনগত সুযোগ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে।
বিএসআরএম এর সৗ্যাব প্রসঙ্গে :
সভায় মেয়র বায়েজিদ এলাকায় বিএসআরএম কারখানার সামনে ফুটপাতে স্ল্যাব বসানো হয়েছে উল্লেখ করেন মেয়র। ওই স্ল্যাব বসানোর ক্ষেত্রে অনুমতি মানা হয় নি উল্লেখ করে মেয়র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে তা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। এদিকে বিকেলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিয়া শিরিন ওই এলাকায় অভিযান চালালেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।