সিটি কর্পোরেশনে বিরাজমান সকল নিয়ম কানুন ঢেলে সাজানো হবে – আ জ ম নাছির

0

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইন কর্মকর্তা ও বিজ্ঞাপন ও প্রমোদকর বিভাগের সাবেক পরিদর্শকের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নবনির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে কর্মরত সচিবদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি। অযোগ্য ব্যক্তিকে ‘ওয়ার্ড সচিব’ পদে নিয়োগ দেয়ায় এবং দীর্ঘদিন ধরে ওইসব সচিবকে বদলি না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চসিকের সচিবালয় বিভাগের অধীন জনপ্রশাসন, হিসাব বিভাগ, জনসংযোগ, আইন, নিরাপত্তা, নেজারত ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখাসমূহের কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে মতবিনিময় করেন আ জ ম নাছির উদ্দিন। এসময় তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং সংশ্লিষ্টদের ভর্ৎসনা করেন। সভায় মেয়র কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, এখন বৈঠক করে আমার মনোভাব জানিয়ে দিচ্ছি। দুই মাস সময় আছে। এর মধ্যে নিজেদের সংশোধন করেন। যেদিন চেয়ারে বসব সেদিন থেকে কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দেব না। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সভা থেকে মেয়র নগরীর মহেশখাল খননের জন্যও নির্দেশ দেন।

কার পক্ষে কাজ করেন : সভায় আইন কর্মকর্তা সরওয়ারই আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি কার পক্ষে কাজ করেন। সিটি কর্পোরেশন নাকি পার্টিগুলোর পক্ষে। দায়িত্ব পালনের সময় এ পর্যন্ত কয়টি মামলা জিতেছেন। বাইরে কিন্তু আপনার নামে কানাঘুষা আছে।

প্রত্যুত্তরে আইন কর্মকর্তা মেয়রকে বলেন, শতকরা ৮০ ভাগ মামলা জিতেছি আমরা। এসময় তিনি কর্পোরেশনের হয়ে মামলা লড়েন বলেও জানান। তখন মেয়র বলেন, প্রমাণ কই? বাইরে তো শোনা যায় আপনি পার্টির পক্ষে মামলা লড়েন। সেজন্যই তো কর্পোরেশন মামলা জিততে পারে না। এ পর্যন্ত যত মামলা জিতেছেন এবং হেরেছেন তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণী কালকের মধ্যে জমা দেবেন।

আপনি নাকি জনপ্রিয়! : সভার শুরুতে বিজ্ঞাপন ও প্রমোদকর বিভাগের সাবেক পরিদর্শক আবুল মনসুর নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি সংস্থাপন শাখায় সংযুক্ত আছি। তখন মেয়র প্রশ্ন করেন, আগে কোথায় ছিলেন? মনসুর বলেন, বিজ্ঞাপন ও প্রমোদকর শাখায় ছিলাম। তখন বদলির কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রীর নির্দেশে বদলি করা হয়েছে বলে জানান। এসময় মেয়র বলেন, মন্ত্রী বললেই বদলি হয় নাকি। আপনি তো অনেক জনপ্রিয়। শেখ হাসিনাখালেদা জিয়াও এত জনপ্রিয় নন। এসময় আবুল মনসুর বলেন, পত্রিকায় লেখালেখির কারণে স্যার।

পরে মেয়র বলেন, পত্রিকা কি এমনি এমনি লিখে? আপনার সঙ্গে কি তাদের শত্রুতা আছে? কালকেও দেখলাম নগরীতে বৈধ বিলবোর্ডের চেয়ে অবৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা বেশি। এক পর্যায়ে মেয়র প্রশ্ন করেন, বিলবোর্ড মালিকদের কাছ থেকে কত টাকা করে নিয়েছেন? আবুল মনসুর বলেন, এক টাকাও নিইনি স্যার।

বিলবোর্ড প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, নগর পরিকল্পনাবিদ দ্বারা পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিলবোর্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে আকাশ, ভবন, পাহাড় ঢেকে দেয়ার বিষয়সহ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও ঝুঁকির বিষয়কেও গুরুত্ব্ব দেয়া হবে।

ওয়ার্ড সচিবদের বদলির নির্দেশ : সভায় মেয়র ওয়ার্ড সচিব সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেক ওয়ার্ডে শ্রমিক ও নিরাপত্তা প্রহরীরা ওয়ার্ড সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। এসব ওয়ার্ড শ্র্রমিকদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই ৩ বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানানো হয়। কোনো কোনো ওয়ার্ড সচিব সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডগুলোতে ২০ থেকে ২৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন বলে জানানো হয়।

এসময় মেয়র বিগত প্রশাসন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি বলে মন্তব্য করেন। মেয়র বলেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দরখাস্ত আনলেই চাকরি দিয়ে দিয়েছেন। এসময় এক ওয়ার্ডে তিন বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত ওয়ার্ড সচিবদের বদলির নির্দেশ দেন।

সভায় জানানো হয়, ৯ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের নিরাপত্তা প্রহরী শেখ ছৈয়দুর রহমান দুই বছর ধরে ওই ওয়ার্ডের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। ৩১ নং আলকরণ ওয়ার্ডে সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন নিরাপত্তা প্রহরী আবুল কাশেম রাশেদ। ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে এমএলএসএস মো. ফোরকান, ৩৭ নং উত্তর মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে অবসরপ্রাপ্ত বখতেয়ার ওয়ার্ড সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানানো হয়।

অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা প্রসঙ্গে : মেয়র চসিকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের কাছে জানতে চান, অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের পেনশন ও আনুতোষিক বিল ঠিকমতো দেয়া হয় কিনা। তখন হিসবারক্ষণ কর্মকর্তা বলেন, ফান্ড থাকলে দেয়া হয়। এসময় মেয়র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকর্মচারীদের পেনশন, আনুতোষিক বিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করার এবং তাদেরকে যাতে হয়রানি না করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেন।

মহেশখাল খননের নির্দেশ : জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য মেয়র নগরীর মহেশখাল খননের নির্দেশ দেন। মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা অনেক প্রকট আকার ধারণ করেছে। জলাবদ্ধতা শুধু বর্ষা মৌসুমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চট্টগ্রামের কোথাও দুইচার ঘণ্টার বেশি পানি জমে থাকে না। আলোচনা করতে করতে এটিকে নগরের প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এসময় তিনি নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের নালানর্দমাগুলো পরিদর্শন করে কী কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন।

সভায় মেয়র বলেন, নালানর্দমার ওপর অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা ও স্ল্যাব অপসারণ জোরদার করা হবে। চাক্তাই খাল, মহেশখালসহ সবগুলো খাল সরেজমিনে পরিদর্শন করব। যেখানে প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়বে সেখানেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হবে।

আ জ ম নাছির আরো বলেন, সিটি কর্পোরেশনে বিরাজমান সকল নিয়ম কানুন ঢেলে সাজানো হবে। বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। তিনি নিয়োগ বিধি চূড়ান্তকরণ, অনিয়মিত পদায়ন রহিতকরণ এবং চাকরির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দায়িত্বশীলদের আন্তরিক হওয়ার নির্দেশ দেন।

মেয়র বলেন, জুলাই থেকে পেস্কেল কার্যকর হওয়ার সাথে অস্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনভাতাও যৌক্তিক নিয়মে বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, কেউ কেউ সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে সিটি কর্পোরেশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন, যা কাঙিক্ষত ছিল না।

সভায় মেয়র সেবকদের নিরাপত্তা উপকরণ দেয়া এবং তাদের সাথে বৈঠক করে তাদের ডিউটি ও নিরাপত্তার বিষয়ে অবহিত করা হবে বলে জানান। তিনি বলেন, প্রতি মাসে প্রায় ৯ কোটি টাকা বেতনভাতা দিয়ে সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত হয়। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক্ত সকলকে শত ভাগ সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তদবির, দলীয় পরিচয়, আত্মীয়তার কোনো স্থান এখানে হবে না। মেয়র বলেন, কর্মকর্তাকর্মচারীদের ন্যায্য পাওনার মধ্যে টাইম স্কেল, প্রমোশন কোনোটাই বাধাগ্রস্ত হবে না।

তিনি বলেন, আমি অন্তরে যা ধারণ করি মুখে তাই বলি এবং শত ভাগ বাস্তবায়ন করি। আমি কারো দ্বারা পরিচালিত হই না। পবিত্র রমজানে রোজাদারদের পুঁজি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, ভেজাল দেয়া, ফরমালিন মেশানোর মতো কোনো ধরনের অনিয়ম যাতে সংঘটিত হতে না পারে সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া ফুটপাত দখল, যত্রতত্র পার্কিং, যানজট সৃষ্টি, মাদকদ্রব্য ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে জনস্বার্থে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী শফিউল আলম। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র লায়ন মোহাম্মদ হোসেন, সচিব রশিদ আহমদ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিয়া শিরিন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, আইন কর্মকর্তা সরওয়ার ই আলম, উপসচিব সাইফুদ্দিন মাহমুদ কাতেবী, জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবদুর রহিম, নিরাপত্তা কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন ও আইটি অফিসার মো. ইকবাল হোসেন।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.