দৃশ্যত রাষ্ট্রই কাঠগড়ায় রয়েছে : ড. মিজানুর রহমান

ড. মিজানুর রহমান বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ২০১০ সালে। তিন বছর করে দুই মেয়াদে টানা ছয় বছর ওই পদে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি আবার অধ্যাপনায় ফিরছেন। ২০১০ সালে তিনি সার্ক অঞ্চলের মর্যাদাসম্পন্ন ‘অধ্যাপক এন আর মাধব মেনন শ্রেষ্ঠ আইন শিক্ষকের’ খেতাবে ভূষিত হন। মস্কোর ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ও পিএইচডি করে ১৯৮৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রতিবেদক : রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের সঙ্গে দেয়ালে টাঙানো আপনার ছবির সঙ্গে আপনার পাওয়া অনেক পদকের মধ্যে গান্ধী ও ম্যান্ডেলা পদকও দেখা যাচ্ছে। এই দুজনের মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজকের বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

মিজানুর রহমান : তাঁরা যেভাবে মানুষের মর্যাদাকে দেখেছেন ও অনুশীলন করে গেছেন, সেটা বর্তমান বাংলাদেশে নেই। মানুষের মানবিক মর্যাদা যদি মানবাধিকারের প্রাণ হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে বিরাট ঘাটতি আছে। আত্মস্থ করতে হবে যে সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

প্রতিবেদক : কিন্তু মানুষ তো আমরা ভাগ করে ফেলেছি। বিএনপির মানুষ, জামায়াতের মানুষ, স্বাধীনতার পক্ষের-বিপক্ষের মানুষ ইত্যাদিতে।

মিজানুর রহমান : অনেকে বলেন, আমার নখ–দাঁত দরকার, আমি কাউকে আঁচড় দিতে পারি না, কাউকে কামড়াতে পারি না। কিন্তু সত্যিই নখ–দাঁত দরকার নেই। আসল দরকার হলো কথা যাদের উদ্দেশে বলা, তারা সেটা গুরুত্বের সঙ্গে মানছে কি না। যেখানে সমালোচনা সহ্য হয় না, পরমতসহিষ্ণুতা নেই, ভিন্নমতের প্রতি গুরুত্ব থাকে না, সেখানে গণতন্ত্র নেই।

প্রতিবেদক : আপনার সময়ে দেশে গুম এলেও কোনো তদন্ত করেননি।

মিজানুর রহমান : জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে আমাদের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছি। সরকার বলেছে গুম হচ্ছে না। আমরা বলেছি গুম হচ্ছে। আমরা লুকাইনি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তফাত করেছি। আর ২০০৯ সালের আইন বলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা কমিশন তদন্ত করতে পারবে না। আমাদের কাছে আসা অভিযোগগুলোতে নির্দিষ্টভাবে পুলিশ বা র‌্যাবের নাম এসেছে। তাই আইন দ্বারা আমরা বারিত।

প্রতিবেদক : আপনি তাহলে রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় রেখে যাচ্ছেন!

মিজানুর রহমান : আমি একমত যে রাষ্ট্র দৃশ্যত কাঠগড়ায় রয়েছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উল্লেখ করে বলেছি এ বিষয়ে তদন্ত করে কমিশনকে জানাতে। ইলিয়াস আলীর বিষয়ে আমরা তদন্ত চেয়েছিলাম। সংসদে তুলতে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির কাছে ২৩টি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত চেয়ে কোনো খবর না পাওয়ার একটি তালিকা হস্তান্তর করেছি। কোনোটিতে ২২ বারও তাগাদাপত্র দিয়েছি স্বরাষ্ট্রকে, একটিবারও উত্তর পাইনি।

প্রতিবেদক : আইন আপনাকে সুযোগ দিয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলায় পক্ষভুক্ত হতে। কেন হননি?

মিজানুর রহমান : গত ছয় বছরে শুধু সাগর-রুনির মামলায় হয়েছি। বিনা বিচারে আটকে রাখা জনৈক তানভিরকে মুক্ত করেছিলাম।

প্রতিবেদক : সম্প্রতি ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বাড়ল কেন? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে গুম এল।

মিজানুর রহমান : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সবাই সোচ্চার হওয়ার পর এটা কমেছিল। গুম কিন্তু গুয়াতেমালাতেও এসেছে। তাদের মিল ওটাই, প্রতিবাদের মুখে পরিবর্তন এল।

প্রতিবেদক : বিচারবহির্ভূত হত্যা ছাড়া সত্যিই কি রাষ্ট্র চলতে পারে না? এর বদল কীভাবে?

মিজানুর রহমান : বিচার যদি বিকিয়ে দিতে না হতো, বিচার যদি পেশি, রাজনীতি ও অর্থের কাছে বন্দী না থাকত, তাহলে বিকল্প পথের সন্ধান করা দরকার ছিল না। বদলানোর প্রসঙ্গে বলব বিচারিক স্বাধীনতা আমি বজায় রাখি কি না। নিজকে পরাধীন রাখতেই উৎসাহী কি না।

প্রতিবেদক : সংবাদক্ষেত্র ও বাক্‌স্বাধীনতা খর্বিত হচ্ছে?

মিজানুর রহমান : সমাবেশের স্বাধীনতার চেয়ে এখন বাক্‌স্বাধীনতা বেশি। বিএনপি-জামায়াতের বিবৃতি মিডিয়ায় আসে, তাদের সমাবেশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নার্স ও শিক্ষকদের সঙ্গেও আমরা সদাচরণ দেখিনি।

প্রতিবেদক : গত ছয় বছরে আপনার অনেক উক্তি হেডলাইন হয়েছে। কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার, সেভাবে কিছু আসেনি! আপনি এই সমালোচনা নেবেন কি?

মিজানুর রহমান : নেব না। তার কারণ আমরা কখনো কারও রাজনৈতিক পরিচয় দেখিনি।

প্রতিবেদক : পেট্রলবোমার সময় আপনি শক্তি প্রয়োগের পক্ষে বলেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো বিচার বিভাগীয় সম্পৃক্ততা পেলাম না। এটা রাষ্ট্রের অসামর্থ্য নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?

মিজানুর রহমান : আপনার এই সমালোচনার সঙ্গে অনেকটাই একমত হব। তাদের সামর্থ্য নেই সেটা বলা সম্ভব নয়। দু-একটা ক্ষেত্রে তারা দেখিয়েছে তারা পারে। অভিজিৎ খুনের পরে এফবিআই এল। ভাবলাম এবার কারও রক্ষে নেই। তাহলে কি তাদেরও সামর্থ্য নেই? এ কারণে আমারও প্রশ্ন এটা কেন, তাহলে কি তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে? বরং একে কখনো কখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমার কাছে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই যে এর সঠিক কোনো উত্তর দেব।

প্রতিবেদক : ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চলমান হত্যাকাণ্ডকে কীভাবে দেখছেন?

মিজানুর রহমান : সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি, একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। যখন একটা সমাজ পুরোপুরি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন এটা বলা সহজ হয় যে কোনো কিছুই আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।

প্রতিবেদক : সাধারণ নির্বাচন বা তেমন ধরনের কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন কি এ থেকে উতরাতে সহায়ক, নাকি তা সংকটকে আরও গভীর করবে?

মিজানুর রহমান : জামায়াত তার লোগো বদলাচ্ছে কিন্তু এখনো একাত্তরের অবস্থান বদলায়নি। আপনি পেট্রলবোমা মারলেন, ভুল স্বীকার করলেন না, এটা না করা পর্যন্ত আমি আশ্বস্ত হতে পারি না যে এর পুনরাবৃত্তি করবেন কি না।

প্রতিবেদক : সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইলাম মনে করেন সন্ত্রাসবাদের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বেশি প্রকট শাসনগত সমস্যা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে বাক্‌স্বাধীনতা ও মানবাধিকার দুটোই অবনতিশীল?

মিজানুর রহমান : আমি পুরো একমত নই। আমি তো দাবি করি না শাসনগত ত্রুটি নেই। আর বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে হয়তো অবনতিশীল বলা যায়। বৈশ্বিক অবস্থা থেকে দেখলে তাদের ব্যাখ্যাটা হয়তো ওই জায়গায় থাকে না। ইউরোপ ও আমেরিকার কারণেই উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বললে কি অন্যায় বলব? আমরা আজ যেখানে নিপতিত, তার মূলে দেখি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আপনি ঢুকে পড়লেন।

প্রতিবেদক : কিন্তু এমনটা মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্য কোনো জাতি একতরফা নির্বাচন করেছে কি? বিএনপিকে দায়ী করলেও তো জাতি হিসেবে দায়মোচন ঘটে না। তাই বাংলাদেশ এখানে একা।

মিজানুর রহমান : সেটা আপনি বলতে পারেন।

প্রতিবেদক : সাঁড়াশি অভিযানে ১০ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার যে হলো তা সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন মতে হলো কি?

মিজানুর রহমান : না। এটা আদালত অবমাননাকর। সে জন্য আদালতের তরফে রি-অ্যাকটিভ নয়, প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা আরও বেশি আশা করি। ৪০ ‘জঙ্গি’ আটকাতে ৪০০০ মানুষ আটকানোর পর প্রশ্ন করলে যদি জবাব দিই যে এদের সবার নামে মামলা আছে, সে যুক্তি অচল। কারণ, মামলা থাকাই একজনকে আটক করার জন্য যথেষ্ট নয়, মামলা থাকা মানে অপরাধী হওয়া নয়।

প্রতিবেদক : সরকার দ্বারা আপনার না মানা সুপারিশের তালিকা দীর্ঘ। ছয় বছরে আপনার ছয়টি মাইলফলক অর্জন বলুন।

মিজানুর রহমান : সারা দেশে পাচক বা রাঁধুনির পদ সৃষ্টি করে তাতে শিশুশ্রম বন্ধ করা। শিশুদের বয়স ১৮ বছর করা। বিজিবি ক্যাম্প করার সময়ে বাঘাইছড়িতে উৎখাত করা ৩০টি পরিবারকে পুনরায় বাস্তুভিটায় ফেরানো, দলিতদের প্রশ্নে বৈষম্য নিরোধসংক্রান্ত আইনের খসড়া হলো কিন্তু বাস্তবায়ন করা গেল না। সাদাপোশাকে আটক না করার সুপারিশ অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চিত করেছেন। ঢাবির সাবেক ছাত্র আবদুল কাদেরের ঘটনায় আমি আদালতে বক্তব্য দিয়েছিলাম। ওসি বরখাস্ত হয়েছিলেন। একটি ঘটনায় পিএসসি প্রতিবন্ধীকে চাকরি না দিতে চাইলে আমরা হস্তক্ষেপ করি। সুফল পাই। রানা প্লাজায় চার-পাঁচজনের চিকিৎসাসুবিধা নিশ্চিত করি। পল্লী বিদ্যুতে ছাঁটাই করা শ্রমিকদের পুনর্বহাল করেছিলাম। তৃতীয় লিঙ্গের কারণে একটি ব্যাংক তার কর্মীকে অপসারণ করে, আমরা তার চাকরি ফিরিয়ে দিই। মাদারীপুরে অশীতিপর এক নারীকে তাঁর বাস্তুভিটা বিক্রি করতে বাধ্য করলে আমরা তা প্রতিহত করি। এ রকম ব্যক্তিগত প্রতিকারের বহু উদাহরণ আছে।

প্রতিবেদক : ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কী করলেন? হিন্দুদের অর্পিত সম্পত্তি সমস্যা মেটানোর নয়?

মিজানুর রহমান : অর্পিত সম্পত্তি আইনের খ তফসিল চূড়ান্ত করার পরে আমাদের বাধায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা ২০১৪ সালে বাতিল হয়। ওটা পাস হলে হিন্দুদের জমি যার যা ছিল, তাও হারাত।

প্রতিবেদক : এঁরা কারা, যাঁরা এই আমলেও এমন বিধ্বংসী বিধান চূড়ান্ত করেন এবং তাতে প্রধানমন্ত্রীর সই আশা করেন?

মিজানুর রহমান : আপনার সঙ্গে আমি একমত। এঁরা আমলাতন্ত্র, যাঁদের পরাস্ত করা খুব কঠিন এবং আমার আশঙ্কা হচ্ছে সেই আমলাতন্ত্রের কাছেই সরকার আবার বন্দী হয়ে যাচ্ছে কি না। বাংলাদেশে মানবাধিকার উন্নয়নে আমলাতন্ত্রই অন্যতম বড় বাধা। আমলাতন্ত্র মানবাধিকারকে কোনো পাত্তা দেয় না। নাগরিকের মানবিক মর্যাদায় তার কোনো বিশ্বাস নেই। আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে আমরা একটি গাইডলাইন করেছিলাম। ভারতে এটা মানা হচ্ছে। কিন্তু এখানে কেউ পাত্তাই দিল না। দ্বিতীয় বড় বাধা হলো ২০০৯ সালের মানবাধিকার আইন, যা আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে।

প্রতিবেদক : মানবাধিকার কমিশনের বিদায়ী সদস্য অধ্যাপক মাহফুজা খানম প্রথম আলোকে বলেছেন, তিন বছর আগে যোগ দিয়ে তিনি দেখেন আগের তিন বছরের নিরীক্ষা হয়নি। একটি সেমিনার করে নিজের পকেট থেকে তাঁর ৬৫ হাজার টাকা তুলতে বছর ঘুরেছে। আরেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেছেন, তদন্তকাজে মাইক্রোবাস ভাড়া করার দরকার পড়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

মিজানুর রহমান : এটা ঠিক। কিন্তু আমি নিরীক্ষা চেয়ে মহাহিসাব নিরীক্ষককে যথাসময়ে তাগাদাপত্র দিয়েছিলাম। পরে ২০১৪ সাল থেকে তাঁরা তা করছেন। আর ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকার বাজেটের বরাদ্দটা পায় আইন মন্ত্রণালয়। এজি অফিসের একজন কর্মকর্তা আইন মন্ত্রণালয়ে বসেন। সুতরাং টাকা খরচের স্বাধীনতা কমিশনের নেই। সেটা আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। শুনে অর্থমন্ত্রী অবাক হয়েছিলেন। যদি কেউ বলে তুমি স্বাধীন নও, তাহলে আমি কী করে প্রমাণ দেব আমি স্বাধীন।

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।

মিজানুর রহমান : ধন্যবাদ।
প্রথমআলো

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.