চট্টগ্রামে হার্ড লাইনে পুলিশ

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : দেশে জঙ্গি ও অপরাধীদের নিয়ে কঠোর অবস্থানে সরকার। পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নগরীতে জঙ্গি কর্মকান্ডসহ নাশকতা সহিংসতায় জড়িত আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযান সফলতার মুখ দেখছে না। নগরীর চকবাজারে অক্ষত রয়েছে জামায়াত শিবিরের ঘাঁটি। কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএনপি জামায়াত সমর্থকরা সক্রিয় থাকায় বার বার বিফল হচ্ছে সিএমপি। এতে অভিযানের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যায়। অপরাধীদের কাছে খবর চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে পুলিশ গোপনে তথ্য সংগ্রহ করছে।

এদিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশও গত ৪ আগষ্ট থেকে ব্লক রেইড শুরু করেছে। জানা যায়, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যে কোন মুল্যে জঙ্গি কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। জঙ্গিরা যাতে মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া নাশকতা ও সহিংসতা মামলার আসামীদের গ্রেফতার করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুত্র জানায়, নগরীতে আনসার উল্লাহ বাংলা টিম-এটিবি, হিযবুত তাহরীর, শহীদ হামজা ব্রিগেডসহ বিভিন্ন জঙ্গি কর্মীরা সক্রিয় রয়েছে। ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশ জঙ্গি চট্টগ্রাম থেকেই গেছে। ঢাকার গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গিরা চট্টগ্রাম হয়ে গেছে বলে গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে।

হিযবুতের কমান্ডার সুমন ওরফে শিহাবও ছিল চট্টগ্রামে। হালিশহরে সে লেখাপড়া করে আন্দরকিল্লায় চাকরি করছিল। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ১০ জঙ্গিকে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেএমবির সামরিক কমান্ডার বোমারু মিজানের অবস্থানও ছিল নগরীতে। চট্টগ্রামে প্রশিক্ষন ক্যাম্প ছিল বলে ধৃতরা স্বীকার করেছে। সীতাকুন্ডে গ্রেফতার হওয়া এটিবির ৫ সদস্য জানিয়েছে, চট্টগ্রামে তাদের ঘাঁটি রয়েছে। গত বছর কর্নেলহাট এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া জেএমবির সদস্য এরশাদ হোসেন মামুন গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, চট্টগ্রামে অসংখ্য জঙ্গি ছদ্মবেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা ফুটপাতের হকার, ফেরিওয়ালা, বাদাম বিক্রেতা, শরবত বিক্রেতা সহ নানা বেশে রয়েছে। সুযোগ বুঝে তারা অপারেশন চালাবে। জানা যায়, ৫ জুন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকান্ডের পর ১০ দিনব্যাপী জঙ্গি বিরোধী অভিযান চলে নগর ও জেলায়। এ সময় মাত্র একজন জঙ্গি আটক করা হয়। নগরীতে নাশকতা ও সহিংসতা মামলার ৫ সহস্রাধিক আসামী রয়েছে।

বিগত জাতীয় নির্বাচনকালীন ও ২০১৫ সালে জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাদের আসামী করা হয়। সুত্র জানায়, জুন মাসে সহ বিভিন্ন সময়ে নগরীতে জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালানো হলেও তেমন কোন জঙ্গি আটক হয়নি। অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মামলার আসামী ও ওয়ারেন্টভুক্তরাই গ্রেফতার হয় বেশিরভাগ। অপরদিকে সহিংসতা ও নাশকতার মামলার আসামীদের বিশেষ করে জামায়াত ক্যাডারদের গ্রেফতারের নির্দেশনা দেয়া হলেও তা কাগজে কলমেই রয়ে যায়। মাঝেমধ্যে হাতেগুনা কয়েকজন গ্রেফতার হয়।

জানা যায়, সিএমপিতে কর্মরতদের মধ্যে বিএনপি জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তারা সক্রিয় রয়েছেন। এমনকি একাধিক থানার ওসিও বিএনপি জামায়াত সমর্থক বলে জানা গেছে। এসব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন যাবত সিএমপিতে চাকরী করে যাচ্ছেন। এসআই, এএসআই ও কনষ্টেবলও রয়েছে অর্ধশতাধিক। ডিবিতেও রয়েছেন তাদের সমর্থকরা। তাদের অনেকেই বিএনপি ও জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। একজন এসি এক শিবির ক্যাডারের আত্বীয়। অভিযোগ রয়েছে, অভিযানের আগেই জঙ্গি সংগঠন বা নাশকতা সহিংসতা মামলার আসামীরা খবর পেয়ে যায়। কোনদিন কোন এলাকায় অভিযান চালানো হবে তার খবর আগেই পৌছে যায় তাদের কাছে। বিশেষ করে জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীরা আগেবাগে খবর পেয়ে যান। এ কারনে তারা ধরা পড়ে না। ফলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সুত্র জানায়, সহিংসতা ও নাশকতা রোধে বা এসব কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সিদ্ধান্তগুলো থানা পুলিশকে অবহিত করে তাদের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগেই সেগুলো বিএনপি জামায়াত বা নাশকতাকারীদের কাছে পৌঁছে যায়। যে কারনে পুলিশ ব্যর্থ হয়। কতিপয় পুলিশের সাথে বিএনপি ও জামায়াতের যোগসাজস রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন সিএমপির কর্মকর্তারা। সিএমপি কমিশনার মো: ইকবাল বাহার বলেন, জঙ্গি বা নাশকতা সহিংসতায় জড়িতদের শৈথল্য দেখানোর কোন সুযোগ নেই। তাদের গ্রেফতারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পুলিশ জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। বেশ কিছু জঙ্গি ধরাও পড়েছে। এদিকে এক শ্রেনীর পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে মাদক ব্যবসায়ী অপরাধীদের সাথে রয়েছে গভীর সখ্যতা। কোন বস্তি বা মাদক আস্তানায় অভিযান চালানোর আগে ওইসব কর্মকর্তারা আগেই জানিয়ে দেন। ফলে মাদক উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হয় না। এসব পুলিশ কর্মকর্তারা মাদকের আঁখড়া থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ আছে, চকবাজার এলাকায় জামায়াত শিবির ও জঙ্গি আস্তানা অক্ষত রয়েছে। এই এলাকার মেস ও শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলোতে গত এক বছরেও অভিযান চালায়নি পুলিশ। কয়েকটি কোচিং সেন্টারে জঙ্গিরা বৈঠক করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখান থেকেই নাশকতা চালানোর তথ্য রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে। চকবাজার থানা পুলিশের সাথে তাদের গোপন সখ্যতা রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম ও মহসিন কলেজে ও কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজসে শিবির শেল্টার পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রলীগ।

এদিকে অপরাধীদের গ্রেফতারে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ব্লক রেইড শুরু করেছে পুলিশ। গত ৪ আগষ্ট রাতে সীতাকুন্ড ও সাতকানিয়ায় এই অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৭৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। জানা গেছে, উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এই ব্লক রেইড শুরু করা হয়। অপরাধী আটকে এলাকা ঘেরাও করে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলে এ অভিযানের বর্ননা দেন। তিনি বলেন, সাতকানিয়া থানায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দক্ষিনের নেতৃত্বে সহকারী পুলিশ সুপার, সাতকানিয়া সার্কেল এবং ওসি সহ বিভিন্ন সদস্যরা থানার পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে ব্লক রেইড পরিচালনা করে। এতে গ্রেফতারী পরোয়ানা মুলে ৪৩ জন, সাজা পরোয়ানা মুলে ৩ জন, নিয়মিত মামলায় ২জন এবং অন্যান্য ৬জন সহ মোট ৫৪জনকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে সীতাকুন্ড থানায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) নেতৃত্বে সহকারী পুলিশ সুপার, ওসিসহ পুলিশের মোট ১০ টিম পৌরসভার আমিরাবাদ ও মহাদেবপুর এলাকায় ব্লক রেইড দিয়ে জিআর, সিআর, ডাকাতি, অপহরন ও নিয়মিত মামলায় সর্বমোট ২৩ জনকে গ্রেফতার ও অপহৃত একজনকে উদ্ধার করে বলে জানান পুলিশ সুপার।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ব্লক রেইড চালানো হলেও তার খবর আগেবাগে প্রচার হওয়ায় কিছু সাধারন লোকজন গ্রেফতার করা ছাড়া বড় কোন অপরাধীরা ধরা পড়ছেনা বলে অভিযোগ বিভিন্ন মহলের। জানা গেছে, নগরীর বাড়িওয়ালা ও বাসিন্দাদের তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হলেও অধিকাংশ নাগরিক এ বিষয়টি জানেন না। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অপরদিকে নগরীর বাড়িওয়াল ও নাগরিকদের তথ্য ফরম জমা নিলেও তার কোন রিসিভি কপি দিচ্ছে না পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে,’ এসব তথ্য ফরম ঠিকমত সংগ্রহ হচ্ছে তো! পরবর্তীতে পুলিশ তথ্য ফরম প্রাপ্তীর কথা অস্বীকার করবে না তো!

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.