চট্টগ্রাম জেটিতে কালাজ্বীন ও জাম্বুদের রাজত্ব!

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানী রপ্তানীর প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। বন্দরে নেই যথেষ্ট সিসি ক্যামেরা, যা আছে তার অনেকগুলো নষ্ট। মনিটরিং ব্যবস্থাও দুর্বল। ফায়ার এলার্ম অকার্যকর। নিরাপত্তা দেয়ালও ভেঙ্গে গেছে কয়েক জায়গায়। মোবাইল ভেহিক্যাল স্ক্যানারটিও সঠিকভাবে কাজ করছে না। দীর্ঘদিন যাবৎ এ বন্দরে বিভিন্ন ঘটনা ঘটলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগে জালিয়াতির মাধ্যমে বাড়ছে কন্টেইনার পাচারের ঘটনা।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি বন্দরের এসব ঝুঁকি তুলে ধরে সেগুলো প্রতিকারে করণীয় ও অন্যান্য বিষয়ে সুপারিশসহ একটি সচিত্র প্রতিবেদন পাঠিয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে এমন তথ্য দিয়ে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরসহ সব বন্দরের জন্য নিরাপত্তা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের একটি অন্যতম কেপিআই ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্রস্থল। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন বন্দরের কোস্টাল শিপিং চুক্তি হওয়ায় এ বন্দরের ব্যস্ততা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও জড়িত।

এ অবস্থায় বন্দর নিরাপত্তায়, ১৯৪৮ সালে প্রনীত পরিকল্পনা পরিবর্তন এবং যুযোপযোগী করা দরকার। বন্দরের নিরাপত্তা দুর্বলতার অন্যতম কারন মোবাইল ভেহিক্যাল স্ক্যানার অকার্যকর এবং অব্যবহুত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে সাত পৃষ্ঠার ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান একটি মোবাইল ভেহিক্যাল স্ক্যানার প্রায়ই নষ্ট থাকে। দীর্ঘদিন নষ্ট থাকার পর সম্প্রতি চালু করা হলেও তেল সরবরাহ অপর্যাপ্ত হওয়ার কারনে এটি ব্যবহুত হচ্ছে না।

ফলে বিভিন্ন সন্দেহজনক কনটেইনার দ্রুততম সময়ে তল্লাশি করা যাচ্ছে না। যা বন্দরের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরুপ। বন্দরে অপর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও মনিটরিং দুর্বলতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, বর্তমানে ৩০ শতাংশ রয়েছে সিসি ক্যামেরার আওতায়, বাকি ৭০ শতাংশের গুরুত্বপূর্ন এলাকা রয়েছে সিসি ক্যামেরার বাইরে। বন্দরে স্থাপিত ১২৬টি সিসি ক্যামেরার অনেকটিই বর্তমানে অকার্যকর। প্রায় ৫০টি সিসি ক্যামেরা নষ্ট অথবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

বন্দরের ফায়ার এ্যালামটিও সঠিকভাবে কাজ করছে না। গোয়েন্দা তথ্যানুসারে বন্দরের অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হওয়ায় ৩০টি ফায়ার এ্যালার্ম রয়েছে। এর অধিকাংশ ফায়ার সিস্টেম দীর্ঘদিন কাজ করছে না। চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানা বরাবর দেয়াল ও গ্রিল থাকলেও অনেক স্থানে নিরাপত্তা দেয়াল ও গ্রিল ভেঙ্গে পাওয়ার পর তা মেরামত না করায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া বন্দরের ক্যারেট ব্যবসা এবং ব্যবসা নিয়ে ক্যারেট পাটির সঙ্গে সরকারের প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে বলে গোয়েন্দা তথ্যে পাওয়া গেছে। বলা হয়েছে, এ ধরনের ব্যবসা নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সংরক্ষিত ৭০ শতাংশ এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে চাহিদার অর্ধেক। নিরাপত্তারক্ষীদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের কোটায়। দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারনে প্রতিনিয়ত কন্টেইনার থেকে মুল্যবান পণ্য চুরি হচ্ছে বন্দরে। পাশাপাশি মিথ্যা ঘোষনায় পণ্য আনার ঘটনা বাড়ছে। ব্যবহারকারীরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান আমদানী রপ্তানী বানিজ্য সুরক্ষিত করতে হলে ঢেলে সাজাতে হবে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কঠোরভাবে অনুসরন করতে হবে আন্তর্জাতিক নৌ বানিজ্য সংস্থার (আইএমও) নির্দেশিত আইএসপিএস (ইন্টারন্যাশনাল শিপ এন্ড পোর্ট সিকিউরিটি) কোড।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকায় বন্দর থেকে নিয়মিত পণ্য চুরি করছে চোরদের ৮টি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের অধীনে সক্রিয় আছে ৮০ থেকে ৯০ দুর্বৃত্ত। এ প্রসঙ্গে বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল খালেদ ইকবাল বলেন, বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্দরের সেবার আওতায় যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের প্রত্যেককে সিসিটিভি ক্যামেরাসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম বাড়াতে বলা হয়েছে। বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায়ও বাড়ানো হবে সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা। বুয়েটের পরামর্শ শিগগির বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় আট শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে। এতে পুরো বন্দর এলাকায় নজরদারী বাড়বে। নিরাপত্তারক্ষীদের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হবে। শিপিং এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, বন্দরে পন্য চুরির ঘটনা বহিবিশ্বে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।

এটি বন্ধ করতে হলে আইএসপিএস কোড অনুসরন করে বন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। স্থাপন করতে হবে পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরাও। বন্দরের সুরক্ষিত এলাকার নিরাপক্তা নিয়ে কাজ করছে বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলামের পর্যবেক্ষন অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের নয় কিলোমিটার দীর্ঘ সংরক্ষিত এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা থাকার কথা আট শতাধিক। কিন্তু আছে মাত্র ১২৮টি। সিসিটি ইয়ার্ডে বছরে ছয় লাখ ১৫ হাজার কন্টেইনার ওঠানামা করলেও সিসিটিভি ক্যামেরা আছে মাত্র ৭ টি। সুত্র মতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায়, বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় গড়ে উঠেছে পন্য চুরির সিন্ডিকেট। আট জনের এই সিন্ডিকেটে আছে কালাজীন ও জাম্বু। কালাজ্বীনের তৎপরতা চলে সুর্যাস্তের পর। আর জাম্বু চুরি করতে পারে দিনের আলোতেও।

পন্য চুরির নেতৃত্ব দিচ্ছে আরও ছয়জন। তারা হচ্ছে, মো: সেলিম, জাহাঙ্গীর, নয়ন, সেন্টু, সাজ্জাদ ও বাইট্যা সেলিম। এই আটজনের সিন্ডিকেটে রয়েছে ৮০ থেকে ৯০ চোর। এদের মধ্যে আছে নুরুল আবছার, মোহাম্মদ নয়ন, মিজান মিয়া, নুর নবী, মো: আলী, মো: শহিদুল ইসলাম, মো: মুছা, মো: নবী হোসেন, হরিরাম ঘোষ দুলাল, মো: মহসিন, মো: আলাউদ্দিন, মো: বুলবুল, বাহাদুর, মো: সোহেল, মো: কামাল, আলাউদ্দিন, মহিউদ্দিন, হারুন, মো: জামাল, আশিকুল, মো: খোকন, শাহ আলম, মো: সুমন, মো: সবুজ, মো: মনির হোসেন, মো: মুন্না, মো: রফিক, মো: জাকির, আবদুর রহিম, মো: শফিকুল ইসলাম, মো: একরামুল হক, হেলাল উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, সোহেল, সৈয়দ আলম ও তাজুল ইসলাম। এসব চোরের সিন্ডিকেট বছরের পর বছর বন্দরের অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন কায়দায় চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে মুল্যবান পন্যসামগ্রী।এদিকে বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের নির্ধারিত পোশাক না থাকা এবং ইউনিফম না পরে দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.