এডভোকেট সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু
সাবেকপি,পি,প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল,চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ
মুসলিম বিবাহ এমন একটি দেওয়ানী চুক্তির প্রতিফলন যা সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য কোন লিখিত দলিল সম্পাদন প্রয়োজন নয়, কিন্তু সামাজিক বিবর্তনের ফলে মানুষের প্রতি মানুষের সম্পর্ক ক্রমশঃ জটিল হচ্ছে। মিথ্যা, অনাচার, লোভ ও হিংসা মানুষের সম্পর্কের মাঝে ভীষণ প্রভাব পড়ছে। ফলে মানুষের সাথে মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারনে বিবাহ রেজিষ্ট্রি করার প্রশ্ন আসছে। মুসলিম বিবাহ অলিখিত হতে বাধা নেই, কিন্তু যে কোন মূহুর্তে বিবাহ অস্বীকৃত হতে পারে।
নারীর বৈবাহিক জীবনের নিরাপত্তা সহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলায় বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রেজিষ্ট্রেশন বিহীন বিবাহ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মুসলিম বিবাহ আইন অনুসারে বিবাহের একমাত্র প্রমাণপত্র বা দলিল হলো বিবাহ রেজিষ্ট্রি। বিবাহ রেজিষ্ট্রেশনকরণ বিষয়ে দলিলের নাম কাবিননামা। বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হলে তা রক্ষাকবচ হিসেবে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে।
বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন সন্তানের পিতৃ পরিচয় , স্ত্রীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা, বহু বিবাহ রোধ, তালাক, বাল্যবিবাহ, ও নারী নির্যাতন রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তা ব্যতীত বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন তালাকপ্রাপ্তা নারীর ভরণ পোষন, দেনমোহর ও যাবতীয় পাওনা আদায়ে সহায়তা পালন করে। রেজিষ্ট্রেশন রেজিষ্ট্রি বিহীন বিবাহের ফলে স্ত্রী তার প্রাপ্য অধিকার হতে বঞ্চিত হয়, স্ত্রী স্বামী কতৃক নির্যাতিত হলে প্রতিকার লাভের নিমিত্তে আইনের আশ্রয় নিতে গেলে বিভিন্ন আইনগত সমস্যায় পড়তে হয়। একমাত্র বিবাহ রেজিষ্ট্রেশনের মাধ্যমেই নারীর আইনগত ক্ষমতা ও অধিকার সুনিশ্চিত করা সম্ভব।
১৮৭৬ সালে “বেঙ্গল মোহামেডান বিবাহ ও তালাক আইন” নামে প্রথম বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন সংক্রান্ত আইন প্রণীত হলেও তখন এ আইনে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ছিলনা। ১৯৬১ সালে “মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ” প্রণীত হয় এবং উক্ত আইনে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন) আইন- ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। এখানে রেজিষ্ট্রেশন বিহীন বিবাহের জন্য শাস্তির ব্যবস্থার বিধান করা হয় এবং বিবাহ রেজিষ্ট্রি সহজতর করা হয়। উক্ত আইন অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকার যথাক্রমে ১৯৭৫, ২০০৫, ২০০৯ ও ২০১১ সালে সংশোধন করে।
বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইনের উৎস হচ্ছে পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। বাংলাদেশে যেসব বিবাহ সংক্রান্ত আইন বিদ্যমান রয়েছে, তা হলো বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯, মুসলিম পরিবারিক অধ্যাদেশ আইন-১৯৬১, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ ইত্যাদি। ১৯৭৪ ইংরেজী সালের মুসলিম নিকাহ্ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন) আইন অনুসারে বিবাহের কাবিননামা রেজিষ্ট্রেন করা আবশ্যক। যার ফলে কোন পুরুষের তালাক প্রদানের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিবাহের কাবিননামায় মোহরানার টাকার পরিমাণ অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।
এ আইনের ৪ ধারা অনুসারে, সরকার যোগ্যতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তিকে নির্ধারিত এলাকার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স প্রদান করলে তাকে ‘নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার’ বলা হয়। সরকার কতৃক বিধি মোতবেক অনুমতি বা লাইসেন্স প্রাপÍ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ বিবাহ রেজিষ্ট্রির কাজ করলে তা বেআইনী ও দন্ডনীয় অপরাধের সামিল হবে।
অত্র আইনের ৫ (২) উপ ধারার (১) বিধান লঙ্ঘন করলে সে তিন মাস পর্যন্ত মেয়াদের বিনাশ্রম কারাবাস বা পাঁচশত টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। বিধি ৯ মতে, কোন বিবাহ রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার পর নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে খাতায় ভূক্তির সত্যায়িত প্রতিলিপি প্রদান করবেন। ১৯৭৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রিকরণ) বিধিমালার ২৪ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক রেজিষ্ট্রার ‘ঙ’ ফরমে বিবাহ রেজিষ্ট্রি করবেন। তবে প্রতিলিপির জন্য কোন খরচ আদায় করা যাবেনা। বিধি ১৮ (৫), বিবাহ রেজিষ্ট্রিকরণ বাবদ ফিস বর কতৃক প্রদেয় হবে, বিধি ১৮(৬), নিকাহ রেজিষ্ট্রার এ বিধির অধীনে যে ব্যক্তির নিকট হতে ফি বা ভাতা গ্রহণ করেন উক্ত ব্যক্তিকে ‘গ’ ফরমে রশিদ প্রদান করবেন, বিধি ১৮ (৭), প্রত্যেক নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারকে অফিসের কোন প্রকাশ্যে স্থানে ফিস ও ভাতাদির একটি তালিকা প্রদর্শন করতে হবে। বিধি ১৯ (১) বিবাহ রেজিষ্ট্রিকরণের পূর্বে নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার বিবাহের পক্ষগণকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন অথবা বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এমন দুইজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
বিধি ১৯ (২) যে ক্ষেত্রে নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার নিজেই বিবাহ সম্পন্ন করেন সেক্ষেত্রে তিনি বিবাহের রেজিষ্ট্রি খাতার কলামও পূর্ণ করবেন এবং উক্ত খাতায় যে সকল ব্যক্তিদের স্বাক্ষর বা টিপ আবশ্যক, তাদের স্বাক্ষর বা টিপ গ্রহণ করবেন অতঃপর তাতে স্বাক্ষর ও সিলমোহর দিবেন। বিধি ১৯ (৩) যখন কোন বিবাহ রেজিষ্ট্রার ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক অনুষ্টিত হয়, তখন উক্ত ব্যক্তি, যে নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের এখতিয়ারের মধ্যে বিবাহটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার পনের দিনের মধ্যে সে নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের কাছে বিষয়টির রিপোর্ট প্রদান করবেন। বিধি ২১ মতে, নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার কোন ব্যক্তির বিবাহ রেজিষ্ট্রি প্রত্যাখান করলে, উক্ত প্রত্যাখানের ত্রিশ দিনের মধ্যে জেলা রেজিষ্ট্রারের কাছে আপীল করা যাবে। আপীলে জেলা রেজিষ্ট্রার কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ চুড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
সরকার মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা- ২০০৯, এপ্রিল ১০, ২০১১ তারিখে সংশোধন করেছে। অত্র আইনে বিবাহ্ রেজিষ্ট্রির ফিস বর্ণিত হয়েছে। বিধি ১০ অনুযায়ী, নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার বিবাহ্ রেজিষ্টিকরনের জন্য চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেনমোহেরর ক্ষেত্রে এক হাজার টাকা ও দেনমোহরের বা উহার অংশ বিশেষের জন্য ১২.৫০ টাকা হারে ফি আদায় করতে পারবেন। দেনমোহরের পরিমাণ চার লক্ষ টাকার অধিক হলে তৎপরবর্তী প্রতি এক লক্ষ টাকা দেনমোহরের বা অংশ বিশেষের জন্য ১০০ টাকা বিবাহ সর্বনি¤œ ফি আদায় করতে পারবেন, তবে দেনমোহরের পরিমাণ যা হোক না কেন সর্বনি¤œ ফি ২০০ টাকার কম হবে না উপ বিধি (৩) একজন নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার নকল প্রাপ্তি ফি পঞ্চশ টাকা,যাতায়ত বাবদ প্রতি কিলোমিটার ফি দশ টাকা ও তল্লাশী ফি দশ টাকা গ্রহণ করতে পারবেন।
উপ বিধি (৪ক) এ বিধির অধীন যাবতীয় ফি নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের কাছে পরিশোধ করতে হবে এবং বিবাহ নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় ফি নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার কর্তৃক আদায়ের পর নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার বিবাহ্ নিবন্ধন সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বিবাহ্ নিবন্ধনের নিকাহনামা প্রদান করবেন। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিকাহ রেজিষ্ট্রার গণ সরকারী নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা করে না। তারা বিভিন্ন লোক হতে তাদের ইচ্ছা মাফিক বিবাহ নিবন্ধনের ফি আদায় করেন। বিধি ২৩-ক (১) কোন নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার বর ও কনের জাতীয় পরিচয় পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ বা জে,এস,সি বা এস,এস,সি বা সমমানের পরীক্ষার সনদপত্র পরীক্ষা পূর্বক বর ও কনের বিবাহের জন্য আইনগত বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া কোন বিবাহ নিবন্ধন করবেন না।
২৩ (২) উপ ধারা (১) এ উল্লেখিত কাগজপত্র না থাকলে বর ও কনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাতা, পিতা বা আইনগত অভিভাবক প্রদত্ত বয়স সংক্রান্ত হলফনামা দ্বারা বর ও কনের বয়স নির্ধারণ পূর্বক বিবাহ নিবন্ধন করতে হবে। বিধি ২৩ (৩), বিবাহ নিবন্ধনের সময় বর, কনে বা কোন ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য দিলে এবং উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোন বিবাহ নিবন্ধন করা হলে তজ্জন্য কোন নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার দায়ী হবে না। বিধি ২৩ (৪) উপ ধারা (১) বা (২) দ্বারা বর ও কনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সংক্রান্ত কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট নিকাহ্ রেজিষ্টারকে সংরক্ষণ করতে হবে।
অতীতে আমাদের দেশে বিবাহ নিবন্ধন খুবই কম হতো।
শুধুমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিবাহ নিবন্ধন করতো। বর্তমানে সকলের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবাহ নিবন্ধন আইন ও আবশ্যকতা সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, নাটক, সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন, সেমিনার, সভা-সমাবেশ সহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে সরকারকে ব্যাপক ভাবে প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে আরো অধিক সচেতন করতে হবে। মনে রাখতে হবে আইন সম্পর্কে জনগণকে যত সচেতন করা যায়, দেশে তত অপরাধ হ্রাস পাবে।