চট্টগ্রামে সিএসসিআরে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চিকিৎসার নামে বানিজ্য চালাচ্ছে কতিপয় চিকিৎসক, রোগ নিরাময় কেন্দ্র ও বেসরকারী মালিকানায় প্রতিষ্টিত হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। চিকিৎসা সেবার মহান ব্রত নিয়ে প্রতিষ্টিত হলেও এখানে সেবার মনোবৃত্তি কারো নেই।

ডাক্তারী পাশ করে চেম্বার খুঁলে বসতে পারলেই বানিজ্য শুরু। দ্বিগুন টাকা খরচ করে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গেলেও পাওয়া যাচ্ছে না সঠিক চিকিৎসা। উপরন্তু চিকিৎসক কর্তৃক রোগী ও রোগীর স্বজনদের প্রতি অবহেলা, ধমক, ভুল ব্যবস্থাপত্র প্রদান এবং ঢালাওভাবে সিজার করা হচ্ছে সব অন্তসত্বাকে। স্বাভাবিক ভাবে সন্তান প্রসব করালে ডাক্তার নামের ব্যবসায়ীদের পকেট তাজা হয় না। একটি রোগিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই বেশ কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে থাকে বানিজ্যের চাকা। এতে লাভমান হয় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগ নিরুপনি কেন্দ্রগুলো। একই টাকার ভাগ পেয়ে যান রোগিকে হাসপতালে পাঠানো সেই চিকিৎসক। চিকিৎসকরা রোগীর কাছ থেকে, ঔষধ কোম্পানী থেকে, হাসপাতাল ও রোগ নিরুপনি কেন্দ্র থেকে টাকা পেতে থাকলেও তাদের মন ভরে না! আরও বেশি টাকা উপার্জনের ফন্দি ফিকিরে ব্যস্ত থাকেন তারা। এতে করে রোগীদের প্রতি অবহেলা, অমানবিক আচরন ও অনেক ক্ষেত্রে জীবন নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে দ্বিধাবোধ করেন না। এরই বাস্তব চিত্র মিলেছে সম্প্রতি সিএসসিআর’এ।

সম্প্রতি এ প্রতিষ্টান জীবিত নবজাতককে কার্টুনে ভরে মৃত বলে সার্টিফিকেট দিয়ে ঘৃন্য ও বর্বরতার নজির স্থাপন করেছে। নগরীর প্রবত্তক মোড়ের সিএসসিআর হাসপাতালে গত ৪ অক্টোবর দিবাগত রাত একটায় জন্মগ্রহন করেছিল নবজাতকটি। যার মা বাবা দুজনই সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। এ কন্যা সন্তানের মা আলীকদম উপজেলা ডেন্টাল সার্জন ডা. রিদওয়ানা কাউসার, বাবা কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. নুরুল আজম। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করবেন কমিটি।

সিএসসিআর হাসপাতালের ৬১২ কেবিনে চিকিৎসাধীন ডা. রিদওয়ানা জানান, সিএসসিআর হাসপাতালের দায়িত্বরত ডাক্তারদের অবহেলা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে ১০ ঘন্টা বয়সের এই নবজাতককে। দেহে প্রান থাকার পরও যথাযথ চিকিৎসা না দিয়ে জন্মের মাত্র ২ ঘন্টা পর মৃত্যু সনদ দিয়ে একটি প্যাকেটে করে ওই নবজাতককে দিয় যায় ৬১২ নম্বর কেবিনে। কেবিনে বসে নিজের বাচ্চার মৃত্যু সঠিক কিনা তা জানতে অস্থির হয়ে উঠে মায়ের মন। প্যাকেট খুলে বাচ্চার মুখ দেখেই অবাক ডা. রিদওয়ানা কাউসার। তিনি দেখলেন তার বাচ্চা দিব্বি নড়াচড়া করছে। ততক্ষনে বাচ্চার শরীর খুবই ঠান্ডা হয়ে গেছে। পরিবর্তন এসেছে শরীরের রংয়ে। বিষয়টি দ্রুত হাসপাতালের চিকিৎসকদের জানানো হয়। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। বললেন,’ বাচ্চা নড়াচড়া করছে না। গায়ের মাংস নড়ছে। এ অবস্থায় প্রসুতি নিজেই বাচ্চাকে নিয়ে গেলেন চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে। হাসপাতালের ওয়ার্মারে দেওয়ার পর শরীর স্বাভাবিক হলো। কিন্তু সেখানে বেড খালি না থাকায় নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে ওই বাচ্চাকে ভর্তি করা হয়েছে। এই কলামটি লেখা পর্যন্ত বাচ্চাটি বেঁচে আছে। ডা. রিদওয়ানা কাউসার জানান, বাচ্চা ডেলিভারী হওয়ার পর গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহানা আক্তারকে চিৎকার করে বলতে শুনেছি বাচ্চা শ্বাস নিচ্ছে। তাকে দ্রুত এনআইসিইউতে (নিউনাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানে নেওয়ার দুই ঘন্টা পর মৃত্যু সনদ দিয়ে একটি প্যাকেট ভরে বাচ্চাকে কেবিনে দিয়ে যায়। যেহেতু আমি নিজেও ডাক্তার তাই গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কথাটি আমার মনে পড়লো। ট্যাপ দিয়ে মোড়ানো প্যাকেটটা খুলতে চাইলাম কিন্তু হাসপাতালের দায়িত্বরত লোকজন আমাকে বাধা দিলেন। তারপরও আমি জোর করে প্যাকেট খুলে দেখি বাচ্চা নড়াচড়া করছে। আবারও এনআইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বললে সেখানে দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন, বাচ্চা মৃত। আমি বললাম,’ বাচ্চা নড়াচড়া করছে। তিনি বললেন, বাচ্চা না। শরীরের মাংস নড়ছে। আমি বললাম পরীক্ষা করে দেখুন। তিনি পরীক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানান।

এনআইসিইউতে দায়িত্বরতদের অবহেলার কারনেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ করে আলীকদম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর ডেন্টাল সার্জন ডা. রিদওয়ানা কাউসার,’ এনআইসিইউতে নেওয়া হলেও সেখানে বাচ্চার কোন পরিচর্যা হয়নি। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, দেশের দ্বিতীয় রাজধানী চট্টগ্রাম। আর সিএসসিআর হাসপাতালে যদি এ অবস্থা হয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবী তারা বাচ্চাটিকে মৃত ঘোষনা করেনি। এ বিষয়ে দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার তানভির জাফর বলেন, আমরা আগেই বলেছিলাম। হাসপাতালে ওয়ার্মার খালি ন্ইে। পাশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলাম, তবে হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর সনদ দেওয়া হলেও তিনি অস্বীকার করছেন। ডা. রিদওয়ানার স্বামী কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. নুরুল আজম বলেন, দুই ঘন্টা ধরে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাচ্চার অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তারা যদি ব্যবস্থা নিতে না পারে, সেটা আমাদের আগে জানালেই হতো। চারঘন্টা আগে পরি”র্যা করা গেলে এ সমস্যা হতো না। ডাক্তার শাহানা অনেক আন্তরিক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাচ্চা জীবিত আছে সেটাও বলেছিলেন। এনআইসিইউতে ভালভাবে পরিচর্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে দায়িত্বরতা অবহেলা করেছে। সিএসসিআর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নবজাতকের যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে মেডিকেল ইথিকস মানেনি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

জানতে চাইলে গাইনি ও প্রসুতি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহেনা আক্তার বলেন,’তার গর্ভে বাচ্চা আসার পর থেকে আমার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় শনিবার সিএসসিআরে ভর্তি হন ডা. রিদওয়ানা । ৪ অক্টোবর রাতে আমার হাতেই বাচ্চাটি প্রসব হয়। আমি বিস্মিত বাচ্চাটির হার্টবিট দেখে। এ ধরনের বাচ্চা সচরাচর বাঁচে না। ভুমিষ্ট হওয়ার পর ওর ওজন ছিল মাত্র ৫০০ গ্রাম। একটি পরিপুর্ন বাচ্চা মায়ের গর্ভে ৪০ সপ্তাহ থাকতে হয়। এ বাচ্চাটি ২৬ সপ্তাহে ভুমিষ্ট হয়ে গেছে। জন্মের সময় শিশুটি কান্নাও করেনি। কিন্তু জীবিত ছিল। তাই শিশু বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওখানে পরে মৃত বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। ডা. রিদওয়ানার বাবা ব্যবসায়ী সামসুদ্দিন জানান, সিএসসিআর কর্তৃপক্ষ আমার মেয়ের কেবিনে এসে এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইছে। কিন্তু আমরা কিভাবে তাদের ক্ষমা করবো। তারা আমার নবজাতক নাতনিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রথমে বলেছিল বিল নিবে না। পরে দশ হাজার টাকা বিলও নিয়েছে। আমরা পরে ম্যাক্স হাসপাতালে চলে এসেছি।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা, আজিজুর রহমান বলেন, জীবিত বাচ্চা মৃত বলে সার্টিফিকেট দেওয়া খুবই ভয়াবহ অপরাধ। চরম অবহেলা করেছে ওই হাসপাতালের ডাক্তাররা। এদিকে চট্টগ্রামের বেসরকারী ক্লিনিক সিএসসিআরে জীবিত নবজাতককে মৃত বলে প্যাকেট করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব চট্টগ্রাম। তারা এ ঘটনার জন্য দায়ী সিএসসিআর হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তি ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়েছে। পরদিন এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে গোটা চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানানো হয়।

এ দিকে ডাক্তারের অবহেলার বিষয়টি জানাজানি হলে সিএসসি আর ছেড়ে যান অনেক রোগী। অভিজ্ঞ মহলের মতে,’ সিএসসিআরের ঘটনাটি নতুন নয়। এর আগেও নগরীর বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতালে রোগিদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, হয়রানী ও নির্যাতনের গুরুত্বর অভিযোগ পাওয়া গেলেও, এসব ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। মানুষের জীবন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেও এদের কিছু হয় না। এদের রক্ষার জন্য আছে বিএমএ, ড্যাব ও স্বাচিপ এর মত সংগঠন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.