আনোয়ারা কোরিয়ান ইপিজেড উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা

0

জাহেদুল হক, আনোয়ারা : আনোয়ারায় বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা করেছে। আবার প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির গরমিলও আছে। তারপরেও আগের চেয়ে বর্তমানে অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম অনেকটাই গতিশীল হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমির উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে আরো দুবছর। এ সময়ের মধ্যে পরিপূর্ণ শিল্পায়ন গড়ে উঠলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক অনেকাংশে কমে যাবে। এ লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছেন কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। আগামী দুই শুষ্ক মৌসুমের মধ্যে শিল্পায়নের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানান, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের কাছ থেকে আনোয়ারায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে প্রায় ২৫০০ একর পাহাড়ি ভূমি লিজ নেয় দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানি ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু অপারেশনাল লাইসেন্সের অভাবে থমকে যায় উন্নয়ন কর্মকান্ড। দীর্ঘ ৮ বছরের প্রচেষ্টায় ২০০৭ সালের ২৯ মে কেইপিজেডকে অপারেশনাল লাইসেন্স দেয় সরকার।

আনোয়ারা কোরিয়ান ইপিজেড উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা
আনোয়ারা কোরিয়ান ইপিজেড উন্নয়নে নব দিগন্তের সূচনা

আরো কয়েক বছর পর বেশকিছু শর্তসাপেক্ষে ছাড়পত্র দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তাছাড়া লিজকৃত ভূমিতে মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান ও সীমানা নিয়ে স্থানীয়দের ঝামেলার কারণে উন্নয়ন কাজে বিঘ্ন ঘটে। যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগসহ বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। বর্তমানে পরিবেশ ছাড়পত্রের নির্দেশনা মেনে কেইপিজেডের উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মোট বরাদ্দ প্রাপ্ত ভূমির মধ্যে ২১০০ একর জমির উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

তারমধ্যে এক তৃতীয়াংশ ভূমিতে বিভিন্ন জাতের ২০ লাখেরও বেশি গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করা হয়েছে। সবুজ মাঠ ও লেক তৈরি করে উন্মুক্ত স্থান হিসেবে রাখা হয়েছে ১৯ শতাংশ ভূমি। সবমিলিয়ে প্রায় ১৩০০ একর ভূমির উন্নয়ন কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাদবাকী ৪৮ শতাংশ বা ১১৯২ একর ভূমি শিল্প ইউনিট ও অন্যান্য অবকাঠামো স্থাপনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যারমধ্যে ৮০০ একর ভূমি শিল্প স্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৩৯২ একর ভূমি শিল্পায়নের জন্য প্রস্তুত করা হবে শিগগির।

জানা যায়, কোরিয়ান ইপিজেডে ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন অন্তর্ভূক্ত কর্ণফুলী সু ইন্ডাষ্ট্রিজ লি. (কেএসআই) নামক কোম্পানিটির ২৩টি ইউনিট উৎপাদন শুরু করেছে। এতে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। তাদের সিংহভাগই স্থানীয় বাসিন্দা ও নারী। নির্মাণাধীন অন্যান্য শিল্প ইউনিটগুলো তৈরির পর পুরোদমে উৎপাদনে গেলে আরো ২৪ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। তাছাড়া প্রায় প্রতিদিনই নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে এসব জুতা কারখানায়। এছাড়া ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের কেপিপিসহ আরো ৩টি কোম্পানি কেইপিজেডে অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে। তারা অচিরেই প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করবে।

সূত্র আরো জানায়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে কেইপিজেডকে আন্তর্জাতিক মানের শিল্পজোন হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে কেইপিজেডে নিজস্ব জেটি, আইটি পার্ক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজ, কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভাষা শিক্ষা ও রিসার্চ সেন্টার, ব্যাংক, কাষ্টমস, সিএন্ডএফ, শিপিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট, হোল গল্ফ কোর্সসহ বিনোদন ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা থাকছে।

তাছাড়া ১০টি ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ও নারী শ্রমিকদের জন্য ১২টি ডরমিটরী বাস্তবায়নাধীন। তবে কেইপিজেডের বিপরীতে লিজকৃত ভূমির নামজারি ও গ্যাস সংযোগে দেখা দিয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। যার কারণে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো।

এদিকে, কেইপিজেড ঘিরে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনমানেও পরিবর্তন এসেছে। কেইপিজেড চালু হওয়ার পর এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, কেইপিজেডে বিভিন্ন এলাকার অল্প শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের চাকরির সুযোগ হওয়ায় তাদের পরিবারের অভাব দূর হয়েছে।

পাশাপাশি পুরো এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও পাল্টে গেছে। তাদের দাবি, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কেইপিজেডকে সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হোক। কেএসআইতে কর্মরত নারী শ্রমিক তানজিলা আহমেদ জানান, অভাবের সংসারে বাবা দীর্ঘদিন ধরে জটিল রোগে ভূগছিলেন। পরিবারের বড়জন হিসেবে আমি ও আমার ছোট বোন সংসারের হাল ধরতে কেইপিজেডে চাকরি নিই। এতে করে বাবার চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

বন্দর কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবসায়ী মো. ফারুক বলেন, কেইপিজেড ঘিরে আশপাশ এলাকায় ভাড়া বাসার চাহিদা বেড়েছে। সেই সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটেছে। পরিবহন খাতেও অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কেইপিজেডের এজিএম মো. মুশফিকুর রহমান জানান, সরকারের সব নির্দেশনা মেনে কেইপিজেড ভূমি উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রায় শতভাগ কাজ সমাপ্তির পথে। নির্মাণাধীন কারখানাগুলোর উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে এলাকার প্রায় ২৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। কেইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহজাহান বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখানে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিপুল সংখ্যক স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগের ফলে এলাকায় ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.