চসিকের পৌরকর নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে নগরবাসীর

0

গোলাম সরওয়ার : চট্টগ্রামে সিটি কর্পোরেশনের নতুন করে করারোপ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধছে। চসিকের ১১টি ওয়ার্ডের পঞ্চবার্ষিকী কর পুর্নমুল্যায়ন শুরুর পর গত বছরের মার্চে এ নিয়ে প্রথমে আপত্তি করেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আপত্তিটা ছিল, বর্গফুটের মুল্যায়নভিত্তিক জেনারেল এসেসমেন্টের মাধ্যমে করের যে আওতা বাড়িয়েছিলেন সাবেক মেয়রগণ নতুন কর পুর্নমুল্যায়নে তা মানা হয়নি। এর পরিবর্তে ’ভাড়াভিত্ত্বিক এসেসমেন্ট ’করা হচ্ছিল। তখন আইন মেনেই পুর্নমুল্যায়ন করার দাবী করেছিলেন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। এর পর বাকি ৩০ ওয়ার্ডের এসেসমেন্ট শুরু হয় গত অক্টোবর মাসে। এবার আপত্তি আসে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে।

পুরনো অভিযোগের সাথে তারা যোগ করলেন নতুন অভিযোগ। তাদের মতে, অতীতে ১৪ শতাংশ কর ধায্য করা হলেও এবার করা হচ্ছে ১৭ শতাংশ। এবারও অভিযোগ নাকচ করলেন চসিক মেয়র। তাঁর মতে, আইন কার্যকর করতে গেলে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত কর নেয়ার সুযোগ আছে। সেখানে নগরবাসীর সুবিধার্থে কমই নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যে কোন পরিস্থিতিতে আইন বাস্তবায়নে অনড় থাকার দৃঢ মনোভাব ব্যক্ত করেন তিনি। এদিকে ১৭ শতাংশ নয় বরং ১৪ শতাংশ কর নির্ধারনের পাশাপাশি পুর্বের ন্যায় বর্গফুটের মুল্যায়নে এসেসমেন্ট করার দাবী করলেন ’কর সুরক্ষা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এক মাসের মধ্যে দাবী না মানলে মানববন্ধন ও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সমাবেশ করার ঘোষনা দেন সংগঠনটির নেতারা। এ নিয়ে তারা গত সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।

জানা যায় , কর পুর্নমুল্যায়ন করার সময় কারো মালিকানাধীন ভবনটি যদি সম্পুর্ন ভাড়া প্রদত্ত তবে বাৎসরিক রক্ষনাবেক্ষণের ব্যয় বাবদ দুমাসের ভাড়া বাদ দেয়া হবে। অবশিষ্ট দশ মাসের ভাড়া হিসাব করেই কর নির্ধারন করা হবে। এ ছাড়া কারো ভাড়াঘর নির্মান বা ক্রয়ে সরকার, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, তফশিলি ব্যাংক বা কোন আর্থিক প্রতিষ্টান থেকে ঋন নিয়ে থাকে তাহলে ঋনের বাৎসরিক সুদ মুল্যায়ন থেকে বাদ দেয়া হবে।

মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত বছর দুই ধাপে পঞ্চবার্ষিকী কর পুনমুল্যায়ন শুরু করে চসিক। এর মধ্যে ২০ মার্চ থেকে ১১ ওয়ার্ড এবং ২০ অক্টোবর থেকে অবশিষ্ট ওয়ার্ডগুলোতে। এ পুর্নমুল্যায়নে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয় চসিক। প্রথমত পুর্বের ন্যায় বর্গফুট ভিত্ত্বিক এসেসমেন্ট বাদ দেয়া এবং তার পরিবর্তে ভাড়া ভিত্তিক কর নির্ধারন। এ ছাড়া অতীতে পুর্নমুল্যায়ন করা ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টি ’কনজার্ভেন্সি’ এবং ১৪ ওয়ার্ডকে ’নন-কনজার্ভেন্সি’ হিসেবে গন্য করা হতো। কনজার্ভেন্সি ওয়ার্ডের গৃহমালিকরা ১৭ শতাংশ এবং নন কনজাভেন্সি ওয়ার্ডের গৃহমালিকদের দিতে হত ১৪ শতাংশ গৃহকর। তবে এবার এসেসমেন্ট করার ক্ষেত্রে সবগুলো ওয়ার্ডকেই কনর্জাভেন্সি ওয়ার্ডের আওতায় আনা হয়।

অর্থাৎ ১৪ ওয়ার্ডে নতুন করে ৩ শতাংশ কর বৃদ্ধি পায়। ’দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশান রুলস এ্যাক্ট ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমান ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে সিটি কর নির্ধারন করা হয়। ইতিমধ্যে অনেক ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্টান, স্থানা নতুনভাবে নির্মান ও বিলুপ্ত হওয়ার ফলে অনেক স্থাপনা পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং উন্নয়ন হয়েছে এসব ওয়ার্ডে। ফলে সেই আইন মেনেই গৃহ ও ভুমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনমুল্যায়ন শুরু করে চসিক। সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী হোল্ডিং মালিকদের তাদের বাসা ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয়ের বিপরীতে ১৭ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হবে কর্পোরেশনকে। ১৭ শতাংশ করের মধ্যে হোল্ডিং বাবদ ৭ শতাংশ, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের বিপরীতে ৭ শতাংশ এবং সড়কবাতির বিপরীতে ৩ শতাংশ কর নির্ধারন করা আছে।

এদিকে ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারী সরকার নতুন করে গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী, নতুন করে ৮ শতাংশ স্বাস্থ্যকর এবং অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী সড়কবাতির উপর পুর্বের ৩ শতাংশকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। সব মিলিয়ে নতুন গেজেটে চসিককে ২৯ শতাংশ কর নির্ধারনের সুযোগ দেয়া হয়। গত বছরের মার্চে কর পুনমুল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হওয়ার দ্বিতীয় দিনে বহদ্দারহাটে আয়োজিত একটি সমাবেশ থেকে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরীর জনসাধারনের সুবিধা বৃদ্ধি না করে কর না বাড়ানোর জন্য সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের প্রতি আহবান জানান। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যের প্রেক্ষিত্রে ওই বছরের এপ্রিলে মুখ খোলেন আ.জ.ম নাছির। তিনি বলেন, ’সাবেক একজন মেয়র ও বিশিষ্টজনরা পত্রপত্রিকায় মিথ্যা বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত।

এদিকে পুরনো পদ্ধতি মেনেই গৃহকর পুনমুল্যায়নের দাবী করেন ’কর সুরক্ষা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন,’ আমরা একমাসের আল্টিমেটাম দিয়েছি। আমাদের দাবী না মানলে আমরা মানববন্ধন করবো এবং ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সমাবেশ করবো। তাদের মতে,’ ১৯৮৬ এর রুলস এর কথা বলেন। এরপর তো অনেক মেয়র ছিলেন। তারা তো সেটি ফলো করেনি। উনারা চট্টগ্রামবাসীকে ভালবেসেই বর্গফুটভিত্তিক এসেসমেন্ট করেছিলেন। বর্তমান মেয়রও যদি আমাদের ভালবাসেন তাহলে পুর্বের ন্যায় করবেন।

মেয়র আ.জ.ম নাছির বলেছেন,’যারা বিরোধিতা করছেন তারা ৬০ লক্ষ নগরবাসীর তুলনায় কতজন? এরা তো হাতেগুনা কয়েকজন। আসলে এরা অসৎ উদ্দেশ্যে এসব করছেন। আমি তো আইনের বাইরে কিছু করছি না। যারা স্বাধীন দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাবেন তাদের কোন অবস্থাতেই ছাড় নয়। নাগরিক সুবিধা ভোগ করবেন অথচ ট্যাক্স দিবেন না তা তো হবে না। আমি তো চুরিকে কোন অবস্থাতেই বৈধতা দিতে পারব না।

যদি সরকারী গেজেটের আলোকে ট্যাক্স আদায় করি তাহলে ২৭ শতাংশ নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু নিব ১৭ শতাংশ। বাস্তবতা হচ্ছে এমনিতেই চুরি করছে। ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করছে বলছে, ১০ হাজার। তারাই তো আবার বছরের পর বছর ভাড়া বাড়াচ্ছে। অতচ এরাই বছরের পর বছর কর পরিশোধ করছে না। আমি কর পরিশোধ করেননি এমন লোকজনের তালিকা করতে বলেছি।

প্রথমে বলবো পরিশোধ করতে। না করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। অপরদিকে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন,’মানুষের উপর করের বোঝা চাপানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। এটা জুলুম হচ্ছে। শীঘ্রই সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়গুলো ক্লিয়ার করবো। করের বোঝা চাপিয়ে দিলে সাধারন মানুষ তো মানবে না। তিনি বলেন.’আইন তো সাধারন মানুষের জন্যই। সাধারন মানুষের পক্ষে গেলেই মানবো। সাবেক মেয়র মনজুর আলম বলেন.’আমি একজন নগরবাসী হিসেবে মেয়রের কাছে অনুরোধ করবো, জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কর ধার্য্য করা হোক।

আবার কর্পোরেশন যেহেতু টেক্স নির্ভর প্রতিষ্টান তাই সেটিও বিবেচনার বিষয়। ভাড়াভিত্ত্বিক এসেসমেন্ট করাতে ঘর ভাড়া যে এলাকায় বেশি সে এলাকার লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কার আছেন ভবন মালিকরা। কারন একই আয়তনের একটি ভবনের ভাড়া শহরের একেক এলাকায় একেক রকম।

অতচ সবাইকে আয়ের হিসাবে ১৭ শতাংশই পরিশোধ করতে হবে। সাবেক মেয়র মনজুর আলমের মেয়াদকালে করা এসেসমেন্ট অনুযায়ী বর্তমানে সরকারী বেসরকারী হোল্ডিং রয়েছে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮৯টি। এসব হোল্ডিং এর বিপরীতে চলতি অর্থ বছরের ২০১৬-১৭ ঘোষিত বাজেটে ১ হাজার ১ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকার আয়ের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারন করেছে চসিক। এর মধ্যে বকেয়া কর ও অভিকর থেকে ২৪২ কোটি ৪৬ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা, হাল ও অভিকর ৫৫০ কোটি ৮৯ লক্ষ ৪৮ হাজার টাকা অন্যান্য কর থেকে ২২২ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা আয় ধরা হয়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.