ধাক্কা মারবেন না, আমাদের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরন হয়

0

জুবায়ের সিদ্দিকী :: পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সাংবাদিকদের উপর যেভাবে প্রতিহিংসা পরায়নতায় ভুগছে তা দু:খজনক। সন্দেহ নেই, এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত পুলিশের একটি ক্ষুদ্র অংশ। যারা নিজেদের অনিয়ম ও দুর্নীতি ফাঁস করার দায়ে সংবাদ মাধ্যমকে প্রতিপক্ষ ভাবার রোগে ভুগছেন, তারা বোকার রাজ্যে বাস করছেন। সরকারের দাবী তারা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা তথা মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের এক ক্ষুদ্র অংশের ক্ষমতার অপচর্চা সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কেই প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের চিড় ধরেছে। কয়দিন আগে ঢাকায় সাংবাদিক নাজমুল হুদাকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ যে প্রতিহিংসাপরায়ন আচরন করেছে তা শুধু বেআইনীই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমুর্তির জন্যও ক্ষতিকর। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে যখন ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে, তখন তা নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা না নিয়ে তারা যেভাবে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা প্রকারান্তরে সাংবাদিকদের ক্ষোভকে আরও ঘনীভুত করতেই অবদান রাখছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় হরতাল চলাকালে পুলিশের কতিপয় দুর্নীতিপরায়ন সদস্য যেভাবে বিনা কারনে প্রতিহিংসা পরায়ন মনোভাব দেখিয়ে এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিককে মারধর করেছে তা যে কোন বিবেচনায় নিন্দনীয়। সেদিন শাহবাগে পুলিশের কিছু সদস্য সেভাবে বিনা উস্কানীতে একজন হরতাল সমর্থক কর্মীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তা কোনভাবেই কাম্য ছিল না। তাদের যে অসংযত আচরন ক্যামেরায় ধারন করতে গিয়ে এটিএন নিউজের দুজন সাংবাদিক পুলিশের হাতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়। পুলিশের হঠাৎ এই বাড়াবাড়ি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকায় সভারে সাংবাদিক নাজমুলকে প্যান্ট চুরির সহ ৬টি মামলার পরই হামলা হল এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিকের উপর। সাংবাদিকরা মনে করছেন সরকারের সঙ্গে মিডিয়ার বিরোধ তৈরীর ষড়যন্ত্র পুলিশ থেকে শুরু হয়েছে। হঠাৎই মারমুখী হয়ে উঠেছে পুলিশ। আড়ালে নয়, প্রকাশ্যে দিবালোকে সাধারন নাগরিক সহ নিরহ গনমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলে পড়েছে তারা। এভাবে শুধু ঢাকায় নয় খাগড়াছড়ি, সিলেট ও চট্টগ্রামেও ঘটেছে। চট্টগ্রামের এক সাংবাদিক নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথায় বাসে বাসায় আসার পথে গাড়ি থেকে নামিয়ে ইয়াবা আছে বলে আটকে রাখে।

এরপর মানসিক নির্যাতন চালানো হলে শেষতক চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ হস্তক্ষেপ করেন এবং তাৎক্ষনিক কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে চট্টগ্রাম ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের উপর চড়াও ও নির্যাতনের কথা চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা ভুলেনি। চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের মারমুখী আচরনের শিকার হয়েছেন বিশেষ করে ফটো সাংবাদিকরা। পুলিশের এই অসদাচরন সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা সাংবাদ সংগ্রহে বা ছবি সংগ্রহে রাজপথে এভাবে কতিপয় পুলিশের বিনা কারনে আক্রোশের শিকার হচ্ছি হরহামেশা। আগ্রাবাদ হতে সন্ধ্যায় অফিসে আসার পথে সিআরবি এলাকায় বাইক থামালেন র‌্যাবের সদস্যরা। আমার বাইকের পেছনে প্রতিবেদক গোলাম শরীফ টিটু বসা।

মোটরসাইকেল থামানোর পর অন্ধকারে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা আমাদের চেহারা দেখে মন্তব্য করলেন ,’সে বয়স আর নেই’। আমি ও আমার সহকর্মী হেসে উঠলাম। এভাবে অনেকে যে ভাল ব্যবহার করেনা তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের বাড়াবাড়ি আমাদের দায়িত্ব পালনকে কষ্টসাধ্য করে তোলে। আমার স্ত্রীকে নিয়ে একদিন বাইকে যাচ্ছিলাম পতেঙ্গার দিকে। ঈশান মিস্ত্রির হাট রেলক্রসিং এর পাশে দন্ডায়মান এক সার্জেন্টকে দেখলাম, চেঁচিয়ে বলছে ট্রাকের ড্রাইভারকে দেশ চালায় পুলিশ-অমুক তমুকের কথা বলিস কেন। শালার ব্যাটা পাছায় লাথি মারমু। এভাবে শুধু সাংবাদিক নয়, পাবলিকের সাথেও পুলিশ এ আচরন করছে। এইতো সেদিন বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের পাশ দিয়ে আসতেই এক ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল দিয়ে থামালো। বললেন,’কাগজ দেখান স্যারকে। বাইক ছেড়ে কাগজ নিয়ে সার্জেন্টের কাছে কাগজপত্র দেখাতেই বললেন,’ সব ঠিক আছে তো। এই কথা বলে ট্রাফিক পুলিশদের সার্জেন্ট বললেন,’ আরে ব্যাটা পুলিশের চাকরী করতাছ।

ক্রিমিনাল চিনো না। কাগজওয়ালারে পাঠাইছ, কাগজ নাই এমন পাবলিক পাঠাইবা। ভাইজান আপনি যান। মেহেদিবাগ মোড়ে প্রায়ই ডিউটি করেন সার্জেন্ট ছিদ্দিক। মেজাজ তার সবসময় থাকে চড়া। সেদিন ছিল শুক্রবার। সার্কুলেশনের টাকা সংগ্রহ শেষে চেরাগীপাহাড় থেকে ষোলশহর সংবাদপত্র এজেন্টের কাছে যেতে সার্জেন্ট সাহেব পথে গাড়ি থামালেন। বাইক ছেড়ে দাঁড়াতেই কমান্ড দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,’ কাগজপত্র বের করেন ছটফট, সময় নেই। কাগজপত্র বের করে ব্লুবুক, ইন্স্যুরেন্স কপি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ভাজ করতেই বললেন ’আপনার এত সময় লাগে কেন? সব কাগজ দেখলেন। বলেন, কি করেন? পত্রিকায় কাজ করি বলতেই রেগে গেলেন। বলেন,’সাংবাদিক হইছেন কি হইছে। এভাবে রাস্তায় কাগজ দেখাবেন। আমি বললাম,’আমি বিরক্ত বা সাংবাদিক পরিচয়তো আপনাকে দিইনি।

এভাবে অযথা গায়ে পড়ে পুলিশের ঝগড়া করার মনমানসিকতা আমাদের দু:খ দেয়। পুলিশের বেধড়ক পিটুনির শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন দুইজন এটিএন নিউজের সাংবাদিক। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ’ধাক্কা ধাক্কি হয়েছে। ও কিছুইনা। এর পর সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। সরকারের শীর্ষ নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা এভাবে বেফাঁস কথাবার্তাও আমাদের বেদনাহত করে। আমরা কারো প্রতিপক্ষ নই। জীবন ও জীবিকার তাগিয়ে সাংবাদিকতা করছি। সত্য ও ন্যায়ের পথে আমার বন্ধুরা তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে যখন রাষ্ট্রের বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর দ্বারা আক্রান্ত হন তখন যদি কোন মন্ত্রী বেফাঁস কথা বলেন, তখন আমাদের মনে আঘাত লাগে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আরও কাছের থেকে আমরা এমন আচরন আশ করি না।

সরকারের যে কোন কর্মকান্ড অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করতে একটি মহল ও পুলিশের একটি অংশ তৎপর। পুলিশ সাংবাদিকদের সাথে সরকারের মধ্যে একটি ভুল বুঝাবুঝি বা বিরোধ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছে পুলিশেরই একটি অংশ। পুলিশ জনগনের বন্ধু। এই বন্ধু এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা কি পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা অনুধাবন করছেন। দায়িত্বপালন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে যদি গনমাধ্যমকর্মীরা লাঠিপেটার শিকার হয় তবে জনগনের অবস্থা কি হবে। একজন প্রবীন সাংবাদিক সেদিন আমাদের সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয়ে বলছিলেন, এখন পুলিশ চায় ষ্টপ প্রেস। আমরা বলবো, পুলিশের ফ্্রাংকেন্টাইনি রুদ্ধমুর্তি বন্ধ হোক। তবে কে শুনে কার কথা। যে দেশে যানবাহনের অনিয়মের জরিমানার টাকা পুলিশের পকেটে যায়, সে দেশের পুলিশের আমুল পরিবর্তন জরুরী।

সাংবাদিকরা পুলিশের মতই দায়িত্ব পালন করে দেশ ও জাতির স্বার্থ। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে কাজ করে। সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহ করে মাঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে বলবো, দয়া করে আমাদের ধাক্কা মারবেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিক ভাইদের সঙ্গে পুলিশের মারামারি হয় না, মাঝে মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। কথা সত্য। পেশাগত কারনেই পুলিশ ও গনমাধ্যমর্কীরা কর্তব্যপালনে ঠোকাটুকি ধাক্কাধাক্কি হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশের বিধড়ক পিটুনিতে বিনা কারনে রক্তাক্ত হয়ে যখন আমার সাংবাদিক বন্ধু হাসপাতালে যায় তখন কি এটাকে ধাক্কাধাক্কি বলা চলে।

চট্টগ্রামে বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন কম হয়নি। এই তো সেদিন কতিপয় দুর্বৃত্ত চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয় সহ সাংবাদিকদের উপর হামলা চালালে সাংবাদিকগন পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। পুলিশ সরাসরি সেই সব বকাটে ও দুর্বত্তদের পক্ষ নেয়। এর পর চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজ গর্জে উঠলে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে। সবসময় সব সরকারের আমলে কারনে অকারনে সাংবাদিকরা পুলিশের টার্গেট হচ্ছে। এই মারমুখি ব্যথি থেকে বের হয়ে আসতে হবে পুলিশকে। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যেতে হল পাহাড়তলী থানায়।

সহকর্মী গোলাম শরীফ টিটু সহ। সন্ধ্যায় থানা জমজমাট। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। চট্টগ্রাম নিবন্ধনের এক সিএনজি চালক সহ এক কনষ্টেবল ধরে এনে ডিউটি অফিসারকে বললেন,’স্যার আনছি হেতের কাগজপত্র বাড়িত বৌয়ের কাছে রাখি আইছে। কি কইরতাম। ডিউটি অফিসার বললেন,’ ট্যায়া লই ছাড়ি দে। ড্রাইভার বলল,’ কিয়ের ট্যায়া। এ কথা বলতেই ডিউটি অফিসার বললেন,’আরে ব্যাটা পাছাই বাইট্যা মরিচ লাগাইলে বুঝবা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.