চাল নিয়ে চালবাজির নেপথ্যে মালিকরা

0

জুবায়ের সিদ্দিকী- 

বিগত ৭ মাসে চালের দাম দুই দফায় বেড়েছে। মোটা চালের দাম দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সরকার ধান চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর পরই চালের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। গত জানুয়ারী মাসে আমন ধান গোলয় উঠার পরও চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দুই তিন টাকা র্যন্ত বেড়েছে। গত সপ্তাহে আরেক ধাপ বেড়েছে। আড়তদার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের দাবী, উত্তরবঙ্গের মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের দাম দফায় দফায় বেড়ে চলেছে।

আগামী দুই তিন মাস ধরে বাজারে চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানান তারা। দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রন করে উত্তরবঙ্গের মিল ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষকদরে কাছ থেকে কমদামে চাল কিনে গুদামজাত করেন। বাজারে সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থির করে তোলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ, দিনাজপুর, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সান্তাহার (বগুড়া), রাজশাহী, কুস্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় তিন শতাধিক চাল মিল ব্যবসায়ী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ জন বড় মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ধান চালের বাজার নিয়ন্ত্রন করেন।

চট্টগ্রামের বড় পাইকারী বাজার পাহাড়তলী ও চাক্তাই ব্যবসায়ীরা জানান, নওগাঁ, মহাদেবপুর, আশুগঞ্জ দিনাজপুর, পাবনা,ঈশ্বরদির মোকামগুলো থেকে বেশিরভাগ চাল আসে চট্টগ্রামে। আশুগঞ্জ থেকে বেতি, ইরি জাতের, দিনাজপুর থেকে মিনিকেট, পাইজাম, চিনিগুড়া, কাটারিভোগ জাতের আতপ এবং নওগাঁ, পাবনা, ঈশ্বরদি থেকে সিদ্ধ জাতের চাল আসে এখানে। প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ মেট্রিকটন চাল চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে আসে। ৫০ কেজি বস্তায় ১৬-২১ টাকা কমিশন পান আড়তদাররা। আর পাহাড়তলী পাইকারী বাজারে আসে প্রতিদিন ৪০০-৪৫০ মেট্রিকটন চাল। ধান চাষে উদ্দ¦ুদ্ধকরনে সরকার নান উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি ভুর্তুকি ও ধান চালের মুল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। এর ফলে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বেড়েছে।

চাল আমদানী নিরুৎসাহিত করতে আমদানী শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। চাল আমাদানীতে ২৫ শতাংশ কাষ্টমস ডিউটি (শুল্ক) এবং ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) নির্ধারিত রয়েছে। ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চাল আমদানীকারকদের শুল্ক কমানোর দাবী করে আসছে। সরকার শুল্ক বাড়ানোর কারনে তিন চার বছরে বিদেশ থেকে চাল আমদানী কমে আসে।

তবে গত মৌসুমে বন্যা খরায় চাল উৎপাদন কম হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে ফের চাল আমদানী বেড়েছে। চালের বাজারে অস্থিরতা নিয়ে গত সপ্তায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের সাথে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আমদানী শুল্ক না কমানোর প্রতি সরকার অটল রয়েছে বলে পুনব্যক্ত করেছেন তিনি। পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি মো; জাফর আলম বলেস, সরকারীভাবে ধান, চাল সংগ্রহ অভিযানের পর থেকে চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। উত্তরবঙ্গের চাতাল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাজার নিয়ন্ত্রনের জন্য সরকারীভাবে মনিটরিং এর উদ্যোগ নেওয়ার দাবী করেছেন তিনি।

তার মতে, কৃষক পর্যায়ে ধানের ন্যায্যমুল্য পাওয়ার জন্য সরকার মুল্য বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সেই মুল্য বৃদ্ধি মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের পকেটে যাচ্ছে। কৃষক প্রকৃতভাবে লাভমান হচ্ছে না। ধান কাটার পর ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে কিনে মজুদ করে ফেলে। পরে বাজার অস্থির করে বাড়তি দামে বিক্রি করে চাতাল মালিক সিন্ডিকেট। চাক্তাই ও পাহাড়তলী চালের বাজারে ঘুরে দেখা যায়, আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি ১৬০০ টাকা ধরে। এক মাস আগে তা বিক্রি হয়েছিল ১৪০০ টাকায়। মোটা সিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ১৬৫০ টাকা দরে।
একমাস আগে তা বিক্রি হয়েছিল ১৫০০ টাকায়। আতপ ( বেতি) চাল ১৮৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৯৫০ টাকা দরে। জিরাসিদ্ধ ২১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২০৫০-২৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইজাম সিদ্ধ ১৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৫০-১৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। স্বর্না সিদ্ধ ১৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতির সভাপতি বাবু শান্ত দাশগুপ্ত বলেন,’সরকারের কাছে পর্যাপ্ত চাল মজুদ নাই। তিন চার বছর যাবৎ ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, বিয়েতনাম চাল আমদানী বন্ধ।

বরাবরই বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভর করে। বিগত তিন চার বছর ধরে দেশের কৃষকরা ধান-চালের ন্যাজ্যমুল্য না পাওয়ায় চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়েছে। তবে সরকার আগ্রহ সৃষ্টি করতে এখন কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়ের করায় বর্তমানে তারা ন্যাজ্যমুল্য পাচ্ছেন। তিনি বলেন,’ যদি সরকার চাল আমদানীর উপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করে তবে বস্তাপ্রতি ৪৫০ টাকা কমে আসবে। এদিকে গত সপ্তাহে খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম ঘোষনা দিয়েছেন,’ কোন অবস্থাতেই আমদানী শুল্ক কমানো হবে না।

খাদ্য মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে (২০১৫-২০১৬) বেসরকারীভাবে ২৫৭ দশমিক ২৪ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানী হয়েছিল। অথচ চলতি অর্থ বছরের (২০১৬-২০১৭) সাড়ে সাত মাস শেষে গত ১৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমদানী হয়েছে মাত্র ৪১ দশমিক ১৩ হাজার মেট্রিকটন। প্রসঙ্গত বর্তমান চাল আমদানীতে ২৫ শতাংশ কাষ্টমস ডিউটি শুল্ক এবং ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আড়ি নির্ধারিত রয়েছে। এদিকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের চালের বাজার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী , ভারত থেকে বেতি বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি ১৮৫০ টাকা যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৭৫০ টাকা। একমাস আগে ১৫শ টাকায় বিক্রি হয়েছিল ভারতীয় বেতি। মিনিকেট ২৮ এক সপ্তাহে ১২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয় ২২শ টাকায়ও বিক্রি হয়েছিল ২২ শ ২০ থেকে ২২শ ৩০ টাকায়। একমাস আগে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হওয়া বেতি-২৯ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়। এবার আমদানীকারকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

ফলে স্বাভাবিকভাবে চালের মুল্য কিছুটা বাড়ছে। তবে কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী তেমন বাড়েনি। সাধারন লোকজনের অভিযোগ, আমন মৌসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় চালের বাজার স্বাভাবিক হওয়ার কথা। কিন্তু মজুদদার চাতাল মালিকদের অসাধু কিছু সিন্ডিকেটের কারনে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ কমেছে। সরকার যদি অসাধু এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন না করে তাহলে চালের উদ্ধগতি রোধ করা সম্ভব হবে না।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.