হযরত শাহজী পীর ছাহেব : সাহেবে কাশফে কারামাত

0

খোন্দকার মোজাম্মেল হক – 

বারীয়া দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা আওলাদে রাসুল হযরত শাহজী পীর ছাহেব (রহ.) সম্পর্কে আজকের সূর্যোদয়’-এ আমরা প্রায়ই সংবাদ প্রকাশ করতাম। একদিন ঢাকার খানেকায় ফোন করে পীর ছাহেব (রহ.) খাদেম আবদুল হাই ভাইকে চট্টগ্রাম নিয়ে গেলেন। দরবারে ডেকে নিয়ে তিনি আবদুল হাই ভাইয়ের হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে যাও। এটা মোজাম্মেলকে পৌঁছিয়ে দেবে।’

হাই ভাই পরদিন বিকেলে ‘আজকের সূর্যোদয়’ অফিসে এসে আমাকে সেই চিরকুটটি দিলেন। খুলে দেখলাম, সেখানে বাবাজান কেবলা তাঁর লকবগুলো ঠিক করে দিয়েছেন। বুঝতে পারলাম আমরা পত্রিকায় নানারকম বিশেষনে বাবাজানের নাম প্রকাশ করি, সেটা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

চিরকুটটাতে লিখা ছিল, “রাহ্বারে শরীয়ত ও ত্বরীকত, হাদীয়ে কওম ও মিল্লাত, পেশোয়ায় আহলে সুন্নাত, আবু মাছাকিন, আমীরুল হজ্ব, পীরে কামেল, হাফেজ মাওলানা শাহ ছুফি ছৈয়্যদ আবদুল বারী শাহ প্রকাশ শাহজী পীর ছাহেব কেবলা।

আমি তখন ‘পীরে ত্বরীকত’ বা ‘পীরে কামেল’ এমন সব লকবের মাজেজা বুঝতাম না। আমাদের পীর ভাই মিজানুর রহমান কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নবীয়াবাদে তার বাবা আবদুল ওয়াদুদ সরকারের নামে একটা ফাজিল মাদ্রাসা করলেন। বাবাজান কেবলা প্রথমবারের মতো সেই মাদ্রাসায় যাবেন। আমাকে দিলেন মাহফিলের লিফলেটটি তৈরি করতে। বাবা বললেন, ‘আমি সভাপতিত্ব করবো, প্রধান অতিথি হাশমী সাহেব, বড় মিয়া আর মেজো মিয়া বিশেষ অতিথি। আর স্থানীয় কোনো আলেম থাকলে মিজানকে জিজ্ঞাসা করে নিচে লিখে দিও।’

তো, আমি লিফলেটটি তৈরি করে বাবাজানের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, “সবাইর নামের আগে পীরে কামেল লিখেছো কেন? শুধু আমার নামের আগে থাকুক। বাকীগুলো পীরে ত্বরীকত লিখে দাও।”

আমি প্রধান অতিথি কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমীর নামের আগে কি হবে জানতে চাইলাম। বললেন, ‘পীরে ত্বরীকত লিখো।’

বারীয়া আলীয়া ত্বরীকার অজিফাটির শেষ সংস্করণ প্রকাশের আগে মাওলানা মঈনউদ্দিন আল কাদেরীকে দিলেন ঠিকঠাক করে দিতে। তখন ঢাকায় দরবার ছিল মালীবাগে। আমাকে বললেন, এটা মঈনুদ্দিনসহ দেখে তোমার প্রেসে ছেপে দাও। দশ হাজার ছাপাবে। আমি বললাম, বাবা এতগুলো কি লাগবে? বাবা বললেন, আমি আর কতদিন থাকবো। একদিন চলে যাবো হঠাৎ করে, তখন দরবার চলবে এই অজিফায়।

অজিফা প্রকাশের আগে আরবী, উর্দ্দু ইত্যাদি কম্পোজ ও লিখার কাজ শেষ করার জন্য ফকিরাপুলে যে মাওলানার কাছে গেলাম, তিনি ভিন্ন আকীদার একটা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তবু তিনি কাজটি করে দিলেন। এবার এলাম বাবাজানের কাছে। তিনি বিপরীত দিকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেভাবে থেকেই বললেন, ‘আমার শুনতে হবে না। যেভাবে আছে সেভাবে ছেপে দাও। আগে একটা ভূমিকা লিখে দাও। নিচে তোমার নাম দিও।’

আমি মুফতি মঈন উদ্দিনের শরণাপন্ন হয়ে বললাম, আমি কি লিখবো, বাবাতো কিছু বললেন না? তিনি বললেন, আপনাকে আদেশ করেছেন, এখন এটা আপনিই লিখবেন, আমিতো কিছু বলতে পারবো না।

মালীবাগ দরবারের একটা কক্ষে বসে একটা লিখা দাঁড় করালাম। হাই ভাইকে বললাম, একটু শুনবেন। তিনি বললেন, বাবাকে আগে শোনান। তখন সেই দরবারের ইমাম ছিলেন হাফেজ হাবীবুল্লাহ। তাকেও বললাম শুনতে। তিনিও রাজী হলেন না। গেলাম বাবাজানের কক্ষে। তিনি আগের মতোই বিপরীত দিকে ফিরে বিশ্রামরত।

বললাম, বাবাজান দু’টি কথা লিখেছি। আমি একটু পড়ি।
বললেন, ‘পড়তে হবে না আমি জানি। এটাই ছেপে দাও।’
বললাম, একটু কথা ছিল বাবাজান?

বললেন, ‘সেটাও আমি জানি। দু’টো লাইন খালি রেখেছো। তোমার ইচ্ছে আমাকে মুজাদ্দেদ লিখার, লিখে দাও। আর আমার ১৭টি খেলাফত আছে বিভিন্ন পীর-মুর্শিদের কাছ থেকে। সেটা লিখে দাও। যাও…।’

আরেকটি বিষয় মনে পড়ছে। একদিন শান্তিনগর দরবারে আমাকে একান্তে ডেকে কয়েকটি বাংলা কিতাব দিলেন। এরপর বললেন, ‘পত্রিকায় এলমে তাসাউফের উপর একটা ধারাবাহিক লিখা প্রকাশ কর।’

আমি জানতে চাইলাম, বাবা আমি কি লিখবো, এ সম্পর্কেতো আমার তেমন জ্ঞান নেই। এটাতো খুবই কঠিন বিষয় মনে হয় আমার কাছে।
বললেন, এই বইগুলোতে চোখ বুলাবে। শোয়ার আগে রাতে আমাকে ৫টি মিনিট দিও। চোখ বন্ধ করে মোরাকাবা-মোশাহেদা করবে। দরুদে তাজ পড়ে ঘুমোবে। সকালে ওঠে লিখতে থাকবে।’

আমি একটা ঘোষণা দিলাম যে, ‘শাহজী পীর ছাহেব কেবলা আমাকে এলমে তাসাউফের উপর লিখতে আদেশ করেছেন। তাঁরই নির্দেশে এই ধারাবাহিক লিখাটি প্রকাশিত হচ্ছে।’

বেশ কয়েক সংখ্যা এই সম্পাদকীয় নোট প্রকাশের পর একদিন বললেন, ‘এই নোটটা আর প্রকাশ করো না। এলমে তাসাউফ চালিয়ে যাও।’
তো, একটা কথা বলি। একদিন আমাকে বলেছেন, লিখা শেষ করে একবার চোখ বুলিয়ে পড়ে নেবে, তখন আমি শুনতে পাবো।

এই যে হযরত শাহজী পীর ছাহেব (রহ.), তিনিযে কত বড় কুতুব-আবদাল ছিলেন, সেটা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমি সামান্য কয়েক বছরে এই মহান আল্লাহ পাকের মকবুল ওলীকে যতটা দেখেছি, তার বর্ণনাও সারা জীবনে শেষ করা যাবে না।

দরবারের এক বার্ষিক মাহফিলে গাউসুল আজম বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রা.)-এর দরবার থেকে বাবাজানের আমন্ত্রণে এলেন গাউসে পাকের আওলাদ। তিনি বাবাজান কেবলার কথা বিশাল মাহফিলে আরবীতে তুলে ধরলেন। সেই বক্তব্য সাথে সাথে খতিবে বাঙাল আল্লামা ওবাইদুল হক নঈমী অনুবাদ করে স্রোতাদের জানিয়ে দিচ্ছিলেন। আগেই বাবাজান কেবলা আমাকে বলেছিলেন, নঈমী সাহেবের বক্তব্য যেন রেকর্ড করি ও লিখি। হযরত খালেদ আবদুল কাদের জিলানী যে বক্তব্য রাখেন, তাতে তিনি বললেন, ‘বারী শাহ একজন আল্লাহ পাকের খাস ওলী। তিনি সম্পর্কে আমার চাচাতো ভাই। তিনি গাউসে পাকের সরাসরি আওলাদ।’

এর আগের কথাও বলি। বাগদাদে ফাতেহা ইয়াজদাহমের রাতে গাউস মঞ্জিলে বড়পীর সাহেবের দরবারের সাজ্জাদানশীন আওলাদে গাউসে পাক বাবাজানের শানে তাঁর বাসায় রাতের খাবারের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত গাউস মনজিলের আওলাদদের সাথে সাজ্জাদানশীন হুজুর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন, ‘সৈয়দ আবদাল বারী শাহ ফ্রম বাংলাদেশ। হি ইজ দ্যা ডাইরেক্ট আওলাদে রাসুল, আওলাদে গাউসে পাক, আওলাদে ইমাম হোসাইন।’

তারপর দিন বাবাজান কেবলার সাথে আধ্যাত্মিক জগতের মহাসম্রাট হযরত মনসুর হাল্লাজের মাজার জেয়ারত করতে যাই। বাবাজান বললেন, এখানে তাঁর পাগড়ি ও ছাই দাফন করা হয়েছে। তিনি আধ্যাত্মিক সব স্তর পার হয়ে ফানা ফিল্লাহ-বাকা বিল্লাহ্ স্তরে পৌঁছে গেলে তাঁর ভেতর থেকে আওয়াজ আসতে থাকে, ‘আনাল হক’-আমিই সত্য। তখন তাঁকে শহীদ করা হয়। তাঁর ছাই দজলা নদীতে ফেলার পর নদীর তরঙ্গ থেকেও শব্দ আসতে থাকে, ‘আনাল হক’।

তো, সেই মাজারের খাদেম এগিয়ে এসে বাবাজান কেবলাকে জড়িয়ে ধরেন। বাবাজান বললেন, ‘ইয়া হাবিবী আনা হোসাইনী।’ খাদেম বললেন, ‘আনা হাসাইনী’।

নজফের একটা ঘটনাও মনে আছে। সেখানে আসাদিল্লাহ হিল গালিব আমীরিল মুমেনিন ইমামুত ত্বরীকত মাওলা আলী কারামাল্লাহ ওয়াজহুর মাজার। সেখানেই নূহ (আ.)-এরও মাজার। কূফা হয়ে কারবালা যাওয়ার আগে বাবাজান গেলেন নজফে। আমাদের কাফেলায় মোট ১৯ জন ছিলেন। সেখানে জিয়ারতের সময় বাবাজানের জজবা হালত চলে এলে আমাদের সাথী অন্য দরবারের আবুল কাশেম অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আমরা ফিরবো, কিন্তু কাশেমের জ্ঞান ফিরছে না। চানপুরী দরবারের পীর ছাহেব চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। আমরা বাবাজানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তিনি কাশেমের শরীরে হাতের স্পর্শ লাগিয়ে বললেন, ‘এই আবুল কাশেম ওঠো।’ কাশেম চোখ খুলে ওঠে দাঁড়ালেন।

হযরত শাহজী বাবাজানের কাশ্ফ কারামতের বর্ণনা দিন-রাতেও শেষ করা যাবে না। আল্লাহপাক এই জামানায় এমন মানুষ কি আর দুনিয়ায় পাঠাবেন, এমনটাই ভাবি মাঝে মাঝে। আজ খুবই হতাশ হয়ে পড়ি, যখন ভাবি এমন একজন আল্লাহপাকের মাহবুব ওলীর সংস্পর্শ পেয়েও তাঁকে আমরা চিনতে পারিনি। তিনি বলতেন, সবাইর মনের খবর আমার কাছে আছে। যে আখিরাতের জন্য এসেছো, তার জন্য আখিরাতের মঙ্গলের জন্য দোয়া, আর যে দুনিয়ার জন্য এসেছো, তার দুনিয়ার মঙ্গলের জন্য দোয়া পাবে। আমাকে বলতেন, সংসার গুছিয়ে নির্জনে আল্লাহকে ডাকো। রাসুল (দ.)-এর নির্দেশিত পথে জীবনটা ব্যয় করার চেষ্টা কর।

লেখক-  প্রধান সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয় ।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.