চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের দুই মেরুতে অশান্তির আগুন

0

গোলাম শরীফ টিটু : নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের কারনে পন্ড হয়ে গেছে হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণসংবর্ধনা অনুষ্টান। ১৮ ফেব্রুয়ারী হাটহাজারী পার্বতী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এম এ সালামসহ জেলা পরিষদের সদস্যদের সংবর্ধনা দিতেই এই অনুষ্টান আয়োজন করা হয়। বিকাল চারটায় সংবর্ধনা অনুষ্টানে অতিথিকে ফুল দিয়ে বরণকালে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষের সুত্রপাত। অনুষ্টানের প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গৃহায়ন ও গনপুর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সামনেই আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

দফায় দফায় সংঘর্ষকালে চেয়ার ছোড়াছুড়ি, লাঠিসোটা নিয়ে হামলা ও ফাঁকা গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ১০ নেতাকর্মী আহত হন বলে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান,’পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের পর সোয়া চারটার দিকে আগত অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণের ঘোষনা চলতে থাকে মাইকে। এ সময় অতিথিদের ফুল দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলমের অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের একদল নেতাকর্মী হুড়োহুড়ি করে মঞ্চে উঠতে শুরু করলে উপস্থিত কয়েকজন নেতা তাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে উঠতে বলেন।

এতে মঞ্জুরুল আলমের অনুসারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন। এক পর্যায়ে মঞ্চে উপস্থিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সোহরাব হোসেন নোমানের অনুসারীদের সাথে হাতাহাতি শুরু হয়। এক পর্যায়ে অনুষ্টানস্থল জুড়ে দু’গ্রুপ পরস্পরকে চেয়ার ছুড়ে মারতে থাকে এবং লাটিসোটা নিয়ে হামলা চালায়। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে এ অবস্থা বিরাজ করে। তাদের মধ্যে মো: ফারুক, আবুল কাশেম, আনোয়ার ও কামালের নাম জানা গেছে। এ ছাড়া সংঘর্ষকালে বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আগত নেতাকর্মীরা ভয়ে এদিক সেদিক পালাতে থাকেন। সাড়ে চারটার দিকে প্রধান অতিথি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নিজেই মাইক হাতে নিয়ে নেতাকর্মীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। মাইকে তিনি বলেন,’ শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা রাজনীতি করতে পারছি।

শেখ হাসিনা চোখ বন্ধ করলেই সবাই তোমাদের কুত্তার মত পেটাবে। বক্তব্যের এ পর্যায়ে নেতাকর্মীরা আবারও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। তখন ঘটনাস্থলের বাইরে চার রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে প্রধান অতিথি সহ অন্য অতিথিরা সমাবেশস্থল ত্যাগ করে চলে যান। সমাবেশের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা পুলিশ সদস্যরা তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন এবং সংঘর্ষে লিপ্ত নেতাকর্মীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এদিকে সংঘর্ষের পর বিকাল ৫টার দিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম.এ সালাম স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে আবারও মঞ্চে আসেন। তিনি বলেন,’ গত দুই যুগ ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। কখনো এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। আমি সংবর্ধনা নিতে চাইনি।

উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বারবার অনুরোধ করেছেন। তাই সংবর্ধনা নিতে রাজী হয়েছি। তিনি বলেন,’আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করছি। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে হবে। হাটহাজারীতে গ্রুপিং কখনোই আমাদের ভালোর দিকে নিয়ে যাবে। যারা এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তারা কারা? জানা গেছে,’ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এম.এ সালামের নিজের এলাকা হাটহাজারীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সোহরাব হোসেন নোমান ও মঞ্জুরুল আলমের অনুসারীরা নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছে।

অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম বলেন,’নোমান নিজের পছন্দের লোকদের নিয়ে অতিথিদের ফুল দিচ্ছিলেন। অপছন্দের লোকদের ফুল ছুড়ে ফেলে দিলে তারা ক্ষুদ্ধ হন এবং প্রতিবাদ করেন। নোমান বহিরাগত লোকজন এনে এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। দলীয় একাধিক সুত্র মতে, চট্টগ্রাম মহানগর ও দক্ষিণের কোন্দল গ্রুপিং দীর্ঘদিনের হলেও উত্তর জেলায় গ্রুপিং রাজনীতির উত্তপ্ত হাওয়া বইতে শুরু করে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের পর থেকে। নতুন কমিটিতে রাখা হয়নি বিদায়ী কমিটির ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মঞ্জুরুল আলমকে।

এর পর তার সমর্থকরা অভিযোগ করেছিলেন, ’কমিটিতে এলাকার জনপ্রিয় বেশ কয়েকজন নেতা ও সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের গুরুত্বপুর্ন পদ দেওয়া হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে’। জানা যায়, প্রথমবার মহাজোট সরকার গঠনের পর বিভিন্ন এলকায় দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে ভেতরে কোন্দল থাকলেও বর্তমান জেলা কমিটি গঠনের পর থেকে তা প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের আওতাধীন সাতটি সংসদীয় এলাকার মধ্যে গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ৫ টি আসন।

এরপর উপজেলা নির্বাচনে ওই সাত উপজেলার মধ্যে পাঁচটির মধ্যে বিজয়ী হওয়া নেতাদের কমিটিতে গুরুত্বপুর্ন পদে রাখা হয়নি। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যান সহ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এমপিদের বিরোধে নতুন মাত্রা পায়। বিগত সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মিরস্বরাই থেকে নির্বাচিত সংসদস সদস্য ও গনপুর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে একই একই এলাকার তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনের বিরোধ শুরু হয়। কমিটিতে যুগ্ন-সম্পাদকের তিনটি পদের কোটিতেই তাকে রাখা হয়নি। অপরদিকে যুগ্ন সম্পাদকের ১ নম্বর পদে রাউজানের আবুল কালাম আজাদ, মিরস্বরাইয়ের জসিম উদ্দিন ও হাটহাজারীর ইউনুচ গনি চৌধুরীর নাম ঘোষনা করেন সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

রাউজানের উপজেলা নির্বাচনে আবুল কালাম আজাদ মাত্র ৫ হাজার ভোট পান। আর এহছানুল হায়দার চৌধুরী প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। বাবুল উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির অর্থ সম্পাদক এবং আবুল কালাম আজাদ তিন নম্বর যুগ্ন সম্পাদক ছিলেন। আজাদ এলাকায় জনপ্রিয়তা না থাকলেও কমিটিতে স্থান পেয়েছেন এক নম্বর যুগ্ন সম্পাদক পদে। একইভাবে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রাথী হিসেবে বিজয়ী হন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইসমাইল।

তৎকালীন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ইউনুচ গণি চৌধুরী ছিলেন ভোটে চতুর্থ স্থানে। সেই ইউনুট গণি চৌধুরীকে করা হয় যুগ্ন সম্পাদক! মহাজোটের প্রথমবারের নির্বাচনে ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম প্রায় ৯৭ হাজার ভোট পান। এ নির্বাচনে সাকা চৌধুরী নির্বাচিত হন। তিনি গত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৯৮ কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক থাকলেও তাকে কোন গুরুত্বপুর্ন পদে রাখা হয়নি।

একইভাবে সীতাকুন্ডের আব্দুল্লাহ বাকের ভুঁইয়া, ফটিকছড়ির আফতাব উদ্দিন ও সন্দ্বীপের মো: শাহজাহান নিজ এলাকায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও গুরুত্বপর্ন পদ পাননি। এদিকে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে, জেলার দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে তৃনমুলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের দুরত্ব বেড়েছে বহুগুন, নেতারা ব্যস্ত ঠিকাদারী ও ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে। এরই মধ্যে মেরুকরন ঘটেছে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে। ত্যাগী, পরীক্ষিত ও বঞ্চিত নেতাকর্মীরা একাট্টা হচ্ছে,’ সাধারন সম্পাদক এম.এ সালামের বিরুদ্ধে।

তার নিজের এলাকার নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন সালাম বিরোধী অবস্থানে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠেছে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনা। উত্তর জেলার সাতটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে রয়েছে গ্রুপিং। অপরদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন দুটি গ্রুপের মধ্যে বাড়ছে তীক্ততা। বিগত ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ তুলে সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদ ও সাধারন সম্পাদক মফিজুর রহামানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে ভুমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুবী জাবেদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী গ্রুপ। এই গ্রুপে আছেন সাতকানিয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা নদভী, চন্দনাইশ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্রদুত আবুল কালাম, মহিলা নেত্রী চেমন আরা তৈয়ব ছাড়াও একাধিক সাবেক সংসদ সদস্য। রয়েছেন জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অনেক সিনিয়র নেতা। গ্রুপিং রাজনীতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে।

এরই মধ্যে প্রতিমন্ত্রী জাবেদের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন বলে জানান, সাবেক সংসদ সদস্য চেমন আরা তৈয়ব। অপরদিকে দক্ষিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে আছেন, পটিয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী, বাঁশখালী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী সহ একাধিক সাবেক সংসদ সদস্য। কর্নফুলী ও আনোয়ারা ব্যতিত সবকটি উপজেলা কমিটি আছেন মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে। সিনিয়র নেতাদের অভ্যন্তরীন বিরোধ, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি চর্চায় উত্তর দক্ষিণ দুই মেরুতে বিরাজ করছে অশান্তির আগুন। যার প্রভাব পড়তে পারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.