পতিদাহ

0

একটু আগে শ্রীমতী মৃণালিনী দেবীর আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বেরোনোর আগে তার অবিনশ্বর আত্মাকে নশ্বর দেহের নির্দিষ্ট কোটরে আটকে রাখার জন্য হোমিওপ্যাথ ও অ্যালোপ্যাথ প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি করা হয়নি। ২৬ দিন আগে ২৯ অক্টোবর যখন তার জন্য বেডপ্যান কেনা হয়, তখনই আশঙ্কা জেগেছিল ভব বোধ হয় আর টিকবে না। তার স্বামী রবি কোনো দিনও স্ত্রীকে ভব বলে ডাকেনি, বরং তার শ্বশুর বেণীমাধবের দেওয়া নাম ‘ভবতারিণী’ পাল্টে নিজের পছন্দের নাম ‘মৃণালিনী’ চাপিয়ে দিয়েছে পাতলা টিংটিংয়ে মেয়েটির ওপর। বিয়ের সময় রবির বয়স ২২ বছর ৭ মাস আর মেয়ের ৯ বছর ৯ মাস। মেয়েটি দেখতেও তেমন সুশ্রী নয়। ফরসা ও সুদর্শন মেয়ের জন্য যথেষ্ট খোঁজাখুঁজি করা হলেও যশোরের পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে সে সময় বিয়ের যোগ্য আর কোনো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যায়নি। ভালোতে-মন্দেতে মিলিয়ে রবির সঙ্গে উনিশ বছর ঘর করে চিতায় উঠল মৃণালিনী। মনে কিঞ্চিৎ পাপ ছিল বলেই তা মোচন করতে শেষ সময়ে রবি মন দিয়েছিল স্ত্রীর সেবায়। শেষ দিন মৃণালিনী নির্বাক থাকলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল রবির দিকে। দুর্বোধ্য সেই চোখের ভাষা। সাদামাটা শেষকৃত্যে রবির বুড়ো বাবা দেবেন ঠাকুর খরচ করেছিলেন ২৮ টাকা ২ পয়সা।
টাকাপয়সার যোগ-বিয়োগ যাঁরা করেছেন, তাঁরা এটা বলতে ছাড়েননি, মেয়েমানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সাঙ্গ করতে এত্তগুলো টাকা বেরিয়ে গেল!
রবি সটকে পড়ার তালে ছিল। সেটাই হওয়ার কথা। হ্যাঁ, ঠাকুরবাড়ির এতগুলো কর্মচারীর নাকের ডগার ওপর দিয়ে পালিয়েই গেল রবি। দেশের যে কানুন সবার জন্য প্রযোজ্য, রবির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে কেন?
দেবেন ঠাকুর যে টাকা বউমার জন্য খরচ করলেন, এর সঙ্গে আর গোটা দশেক যোগ করলে রবির অন্ত্যেষ্টিকর্মও সারা যেত। কিছু বাড়তি বাঁশ, খড়ি আর ঘি। তা ছাড়া রবির শরীরেও যথেষ্ট চেকনাই। একবার আগুন ধরে গেলে শরীরের স্নেহ-মাখন-ঘি আপনি উতলে উঠে অগ্নিশিখাকে লেলিহান করে তুলত। দেশলাইয়ের কাঠি খরচ হতো একটাই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের বুদ্ধিশুদ্ধির ঘাটতি আছে। নইলে পালিয়ে যাওয়া রবিকে ধরে চিতায় তুলতে এত পেরেশান হতে হয়! চিতা সাজানোর খরচ তো আছেই। পতিদাহ তো আর ধর্মের বাইরে কিছু নয়। বাংলায় আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। রবির জন্য বছরটা এমনিতে ভালো যায়নি।
গত বছর পৌষ মাসের ৭ তারিখ, ডিসেম্বরের ২২, রবি শান্তিনিকেতনে যে স্কুলটা বসিয়েছে, তার খরচ জোগাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। শুরুতেই তো আর ট্যুশন ফি আর বোর্ডিং চার্জ চাওয়া যায় না। আগে স্কুলটা জমে উঠুক, তখন দেখা যাবে। কুষ্টিয়ায় যে ব্যবসা খুলেছিল, তাতে ভীষণ মার খেল। পুরীর বাড়িটা বেচতে হলো। এই হতভাগী বউটাও নিজের কিছু অলংকার ছেড়ে দিয়েছিল স্কুলের জন্য। স্কুলে প্রথম ব্যাচে যোগ দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়সহ তিনজন গ্রীষ্মের ছুটির পর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেননি। এর মধ্যেই আবার স্ত্রী বিয়োগ!
অলংকরণ: তুলিলোকজন রাস্তায় নামল। স্ত্রীর চিতার আগুন পুরোপুরি নেভার আগেই পতিকে শুইয়ে ফেলতে হবে। পালিয়ে যাবে কত দূর? জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে চৌকি বসিয়ে ওর অবস্থান শনাক্ত করা হবে। তারপর পাঠানো হবে নিকটবর্তী স্ন্যাচার ব্রিগেড, তারাই প্রতিরোধ ও প্রতিকূলতার মধ্যে রবিকে ছিনিয়ে এনে প্রয়োজনে হাত-পা বেঁধে চিতায় শুইয়ে দেবে।
এ কেমন কথা! চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাবে। অথচ এই মানুষই না নিজের দেহত্যাগ করে আত্মাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল হাজার মাইল দূরে ঘুমন্ত স্ত্রীর কাছে। ১৮৯০-এর ২৪ আগস্ট রোববার। বোম্বে থেকে জাহাজে চড়ে বিলেতে যাচ্ছে রবি। এডেন থেকে নিজ হাতে সে স্ত্রীকে লিখেছে, রোববার দিন রাতে তার আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে জোড়াসাঁকোয় চলে যায়। মৃণালিনী তখন একটা বড় খাটে শুয়ে। এত দূর এসে বউটাকে না ছুঁয়ে যায় কেমন করে—‘আমি তোমাকে একটু একটু আদর করলুম আর বললুম ছোট বউ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম—বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেরেছিলে কি না।’
রাজ্যের মানুষকে ডজন ডজন চিঠি পাঠিয়েছে রবি কিন্তু উনিশ বছরের বউকে চিঠি লিখেছে মাত্র তিন ডজন। স্বীকার করুক কি না-ই করুক, পূর্ববঙ্গের যশোরের এই মেয়েটিকে সে কিছুটা উপেক্ষাই করেছে। উপেক্ষার বড় প্রমাণ যখন মৃণালিনীর চিতা বহ্নিমান, কোথায় একজন একনিষ্ঠ স্বামীর মতো স্ত্রীর চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, চারদিকে প্রবল বাদ্য বেজে চলবে, জীবনের অগ্নিশুদ্ধ আত্মা হাত ধরাধরি করে মিলিয়ে যাবে অসীম শূন্যে, কিন্তু তা না করে সে পালিয়ে গেল লোকচক্ষুর অন্তরালে।

২.
পতিই হোক কি পত্নী—যে আগে যাবে, যাওয়ার সময় সঙ্গীকে নিয়ে যাবে সঙ্গে। কিন্তু তখন তো বাংলা এমন নারীবান্ধব ছিল না। পতিরাই যাওয়ার সময় পত্নীকে সঙ্গী করত। দু-একজন দুর্বিনীত স্ত্রী চিতা থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়তে চেষ্টা করত, তাতে কাজ হতো না। চিতার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নিয়োজিত বাঁশের লাঠি বাহিনী রে রে করে তেড়ে আসত—পালাবি কোথায় হতভাগী? বাঁশ-পেটা করে তাকে ছুড়ে ফেলা হতো চিতার সবচেয়ে গনগনে অগ্নিকুণ্ডে। ঘাটের মড়াই হোক কি তারুণ্য টগবগে খোকাই হোক, ভস্মীভূত হতে হতে স্মিতহাস্যে বলে উঠত, পালাবি কোথায় হতভাগী? আমার সঙ্গে ওপারে চল।
বাকিংহ্যামশায়ারের ছেলে, প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম বেন্টিংক আর ডেভোনশায়ারের ডিউক উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিশের একমাত্র কন্যা ডরোথির পুত্র লর্ড উইলিয়াম হেনরি ক্যাভেন্ডিশ বেন্টিংক যখন ভারতবর্ষ শাসন করছেন, সতীদাহে খুব মনঃক্ষুণ্ন হলেন। তাঁকে আরও প্ররোচনা দিলেন রাজা রামমোহন রায়।
রামমোহনেরও একজন প্রিয় বউদি ছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর যখন সেই বউদিটিকে চিতায় ওঠানো হচ্ছে, রামমোহন বাধা দিয়েছিলেন, বউদিকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ও প্ররোচনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নাফরমানি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে দেননি সমাজপতি মুরব্বিরা। অনেক দিন পর ইংরেজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রামমোহন সেই শোধটাই নিলেন।
বেন্টিংকের সই ও সিলমোহর নিয়ে ৪ ডিসেম্বর ১৮২৯ সালে জারি হলো সে বছরের ১৭ নম্বর আইন: বেঙ্গল সতী রেগুলেশন। সতীর সহমরণ চর্চা নিষিদ্ধ তো করা হলোই, সেই সঙ্গে সহমরণে সহায়তাকারী কিংবা বাধ্যকারীদের জন্য বরাদ্দ হলো ফৌজদারি দণ্ড। যে নারী সানন্দে স্বামীর চিতায় আরোহণ করে সহাস্যে ভস্মীভূত হওয়ার চ্যালেঞ্জ নেয়, সেই না অরুন্ধতীর মতো স্বর্গগামী হয়। স্বামীকে অনুসরণ করে যে নারী পরপারের যাত্রী হয়, লাভ করে তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ বছর আনন্দময় সহবাসের গ্যারান্টি। পিতৃকুল, মাতৃকুল এবং কুমারী অবস্থায় যে কুলে আগমন করেছে, তিন কুলের সমুদয় পাপ স্খলন করে তাদেরও স্বর্গারোহণের নিশ্চয়তা দিতে পারে সেই নারী, এমনকি ব্রাহ্মণ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ থেকেও স্বামীকে মুক্ত করে নিয়ে স্বর্গে চলে আসতে পারে অগ্নিশুচিস্নাত মর্ত্যের এই দেবী।
রবি লিখে লিখে যথেষ্ট হাত পাকিয়েছে। কী কথা লিখেছে?
খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও,
এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।
ঠিকই লিখেছে। মৃণালিনী দুই বাহু বাড়ায়েই আসছে। দুই বাহুতে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। মরণলোকের দুয়ার খুলে ছুটে আসা এই নারীর বাহুলগ্ন হতে হবে এই আতঙ্কে রবি ছুটছে তো ছুটছেই।
অথচ এই রবিই লিখেছে:
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে আলোয় আকাশ ভরা।
তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে
ফুল্ল শ্যামল ধরা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.