চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন- নাছির সাপে-নেউলে সম্পর্ক হয়ে উঠছে
জুবায়ের সিদ্দিকী-
চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন-নাছির বিরোধ এখন তুঙ্গে। এই বিরোধ প্রকাশ্য হতে শরু করে যখন চট্টগ্রাম বন্দরের মাফিয়া আখ্যা দিয়ে টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন কর্মসুচী ঘোষনা করে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু কিছুদিন পর সেই সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ব্যবসা শরু করে আ.জ.ম নাছিরের প্রতিষ্টান।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির ইস্যুতে চট্টগ্রামে এম.এ লতিফকে অবাঞ্চিত ঘোষনা করতে মাহিউদ্দিন চৌধুরী লালদীঘিতে সমাবেশ ডাকলে সেই সমাবেশ প্রত্যাখ্যান করে এমপি লতিফকে সমর্থন জানান আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। এর পর বি.এম.এ নির্বাচনে একক প্যানেল ঘোষনা করেন আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। এর বিপরীতে আরেকটি প্যানেলকে সমর্থন দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। সম্প্রতি মেয়র নাছির সশরীরে গিয়ে উদ্বোধন করেছেন কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মিত মৎস্য অবতরন কেন্দ্র। এর পরদিন মহিউদ্দিন চৌধুরী সমাবেশ করে পুরনো ফিশারিঘাটে ব্যবসায়ীদের অবস্থান করার ঘোষনা দেন।
পরপর ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় দুই নেতা পরস্পর বিরোধী অবস্থানে অনড় রয়েছেন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের এ দুই শীর্ষ নেতা ভিন্ন দুই পথে হাঁটার কারনে বিপাকে পড়েছেন সাধারন নেতাকর্মীরা। অপরদিকে দুই নেতার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে একটি মহল। প্রবীন নেতাকর্মীদের মতে, এ দুই নেতা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতেন তবে আরও শক্তিশালী হতো চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ। সুফল পেত চট্টগ্রামের মানুষ।
মহিউদ্দিন চৌধুরী নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আর আ.জ.ম নাছির উদ্দিন সাধারন সম্পাদক। মহিউদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগের টিকিটে একাধারে ১৭ বছর মেয়র ছিলেন। বর্তমানে একই দলের টিকিটে আ.জ.ম নাছির মেয়র। মহিউদ্দিন ও নাছির সর্বশেষ বিরোধে জড়িয়েছেন কর্নফুলী নদীর তীরে থাকা সরকারী খাস খতিয়ানভুক্ত চার একর জায়গা নিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লিজ নিয়ে শতকোটি টাকায় সেখানে মৎস্য অবতরন কেন্দ্র নির্মান করা হয়েছে। মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনকে নিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল এম. খালেদ ইকবাল এ অবতরন কেন্দ্রের নির্মান কাজ উদ্বোধন করেন।
কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন,’ অবৈধ জায়গায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্মান করা হয়েছে এ মৎস্যকেন্দ্র। তাই এটি উচ্ছেদ করতে হবে। ফিশারিঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন মহিউদ্দি চৌধুরী। যে মৎস্য অবতরন কেন্দ্রের বিপক্ষে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবস্থান, সেটির উদ্বোধন করতে গিয়ে আ.জ.ম নাছির বলেন,’ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন করে এই মৎস্য অবতরন কেন্দ্র নির্মান করা হয়েছে। এটি কেউ উচ্ছেদ করতে পারবে না। আপনারা নির্ভয়ে এখানে ব্যবসা শুরু করুন।’’ শীর্ষ দুই নেতার মুখ থেকে দুই রকমের বক্তব্য শুনে দ্বিধাবিভক্ত ফিশারিঘাটের শতাধিক ব্যবসায়ীও।
এক পক্ষ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সমর্থন দিয়ে ওই স্থানে মাছের আড়ত গড়ে তোলার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আরেক পক্ষ নাছিরের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ওই স্থানে মাছের আড়ত দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। দুই নেতার এমন অবস্থানে বেকায়দায় আছে জেলা প্রশাসনও। তাই উচ্ছেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে তারা দ্বারস্থ হয়েছে মন্ত্রনালয়ের। এর আগে জায়গার মালিকানা দাবী করে বন্দরকেও এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। দুই নেতার এভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কারনে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। ব্যাহত হচ্ছে চট্টগ্রামের উন্নয়নও। অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের মতে, শীর্ষ নেতারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে চট্টগ্রামের ব্যাপারে কেন্দ্রে জোরালো দাবী উপস্থাপন করা যায়। নেতাকর্মীরাও ঐক্যবদ্ধ থেকে দলকে শক্তিশালী করে।
কিন্তু শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলে সেটির ফায়দা নিতে চায় সুবিধাভোগীরা। বিষয়টি স্বীকার করে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন,’ আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে নেতা বেশি। তাই মতও বেশি। তবে শীর্ষ নেতারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে দল শক্তিশালী হতো। দ্বিধাবিভক্ত হতো না নেতাকর্মীরাও। শীর্ষ দুই নেতা দুই পথে হাঁটায় গুরুত্বপুর্ন অনেক সিদ্ধান্ত ঐক্যমত্য হয়ে নিতে পারছি না আমরা।
নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারন সম্পাদক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের মধ্যে বিরোধ কমছে না। সংগঠনে এই অন্ত: কোন্দলকে গুরুত্বের সঙ্গে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নির্দেশনার পরও বিরোধ দুর হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না একে অপরের কাদা ছোড়াছুড়ি। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই বৈঠকে তিনি নগর আওয়ামী লীগের এই দুই শীর্ষ নেতাকে কাদা ছোড়াছুড়ি না করার পরামর্শ দেন। গত নিত মাসেও তাঁর সেই পরামর্শ আমলে নেয়নি কোন নেতাই। বরং দুজনের বিরোধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
দলীয় সুত্রে জানা যায়, গত প্রায় দুই বছরে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধে জড়ান মহিউদ্দিন ও নাছির। আ.জ.ম নাছির মেয়র হওয়ার পর সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবন থেকে করপোরেশনের কয়েকজন কর্মচারী ফিরিয়ে আনেন। সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত বেসরকারী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব গত বছরের ২২ ডিসেম্বর অনুষ্টিত বিএমএ নির্বাচন এবং বন্দর ইস্যুতেও তারা বিরোধে জড়ান। নগর আওয়ামী লীগের এই দুই গুরুত্বপুর্ন নেতা সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) হোল্ডিং ট্যাক্স ইস্যুতে নতুন করে বিরোধে জড়িয়েছেন।
এ অবস্থায় গত সপ্তাহে চসিকের বর্ধিত হারে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় কার্যক্রমের উপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দলীয় সুত্র মতে, দুই নেতার বিরোধের কারনে প্রায় এক বছর ধরে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনিবাহী কমিটির সভা হচ্ছে না। সভায় মেয়র নাছিরের অনুসারী কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব উঠতে পারে-এমন ভাবনা থেকেই সভা ডাকা হচ্ছে না। বিরোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন.’ এটা দুরত্ব নয়। সে (মেয়র) সিটি কর্পোরেশনসহ যে কাজগুলো করছে তার সঙ্গে জনগনের সম্পৃক্ততা নেই। জনসমর্থন না থাকায় খোদ প্রধানমন্ত্রীও তার কর্মকান্ড প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি বলেছি, সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের আগে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে জনগনকে সরকার থেকে দুরে রাখাটা ঠিক হবে না। ট্যাক্স বাড়লে নির্বাচনে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু সে যা করছে তা প্রতিটি মানুষ ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করবে।’
কাদা ছোড়াছুড়ির বিষয়ে সাবেক এ মেয়র বলেন,’ সে ( মেয়র) গায়ে পড়ে ঝগড়া করছে। মন্ত্রীদের উন্নয়নমুলক কর্মকান্ড নিয়েও সে বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকার কথা সাধারন সম্পাদকের। কিন্তু ডাকছে না। অপরদিকে আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলেন,’সাংগঠনিক কোন বিরোধ বা দুরত্ব নেই। সুষ্ট ও সুন্দরভাবে শৃঙ্খলার সঙ্গে প্রশাসন চালাতে গিয়ে আমাকে একটি অবস্থান নিতে হয়। সেটি হলো জনস্বার্থ দেখা এবং বিধিমালা মানা। তবে কেউ (মহিউদ্দিন চৌধুরী) মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমুলক তথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যমুলক বক্তব্য বিবৃতি দিলে তা কাম্য নয়।
বৈঠক না ডাকা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন,’আসলে আমরা সাংগঠনিক কাজ করছি। তবে কার্যনির্বাহী কমিটি ও বর্ধিত সভা শিগগিরই ডাকা হবে। হোল্ডিং ট্যাক্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন.’স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের বিধি অনুসারে আমরা হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে কাজ করছি। অ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে। তারপর কারো কোন অভিযোগ থাকলে তা শুনানী ও যাচাই বাছাই কহবে। সব কিছু চুড়ান্ত হওয়ার পর ট্যাক্স আদায় শুরু হবে।
এটি কর্পোরেশনের একার নয়, সরকারী সিদ্ধান্ত। আর স্থগিতাদেশের বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। দুই নেতার বিরোধ প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন,’ এটা দু:খজনক। এতে আমরা বিব্রত। এটা উচিত হচ্ছে না। সে জন্য প্রয়োজন দলের কার্যনিবাহী সভা ডেকে যার যার বক্তব্য উপস্থাপন ও সমস্যার সমাধান করা। নিয়মিত সাংগঠনিক সভা হলে অনেক কিছু সমাধান হয়ে যেত।
আমাদের মধ্যে জঙ্গি ঢুকে গেছে। কিছু কিছু নেতা জঙ্গিদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে। সম্প্রতি ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে নাশকতাসহ ১৪ মামলার এক আসামীকে পুলিশ ধরতে গেলে এক নেতার কারনে তাকে ধরতে পারেনি।’ দলীয় নেতারা জানান,’ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে দল গুছানো ও আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া থেকে অনেক দুরে আওয়ামী লীগ। দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার মধ্যে দলাদলী আছে। তা মেটানো দুরে থাক এ সময়ে খোদ সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক পরস্পরবিরোধী জড়ানোটা অত্যন্ত দু:খজনক।