স্বজন হারানোর স্মৃতি উপকূলবাসীকে এখনো তাড়ায়

0

জাহেদুল হক,আনোয়ারা::আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে স্মরণকালের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাস আনোয়ারা উপকূল তছনছ করে এক মহাধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। রাতের অন্ধকারে মুহুর্তের মধ্যে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই রুদ্ধরোষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি উপকূলের মানুষ আর কখনো হয়নি। তাই ২৯ এপ্রিল আসলে স্বজন হারা মানুষের কান্নায় এখনো ভারি হয় উপকূলের আকাশ বাতাস। সেই জ্বলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়া উপকূলবাসীকে স্বজন হারানোর বেদনা আজও অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তুলে।
ক্ষতিগ্রস্তদের মতে,১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আবহাওয়া বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় ৯নং সতর্কতা সংকেত জারি করলেও অজ্ঞতার বশে সেদিন লোকজন অন্যত্র সরে না যাওয়ায় মহাদুর্যোগের শিকার হয়। রাত ১০টার পর ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সাগরের পানি মুহুর্তেই ধেয়ে এসে লোকালয়ে প্রবেশ করে। জ্বলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবলীলায় ওই রাতে অনেক মা হারায় সন্তানকে,স্বামী হারায় স্ত্রীকে,ভাই হারায় বোনকে। অনেক পরিবার আছে যাদের গোটা পরিবারই পানির ¯্রােতে হারিয়ে গেছে। ২৯ এপ্রিলের সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনো কেঁদে বেড়ায় স্বজন হারানো উপকূলবাসী।
ভয়াল এই ঘূর্ণিঝড়ে সারাদেশের মতো আনোয়ারা উপকূলের অন্তত ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। একই সাথে মাছ ধরার ট্রলার,নৌকা,বৈদ্যুতিক খুঁটি,গাছ-পালা,চিংড়ি ঘের,স্কুল-মাদ্রাসা,ঘরবাড়ি,অসংখ্য গবাদি পশু, ব্রীজ কালভার্ট ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতি সাধিত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার। তাই ২৬ বছর পরও অতীতের স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলতে পারেনি উপকূলবাসী।
প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এলেই ঘরে ঘরে মিলাদ মাহফিল,কোরআন খানি,দোয়া কামনা,দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ,স্মরণ সভা,র্যালিসহ বিভিন্ন আয়োজনে দিনটি পালন করা হয়। কিন্তু এখনো অরক্ষিত উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা এবং এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। ভয়াল ২৯ এপ্রিলের পর থেকে এখন ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সংকেত পেলেই দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকে উপকূলবাসী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে,১৫৬১ সালের জ্বলোচ্ছ্বাসও উপকূলের বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ১৭৬২ সালে,১৭৯৫ সালের ৩ জুন,১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর,১৯০৫ সালের ২৯ এপ্রিল,১৯৬৩ সালের ২৭ মে,১৯৭২ সালের অক্টোবরে,১৯৯৭ সালের নভেম্বরে,১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাসেও উপকূলীয় এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ জ্বলোচ্ছ্বাসে আনোয়ারা উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে যায়।
সে ভয়াল রাতের কথা স্মরণ করে গহিরা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ছালেহ আহমদ জানান,১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ২৬ বছর পরও আমাদের আতঙ্ক কাটেনি। প্রতিবছর বর্ষা এলেই প্রাণ হাতে নিয়ে দিন কাটাই আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে,৯১ পরবর্তী সুদীর্ঘ ২৬টি বছর পার হলেও উপকূলীয় এলাকাবাসীর কল্যাণে কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না।
১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর আনোয়ারায় যেসব সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছিল তা এখন ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। অবিলম্বে নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও উপকূল অঞ্চলের মানুষকে রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সাইক্লোন শেল্টার নয়,উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন রায়পুর ও জুঁইদন্ডীর প্রায় ১০ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এতে করে প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সরেঙ্গা,ঘাটকুল,বার আউলিয়া,ছিপাতলী ঘাট,পুর্ব গহিরা,মালিপাড়া,খোন্দ্ গহিরা,পরুয়াপাড়া এবং জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের লামার বাজার,সাপমারা খালের মুখ,চর জুঁইদন্ডী ও খুরুসকুল গোদার পাড় এলাকায় এ দশার সৃষ্টি হলেও এখনো পরিপƒর্ণ মেরামত হয়নি। এ নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভের শেষ নেই। তাদের অভিযোগ উপকূলের নিরাপত্তার নামে শুধুই হরিলুট হয়েছে।
যার ফলে উপকূলের লাখো মানুষ এখনো ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন। কোন সংকেত দেখা দিলে বা আবহাওয়া বার্তা শুনলে তারা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন,খোদা আবার যেন ভয়াল ২৯ এপ্রিল তাদের মাঝে উপস্থিত না করায়। তাদের আর যেন স্বজনদের লাশ খোঁজতে না হয়। উপকূলবাসী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন,পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার করে যেন উপকূলের মানুষকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে,একদিকে বঙ্গোপসাগর অন্যদিকে শঙ্খনদের ভাঙ্গনে পড়ে গ্রামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রায়পুর ইউনিয়নের ঘাটকুল,মালিপাড়া ও বার আউলিয়া ভাঙ্গছে বঙ্গোপসাগরের কারণে আর পূর্ব গহিরা ও দক্ষিণ সরেঙ্গা পড়েছে শঙ্খের গ্রাসে। একই অবস্থা জুঁইদন্ডী লামার বাজার ও খুরুসকুল গোদার পাড় এলাকায়ও। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে,বর্ষাকালে যখন বাঁধ ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করে তখন ছোটখাটো মেরামত কাজ করলেও তা বেশিদিন ঠিকে না। তাই বর্ষার আগেই এই শুষ্ক মৌসুমে মেরামত কাজ টেকসই ও কার্যকরী হবে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোকায়সার উদ্দিন জানান,পুরো উপজেলার ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় মেরামত কাজের জন্য আড়াইশ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব কাজের মাধ্যমে রায়পুর ও জুঁইদন্ডীসহ উপকূলীয় এলাকার সমস্যা কেটে যাবে। রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো জানে আলম বলেন,প্রতিবছর বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য পাউবো কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও তার সিকিভাগও কাজের কাজ হয় না। যার ফলে উপকূলের মানুষেরা দুঃসহ কষ্টে দিনাতিপাত করে যাচ্ছে।
এদিকে দিবসটি যথাযথ ভাবে পালনের লক্ষে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আনোয়ারা উপকূলীয় উন্নয়ন ফাউন্ডেশন,রায়পুর ইউনিয়ন জনকল্যান সংস্থা,আনোয়ারা তরুন ক্রীড়া পরিষদ,ময়না গাজীর বাড়ি উন্নয়ন পরিষদসহ নানা সংগঠন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.