মে দিবস : বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের দিন
আবছার উদ্দিন অলি ::
পহেলা মে, মহান মে দিবস। প্রতি বছর বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এখনও বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত পোষাক কারখানায় নিয়োজিত ব্যাপক শ্রমিক প্রাণহানীর ঘটনায় আমাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এভাবে লাশের মিছিল আর কত লম্বা হবে। অপরাধীরা আর কত ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবে। এদের বিচার কি হবেনা? এরা কি এতই ক্ষমতা ধর শক্তিশালী? বার বার দূর্ঘটনা ঘটছে, শ্রমিকের প্রাণ যাচ্ছে। শোক প্রকাশ, শোক সভা, আর তদন্ত কমিটি বক্তব্য, বিবৃতি আর সেই সাথে রাজনীতি সমান তালেই চলছে। অপরাধী আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
তাই এবারের মে দিবসের অঙ্গীকার হোক সুস্থ ভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা চাই। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও ৮ঘন্টা শ্রম সময় নির্ধারণ সহ অন্যান্য দাবিতে এক সাধারন ধর্মঘট ডাকা হয়। হে মার্কেটে গণজমায়েতেরও আয়োজন করে। এ সময় শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। পরবর্তীতে শ্রমিকদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পহেলা মে কে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর পহেলা মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার ও ঐক্য সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে লাল হরফে লেখা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে এ দিনটি।
বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অবিস্মরণীয় দিন। বিশ্বের সকল মেহনতি মানুষের মুক্তি ও অধিকার অর্জনের অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ পহেলা মে। শ্রমিক শোষণ ও নির্যাতন প্রতিরোধে আত্মত্যাগের এক মহান আদর্শে উজ্জীবিত এ দিন। দুঃখজনকভাবে একশ বছর আগেকার সেই সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। বরং সেই একই কায়দায় এবং কৌশলে শ্রমিকরা নিগৃহীত শোষিত বঞ্চিত বিশেষ বছর তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোর শ্রমিকদের অবস্থা সত্যিই নিদারুণ কষ্টের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরও শ্রমিকরা এখনো অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে রাত্রি যাপন করে।
অনেক দেশে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়া হয় না। আমাদের দেশেও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন তাদের মজুরি সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশেও প্রতি বছর মহান মে দিবস, পালিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই উপলক্ষে থাকে সভা সমাবেশ। এই উপলক্ষে আয়োজিত সভা-সমাবেশে সারগর্ভ বহু বাণী প্রদান করেন জাতীয় পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। কিন্তু পরদিন থেকেই আবার গতানুগতিক জীবন স্রোতে ভেসে চলে চলে সবাই।
তাই আজও দেশের সরকারী অফিস আদালত প্রতিষ্ঠান আর কলকারখানার উৎপাদনমুখি কর্মকান্ডের চেয়ে দিনগত ঝরে যাচ্ছে বহু অমূল্য প্রাণ, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কলকারখানা। অন্যদিকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান এর প্রকৃত উদাহরণ। অন্যদিকে শিশু শ্রমের প্রথা ও প্রচলিত। বিভিন্নক্ষেত্রে নিয়োজিত এ সমস্ত শ্রমিকেরা নানাভাবে শোষিত হচ্ছে।
তাদের জীবন হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন। তারা অপুষ্টির শিকার, অমানবিক ব্যবহারের শিকার অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যেরও শিকার। আমাদের শ্রমিক সমাজ এখনো কতটা যে নিগৃহীত তা বিভিন্ন শিল্প কারাখানার দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। গার্মেন্টস শিল্পে এ মাত্রাটা বেশি। কিন্তু এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অরুচিসম্পন্ন জায়গায় শ্রমিকরা এখানে গতর খাটুনি খাটে। কিন্তু মজুরির বেলায় কর্পদহীন।
দেশে এখানো গার্মেন্টস রয়েছে যেখানে শ্রমিকদের তিন মাসের পারিশ্রমিক বাবদ এক মাসের বেতন ধরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া গার্মেন্টস পেশায় নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখানে শ্রম দিতে এসে নারীরা ধর্ষিত হওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে এবং আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে প্রাণহানী ঘটে চলেছে। এ অবস্থা গার্মেন্টস শিল্প হতে শুরু করে অনেক জায়গা পর্যন্ত বি¯তৃত। এই যদি হয় শ্রমিকদের অবস্থা তাহলে মে দিবস পালনের স্বার্থকতা কোথায়। যদিও সরকারিভাবে বারবার বলা হচ্ছে আইনানুগতভাবে কারখানা পরিচালনা করার কথা, তবুও আজ পর্যন্ত এই অসংগতিপূর্ণ ব্যবস্থা দূর হয়নি।
আমাদের অধিকাংশ কলকারখানয় মে দিবসের জাতীয়ভাবে স্মরণ করার পেছনে শ্রমিকদের সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও কাজ করেছে। এই সঙ্গে মালিকদেরও যাতে শ্রমিকের ন্যায্য দাবির প্রতি সচেতনতা থাকার তাগাদা তাও মে দিবস থেকে উৎসারিত। তাছাড়া দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেখানে হরতাল নির্ভর সংস্কৃতির চর্চা সেখানে মেহনতি মানুষ বিশেষ করে যাদের দিনে এনে দিনে খাওয়ার অবস্থা তাদের জীবিকা নির্বাহ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
শ্রমজীবি মানুষ এখনো পূঁজির শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। প্রতি বছর তারা মে দিবসে নতুন করে শপথ নেয় তাদের নিজ নিজ দেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়ার মওদুর এক হও এক হও এটা নিছক একটা শ্লোগান হয়। এটা শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবি মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ব্যঞ্জনাময় ধ্বনি। আমরাও চাই দুনিয়ার মজুদুর ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ব শান্তি সমৃদ্ধির পথে হোক সহায়ক শক্তি। সাম্যের পতাকাতলে সামিল হোক সবাই ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের জয়গান গেয়ে। বঞ্চনার মাঝে সব পাওয়ার পরিপূরক দুর হোক শ্রমিক মালিক বিশাল ব্যবধান আর বৈষম্য।
লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার
০১৭১১-১৬৯১৪৯
absaroli1976@gmail.com