শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত ওস্তাদ মিহির নন্দী

0

নিজস্ব প্রতিবেদক::সবস্তরের মানুষের শোক, শ্রদ্ধা আর অভূতপূর্ব ফুলে ফুলে সিক্ত ভালবাসায় চির বিদায় নিলেন শুদ্ধ সঙ্গীতের সাধক, একাত্তরের কন্ঠযোদ্ধা ওস্তাদ মিহির নন্দী। অন্তিম শবযাত্রায় তাঁকে জানানো হলো রাস্ট্রীয় সম্মান। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের চৌকস দল জাতীয় পতাকা মুড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রীয় শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত সঙ্গীতের সাধত মিহির নন্দীকে গার্ড অফ অনার প্রদান করে।

রোববার সকালে প্রচন্ড রোদ আর গরম উপেক্ষা করে তাকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছিল ভক্ত, অনুরক্ত, শিষ্য আর নানা শ্রেণী পেশার মানুষের ভিড়। সেখানে গানে গানে গুরুর প্রতি ভক্তি জানান তার সঙ্গীতশিষ্যরা। আগুনোর পরশমনি গান দিয়ে ভক্তরা শহীদ মিনারের পাদদেশে মিহির নন্দীর মরদেহে রাখা হয়। প্রায় দেড়ঘন্টার আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুরে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় বলুয়ারদীঘি শ্মশানে। এরআগে, সকালে নগরীর নন্দনকানন দুই নম্বর গলির বাসভবনেও ছিল বিভিন্নন্তরের মানুষের ভিড়। সেখানেও তারা শ্রদ্ধা জানান বরেণ্য এই মানুষটির প্রতি

এরপর তার মরদেহ নেয়া হয় শহীদ মিনারে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শিল্পীর কফিন ঢেকে জাতীয় পতাকায় ফেকে দেন মুক্তিযোদ্ধা ও তার সহযোদ্ধারা। এরপর তাকে একজন ম্যজিট্রেট এর নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল থাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন,বিউগলের সুরে জানানো হয় রাস্ট্রীয সম্মান। তারপরই ফুলে ফুলে ঢেকে যায় তার কফিন। সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিন,জেলা প্রশাসক,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি. চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, চট্টগ্রাম টেলিভিশন,চট্টগ্রাম বেতার,উদীচী, রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ চট্টগ্রাম,গ্র“প থিয়টার ফেডারেশন,তির্যক নাট্যদল, আনন্দধ্বনী,পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ, মঞ্চ শিল্পী সংস্থা, চট্টগ্রাম যন্ত্র শিল্পী সংস্থা,আলোকচিত্র বিষয়ক সংগঠন পোর্ট্রেট,চবি নাট্যকলা বিভাগ সহ শতাধিক সংগঠন।

সুরের সাধক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠসৈনিক ওস্তাদ মিহির নন্দী গত শনিবার রাতে টানা ২৩ দিন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী, এক কন্যা সহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে যান। ওনার একমাত্র কন্যার জামাতা অশোক চৌধুরী বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব নিউজ হিসেবে কর্মরত আছেন।

ওস্তাদ মিহির নন্দী বেশ কিছুদিন ধরেই দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। দেশের শুদ্ধসুরের প্রতিথযশা এই সঙ্গীতজ্ঞ কলকাতায় দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় প্রিয় নগরী ও বাসস্থান চট্টগ্রামে। সেখানেই বেসরকারী একটি হাসপাতালে গত দুই সপ্তাহের বেশী সময় ধরে লাইফ সাপোর্টে রেখেছেন ওস্তাদ মিহির নন্দীকে। ওনার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে বেসরকারী মেডিকেল হতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

প্রাণের মানুষ, শিল্পী ও সুর স্রষ্টা ওস্তাদ মিহির নন্দী উপমহাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী, বোদ্ধা ও প্রশিক্ষক। তবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও রয়েছে তাঁর অনায়াস দখল। সঙ্গীতে হাতেখড়ি বাবা ফনীন্দ্র নন্দীর কাছেই। এরপর দীক্ষা নেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষাগুরু ওয়াহিদুল হক ও আচার্য্য শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের কাছে। বেহালা শিখেছেন ওস্তাদ নিরোদ বরণ বড়–য়া ও পন্ডিত অশোক দাশগুপ্তের কাছ্।ে তাঁর উচ্চাঙ্গ কন্ঠ সঙ্গীতের শিক্ষাগুরু সঙ্গীতাচার্য্য সৌমিত্রলাল দাশগুপ্ত। তবলা, সেতার ও এসরাজে হাত পাকিয়েছেন ওস্তাদ আদিত্য নারায়ন দাসের কাছ থেকে।

শুদ্ধসুরের এই সাধক ছিরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কন্ঠ সৈনিক। একাত্তরে দেশমাতৃকার প্রয়োজনে ওস্তাদ মিহির নন্দী উদ্দীপনামূলক সুরে বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ ও মুক্তি সংগ্রামীদের করেছেন উজ্জীবিত। সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য গত বছর তাঁকে ভূষিত করা হয় রাষ্ট্রীয় শিল্পকলা পদক।
১৯৪৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেউচিয়া গ্রামে জন্ম নেয়া ওস্তাদ মিহির নন্দী তাঁর বর্ণাঢ্য সঙ্গীত সাধনায় চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন নানাভাবে। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন তিনি। উচ্চাঙ্গ ও রবীন্দ্র সঙ্গীতে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৬৬ সালে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক ও বাংলাদেশ বেতার এবং বাংরাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার ও বিচারকমন্ডলীর অন্যতম সদস্য। সুরের সাধনায় শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি এই সঙ্গীত সাধক। গড়ে তুলেছেন শিল্পী ও প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম আর্য্য সঙ্গীত সমিতি, আনন্দধ্বনি ও রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। পেশাগত জীবনে ছিরেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ কর্পোরেশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.