মহিউদ্দিন শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রতীক

0

জুবায়ের সিদ্দিকী: এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম। আজ এক অবিচ্ছেদ্য শিরোনাম। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া তথা সারা বাংলাদেশের জনগন এক নামে চেনে তার নাম ’চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরী’।

চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তিনি ’কালা মানিক’ কখনো বাংলাদেশের লেনসেন ম্যান্ডেলা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এই পরিচিতি তিনি অর্জন করেছেন। কারো অনুগ্রহে বা চাটুকারিতা দিয়ে নয়, তার আদর্শ, সেবা, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং প্রতিবাদী কর্মময় জীবনের বিনিময়ে। আজ মহিউদ্দিন চৌধুরী লক্ষ মানুষের কাছে প্রশংসনীয়, কারো কাছে ঈর্ষনীও।

মহিউদ্দিন চৌধুরী মানেই একজন কর্মমুখর মানুষের প্রতিকৃতি। সাম্প্রতিক সময়ে তার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে। সেখানে দেখা গেল মানুষের প্রচন্ড ভীড়। এর পরদিন তাকে হেলিকপ্টারে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে ষ্ট্রেচারে করে তোলা হচ্ছিল তখন সেখানে উপস্থিত সাধারন মানুষ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার আশু রোগমুক্তি কামনায় নগরীর অগনিত মসজিদে দোয়া হয়েছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। চট্টগ্রামের প্রতি অবহেলাকে প্রতিহত করেছেন তিনি বিভিন্ন সময়ে মেয়র হওয়ার আগে ও পরে।

তার কর্মের মুলধারা রাজনীতি, কিন্তু সেই পরিসরে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজের কর্মকান্ডকে আপোষহীন ভাবে এগিয়ে নিয়েছেন শ্রমিকের স্বার্থ আদায়ে, পেশাজীবিদের কর্মপ্রবাহে, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, ধর্মীয় অনুষ্টানে, সামাজিকতায়, অধিকার সংরক্ষনে, প্রগতিশীলতায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এভাবে ১৭ বছর মেয়র থাকাকালীন মেয়াদে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

এ.বি.এম মহিউদ্দিন তাঁর অদম্য কর্মশক্তিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। এই কর্মশক্তিকে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে। নিজে কর্মী হয়ে কাজ করেছে রাজপথে, সভা, সেমিনারে। এখানেই তার বিশেষত্ব ও স্বতন্ত্র্য কর্মকৌশলতা। এসব কাজই তাকে দিয়েছে সর্বজনপ্রিয়তা। মেয়র নন, আওয়ামী লীগের এক নেতা। অন্যায়, অবিচার ও জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর মহিউদ্দিন চৌধুরী।

সাধারন মানুষের কাছে এখনও বয়োবৃদ্ধ -রোগাক্রান্ত হলেও রিক্সাচালকও রাস্তায় রিক্সা চালাতে চালাতে আপন মনে গেয়ে উঠে ’সুখের দিন-দু:খের দিন পাশে থাকে মহিউদ্দিন’। সমাজের তৃনমুল মানুষকে সাথে নিয়েই তার কর্মের পরিধি আগেও ছিল এখনও আছে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ৬৯ এর গন অন্দোলনে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে আমি তার ছায়াসঙ্গী হয়ে দেখেছি, সাহসী এই নেতা কর্মীবান্ধব ও কষ্টসহিষ্ণু একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাকে একদিন বলেন, ব্যক্তি নয়। সংগঠনই হলো রাজনীতির আত্বা। তার মধ্যে দেখেছি, মেধা ও মনন। মরনজয়ী সাহস তার রাজনৈতিক পুঁজি। তিনি কি কোন স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে মাথানত করতে পারেন? না পারেন না। তিনি একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা।

গণতন্ত্র ও চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ছিলেন অগ্রনী ভুমিকার রুপকার। যারা অভিজাত পোশাকে বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ড্রইংরুমে বসে রাজনীতি করে, মহিউদ্দিন চৌধুরী তাদের থেকে সম্পুর্ন ব্যতিক্রম। জনগন, রাজপথ ও রাজনীতি নিয়েই মহিউদ্দিনের ক্রমবিকাশ। এই পথ থেকে তিনি এখনো পর্যন্ত এক ইঞ্চিও পিছপা হননি।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর আদর্শ, সাহস, সমাজ সেবা এবং কর্মের স্বীকৃতি চট্টগ্রামবাসী দিয়েছেন তাকে পর পর ৩ বার মেয়র নির্বাচিত করে। এ জন্য চট্টগ্রামবাসীর কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। কর্মী মহিউদ্দিন চৌধুরী কেবল কৃতজ্ঞতায় বিশ্বাসী নন, কৃতজ্ঞতার দায়বদ্ধতায় এবং দায়িত্বে জীবনের প্রতিটি সময় এমনকি এখনও বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও মানুষের সুখে দু:খে পাশে আছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ধ্যানে-মনে কর্মের নেশা। কর্মী থেকে তিনি নেতা হয়েছেন, আবার নেতা থেকে কর্মী। এতে তার মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়নি। বরং বেড়েছে বহুগুন।

মেয়র নন, তারপরেও চট্টগ্রামের মানুষ মনে করে মহিউদ্দিন চৌধুরীই চট্টগ্রামের অভিভাবক। মহিউদ্দিন চৌধুরী সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন। এখন তার শারিরীক অবস্থা অনেক ভাল। কিছুদিন পর ফিরে আসবেন তার প্রিয় চট্টগ্রামে।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মাত্র কয়েকদিন অসুস্থ থাকা অবস্থায় চট্টগ্রামবাসীর যেভাবে উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখেছি তা ভাষায় বর্ননা করা যাবে না। মসজিদ, মন্দিরে, গির্জায় যে ভাবে তার আশু রোগমুক্তি কামনায় প্রার্থনা হয়েছে তা অতীতে দেখা যায় নি। শুধু মানুষের দোয়া ও আশির্বাদে মহিউদ্দিন চৌধুরী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। নগরীর চশমা হিলের তার বাসা থেকে কখনো কেউ ভাত না খেয়ে আসতে পারেননি। মানুষকে আথিতিয়তা করতে পারলে তিনি খুব খুশী হন। ব্যক্তি মহিউদ্দিনের কোন বিকল্প চট্টগ্রামে এখনো আসেনি। মাস কয়েক আগে সহকর্মী গোলাম শরীফ টিটু কে নিয়ে বাসায় গিয়ে দেখি অনেক লোকজন। একসময় কাছে ডেকে নিয়ে বসালেন। বললেন, গেদুচাচা কেমন আছেন। লেখালেখি চালিয়ে যা। শরীরের দিকে খেয়াল রাখিস। মানুষের প্রতি তার এই মমত্ব কেউ কাছে না গেলে অনুধাবন করতে পারবেন না। দলমত নির্বিশেষে মানুষ চায় মহিউদ্দিন চৌধুরী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসবেন মানুষের মিছিলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও মানুষ লিখছেন’ ফিরে আসুন মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের রাজনীতির একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই নক্ষত্র চট্টগ্রামবাসীর সুখে দু:খে আগামীতেও পাশে থাকবেন এই প্রত্যাশা সাধারন মানুষের।

অসুস্থ হয়ে থাকলেও দেখেছি মানুষের সাথে তিনি কথা বলতেন খোলামেলা ভাবে। তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বান্দরবান কারাগার থেকে যখন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় তখন হাসপাতাল থেকে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় আমাকে ডেকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,’তোর মন খারাপ কেন। আমি নির্দোষ। আবার ফিরে আসব। দোয়া করিস আমার জন্য। এত সাহসী, কষ্ট সহিষ্ণু, উদ্যমী, আন্তরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুব অল্প দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সাংবাদিকদের জন্য তার আন্তরিকতা ও মমতা ছিল প্রশংসনীয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দেখা করতে বললেন। তিনি বলেন ’অডা ভালা গরি লেখিস। কাক্কু অ’লর কথা মনে রাখিস। খানাদানা কম খাইস। আল্লাহরে ডাকিছ’। মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামবাসীর অধিকার আদায়ে আবারও পাশে সুখে দু:খে এই প্রত্যাশায় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। এই মানুষকে সম্পুর্নভাবে সুস্থ করে আল্লাহ আমাদের সুখে দু:খের সাথী করে শকুনের থাবা, বুর্জোয়া কুচক্রি মহলের কুদৃষ্টি থেকে জনগন যেন নিরপাদ রাখতে পারেন। যেন মহিউদ্দিন চৌধুরী আবারও গর্জন করে বলতে পারেন ’ কাক্ক অল তোয়ারা কেন আছ? চট্টলবীর মহিউদ্দিন গনমানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও ভরসার প্রতীক।
একজন নেতার প্রতি সাধারন মানুষের এমন ভালবাসা এই অঞ্চলে নজীরবীহিন। মানুষের মনিকোঠায় মহিউদ্দিন চৌধুরী যেভাবে গেঁথে গেছেন, তা আর কখনও ধুলায় মিশে যায়নি। একজন নেতার জন্য সাধারন মানুষের কান্না দেখেছি এই নগরীতে। নেতার জন্য প্রার্থনায় মগ্ন সব ধর্মের মানুষ। এ এক বিরল দশ্যপট। মহিউদ্দিন চৌধুরী মানুষের মনে এতটাই ঠাঁই করে নিয়েছেন। যে মানুষ রাজনীতির পরীসীমা ছাড়িয়ে মানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত

গড়তে পারেন। সবরকম মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেন মহান।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন প্রায় বলে থাকেন, একজন রাজনীতিকের সঙ্গে ঘর করা খুব কঠিন। তাকে কাছেও টানা যায় না, দুরেও ঠেলা যায় না। জীবনে অনেক কষ্ট সয়েছি। তবু হাল ছাড়িনি। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আমি আপনাদের কাছে উৎসর্গ করেছি। সত্যি তাই। আজীবন করে যাচ্ছেন মানুষের রাজনীতি। মানুষের হৃদয়ে মিশেথাকা মানুষটি বেশ কয়েকদিন ধরে পড়ে আছেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। তিনি যেন সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন চাঁটগার মানুষের এগিয়ে চলার শক্তিও। এই সাময়িক শুন্যতা মানুষকে এতটাই আপ্লুত করেছে, নেতাকর্মীরা যেন মাথার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। তারা যেন সামনে এগুতে পারছেন না।

সবকিছু স্থবির হয়ে আসছে। সাধারন মানুষ তাদের সুযোগ্য অভিভাবককে খুঁজছেন। এই মানুষেরাই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বানিয়েছেন চট্টলবীর। তাদের কাছে চট্টগ্রাম যদি মুদ্রার এপিট হয়, তবে অন্যপিটে মহিউদ্দিন চৌধুরী। সুস্থ হয়ে ফিরে আস হে মহান নেতা। তোমার গর্জনে যেন কেঁপে উঠে সুবিধাভোগী ও লুঠেরাদের মসনদ। চট্টলবাসীর সুখে দু:খে গনমানুষের পাশে তোমার উপস্থিতি যেন আবার সরব হয়ে উঠে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.