এক অলি আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদী (রহ.)

0

জুবায়ের সিদ্দিকী, চট্টগ্রামা :: সততা, পরিশ্রম, পরোপকার, মানবসেবা, পরমত সহিষ্ণুতা, অধ্যাবসায়, দ্বীন মাজহাব তথা সুন্নিয়তের নিরলস খেদমত করে জীবনে হয়েছেন আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদী (রহ.)। তাঁর জানাযার মাঠে হাজার হাজার মুসল্লিদের সমাগম এ কথার বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয়। বরেন্য এ আলেমে দ্বীন মদিনাতুল আউলিয়া খ্যাত চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াজেদিয়া এলাকায় ১৯৪০ সালে ধরনীকে আলোকিত করে জন্মগ্রহন করেন। সদা হাস্যোজ্জল, বিনয়ী, উদার, সহনশীল ও মানবিক গুণাবলিতে পরিপুর্ন হুজুর ছিলেন একাধারে আলেমে দ্বীন, আমিরুল হজ্জাজ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক। যার পুরা জীবন হাজীদের খেদমত এবং দুস্থ অসহায় মানুষের কল্যানে নিবেদিত ছিল।

তিনি সর্বপ্রথম হজ্ব পালন করেন ১৯৭৪ সালে। অতপর তাঁর সততা, ন্যায়পরায়নতা, বিশ্বস্থতা, এলমে দ্বীন তথা ধর্মীয় জ্ঞান বিতরনে প্রজ্ঞা দেখে বাংলাদেশ সরকার প্রীত হয়ে তাঁকে ১৯৭৮-৭৯ সালে শহীদ সালাউদ্দিন নামক জাহাজে করে যাওয়া হজ্বযাত্রীদের চীফ কো-অর্ডিনেটর বা প্রধান সমন্বয়কারী কথা আমিরুল হজ্জাজের দায়িত্ব দিয়ে সৌদি আরব পাঠান। উল্লেখ্য আজ থেকে ৪৫-৫০ বছর আগে বিমান যোগে হজ্বে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম পানির জাহাজে করে ৩-৪ হাজার হাজ্বীর গ্রুপ লিডার তথা আমিরুল হজ্জাজ হিসেবে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদাকর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ৭৮ বছর হায়াতে তিনি ৪০-৪২ বারের মত পবিত্র হজ্ব ওমরাহ পালন করেন।

সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি হাজ্বীদের সেবায় বাংলাদেশের অনন্য মড়েল এ মহান ব্যক্তি বৃহত্তর পরিসরে আল্লাহর মেহমানদের আরও বেশি কেদমত করার লক্ষ্যে চট্টগ্রামে ১৯৯৬ সালে বেসরকারী ভাবে প্রতিষ্টা করেন ’শাহ আমানত হজ্ব কাফেলা’। প্রতিষ্টা লগ্ন থেকে আমৃত্যু চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে তিনি কাফেলাকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হজ্ব কাফেলায় পরিণত করেন। সাথে সাথে তাঁর পাঁচ সন্তানকেও হাজ্বীদের সেবায় উৎসর্গ করার মানষে তাদেরকে উপযুক্ত করে তোলেন। তিনি জীবিত অবস্থায় তাঁর ৫ ছেলে ও ৬ মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন করে গেছেন। এমনকি বড় ছেলের মেয়ে তথা নাতনির বিয়ে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। সে হিসেবে তিনি একজন সফল মানুষ। তিনি ইমামে আহলে সুন্নাত, গাজিয়ে দ্বীনে মিল্লাত, আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক আল কাদেরী তথা শেরে বাংলা (রহ.) এর ইন্তেকালের পর অধ্যক্ষ আল্লামা জাফর আহমদ সিদ্দিকী (রহ,) সহ কয়েকজন বরেন্য আলেমদের নিয়ে মাঠে ময়দানে সুন্নিয়াতের হাল ধরেছিলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলে সুন্নিয়াতের কথা উচ্চ কন্ঠে তুলে ধরতেন।

বিশেষ করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকা এবং নৌকায় করে কালুরঘাট দিয়ে বোয়ালখালী, কধুরখীল, মোহরা, চন্দনাইশ সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলে যেতেন। হুজুরের একটি বড় আদর্শ ছিল, মাহফিলে হাদিয়া হিসেবে ছাহেবে দাওয়াত হুজুরকে কতো টাকা দিয়েছে কোনদিন তা খুলে দেখেননি। হাজ্বীদের সেবায় আমৃত্যু কাজ করে যাওয়া হুজুর প্রায়ই বলতেন আমি ইন্তেকালের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত হাজ্বীদের সেবা করে যাব। হাজ্বীদের সেবা করলে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই পাওয়া যাবে। দুনিয়ার সুখ শান্তি বিশ্রাম আমার দরকার নেই। আমার প্রতিষ্টিত শাহ আমানত হজ্ব কাফেলা একদিন দেশের সেরা কাফেলার মর্যাদা লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। আমার সব সন্তানকে আমি হাজীদের খেদমতে নিয়োজিত রাখবো এটাই আমার ইচ্ছা। আর এখন আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। হুজুরের অসংখ্য কেরামতের মধ্যে একটা হল ২০১৭ সালের হজ্ব নিবন্ধন চলাকালীন সময়ে একরাত্রে হুজুর আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদি (রহ.) ওনার ভাতিজা ইউসুফকে ডেকে বলতেছিলেন,’ওবা ইউসুফ’ ইয়াছিন (বড় ছেলে কাফেলার এমডি) কোথায়? তাকে বল এই বছর ২৭২ জন হাজীর নিবন্ধন হবে না। এগুলো আটকে থাকবে। তাকে বল (ইয়াছিন) সিলেটে হযরত শাহ জালাল (রহ.) ও শাহ পরানের (রা.) মাজারে গিয়ে সেখানে জিয়ারত ও গরিব মিসকিনকে খাদ্য খাওয়াতে এবং জিয়ারত শেষে ওই দুই মহান ওলীর ওসিলায় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতে। এতে পরিত্রান পাওয়া যাবে এবং নিবন্ধন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ইউসুফ এ কথা বলার পর আলহাজ্ব মুহাম্মদ ইয়াছিন অফিসে বসে হিসাব করে দেখলেন, ঠিকই ১৬০০ হাজ্বীদের মধ্যে ২৭২ জনের নিবন্ধন হয়নি। অথচ সময় আছে একদিন। পরে শাহ জালাল (রা,) ও শাহ পরানের (রা,) মাজারে জিয়ারত করার পর আল্লাহর মেহেরবানী ও হুজুরের দোয়ায় ওইদিনই ২৭২ জনের নিবন্ধন হয়ে গেল। এতে ১৬০০ জন হাজ্বীদের পরিপুর্ন কাফেলা নিয়ে হজ্ব পালন করতে সক্ষম হয় শাহ আমানত হজ্ব কাফেলা।

আরেকটি অনন্য কারামত হল, হুজুর ইন্তেকালের ১০ দিন পুর্বে মুরাদপুরস্থ শাহ আমানত হজ্ব কাফেলার নতুন ডেকোরেশন করা অফিসে এসে দোয়া মুনাজাতের পর অধ্যক্ষ আল্লামা নুরুল মুনাওয়ার ও মাওলানা সৈয়দ মফজল আহমদ এই দু’কজনের সামনে বললেন, আজকেই আমার অফিসে শেষ আসা, এরপর থেকে আমি আর আসতে পারব না। একজন মানুষ বুজুর্গ হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় দলিল আর কি হতে পারে? তিনি তার ইন্তেকালের পুর্বে ইন্তেকালের খবর বলতে পারেন। হুজুরের ইন্তেকালও এমন সময় হয়েছে যখন হজ্ব কাফেলার কাজ তথা চাপ কম। শুধু তাই নয় তার ৫ ছেলে ও ৬ মেয়েসহ আত্বীয় স্বজন, ভক্ত, শুভাকাঙ্কীসহ হাজার হাজার মুসল্লি উপস্থিত ছিলেন। যদি জিলহজ্ব মাসে উনার ইন্তেকাল হত তাহলে উনার ছেলেরাই থাকতেন মক্কা বা মদিনায়। স্মরনীয় যে, বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর যে স্থানে হুজুরের মাজার শরীফ রয়েছে সে ওয়াজেদিয়া জায়গাটি ছিল একসময় জনমানবহীন, অবহেলিত, অনুন্নত এমনকি দিনের বেলায়ও সেদিকে মানুষ তেমন একটা যেত না। অথচ আল্লাহর অলিদের কি রহস্য! কি কেরামত! আল্লামা ছালে জহুর ওয়াজেদী (রহ.) এর মত একজন বরেন্য আলেমে দ্বীনের ছোঁয়ায় এটি এখন নগরীর সবচেয়ে দামী এলাকা। সেটি আজ মানুষের পদচারনায় মুখরিত। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রাচীন চাঁটগার অলি বুজুর্গ হযরত শাহ আমানত ও হযরত শাহ বদর আউলিয়া (রা,) সহ অন্যান্য অলিদের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করি, যাদের হাতের ছোঁয়ায় এক সময়ের জনমানবহীন চাঁটগা শহর এখন জনাকীর্ন।

আমরা আশা করি অদুর ভবিষ্যতে এ এলাকা ও মাজার সংলগ্ন সড়কটি হবে আন্ত: জেলা ও আন্ত: দেশিয় মহাসড়ক। তার প্রাথমিক সুচনা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটি এখন ভক্ত জায়েরীনদের জেয়ারত ও পদচারনায় মুখরিত। বর্নাট্য জীবনে বহুমাত্রিক গুন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এ বুজুর্গের মাজারে প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত নামাজান্তে জেয়ারত সহ প্রতি বৃহস্পতিবার বাদে এশা সাপ্তাহিক মাহফিল অনুষ্টিত হয়।

এ ছাড়া প্রতিমাসের শেষ বৃহস্পতিবার বাদে এশা আটশত থেকে এক হাজার লোকের খাবারের ব্যবস্থা সহ মাসিক মাহফিল অনুষ্টিত হয়। এতে বাংলাদেশের বরেন্য আলেমেদ্বীনগন উপস্থিত থেকে দ্বীন, শরিয়ত, তরিকত ও মাসয়ালা মাশায়েক সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ মহান বুজুর্গ ১৪ জানুয়ারী ২০১৭ ইং শনিবার শেষ রাতে মাওলায়ে হাকীকির সাক্ষাত লাভে ধন্য হন। তাঁর মাজার শরিফকে ঘিরে একটি পুর্নাঙ্গ ইসলামী কমপ্লেক্স গড়ার কাজ এগিয়ে চলছে। তার ১ম বার্ষিক ওরশ উপলক্ষে দুদিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসুচী গ্রহন করা হয়েছে। এ মহতি মাহফিলে সুন্নি পীর-মাশায়েখ, দেশ বিদেশের বরেন্য আলেমে দ্বীন, মন্ত্রী-মেয়রসহ উচ্চপদস্থ সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ইসলামী চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.