চট্টগ্রামে সাংসদ ইউসুফ ও একজন হাসান ফেরদৌস

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃঃ  ‘ছিল না তো কোন গাড়ি, কিংবা কোন ফ্ল্যাট বাড়ি। সাধারন বেসে বসবাস। ছিল যত দুরাচারী অন্যায়-অবিচারী, অসৎ এর লাগি এক ত্রাস, কথা ছিল সাফ সাফ’। এই কবিতাটি লিখেছিলেন সদ্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নুর মোহাম্মদ রফিক ভাই আরেক সাংবাদিক নেতা আলতাফ মাহমুদের মৃত্যুতে। এই কবিতার প্রতিটি চয়ণ মনে পড়ল রাঙ্গুনিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ ইউসুফের মৃত্যুর খবরটি পাওয়ার পর।

সাবেক সাংসদ, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউসুফ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ১৯৯১ সালে ৮ দলীয় জোট থেকে কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে তিনি রাঙ্গুনিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ধ্বস নামিয়ে দেন সাকা বাহিনীর সাম্রাজ্যে। ১৯৬৯ সালে ছাত্র ইউনিয়নের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাম রাজনীতি সিবিপি ও ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।

ব্যক্তি জীবনে অবিবাহিত এই রাজনীতিবিদ নিজের পুরোটা সময় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ এর নির্বাচনে সাকার ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। এমপি থাকাকালীন সময়ে বিলাস বহুল জীবন যাপন উপেক্ষা করে যাত্রীবাহী বাসে-রিক্সায় চড়ে ও সাধারণ মানুষের সাথে একাকার হয়ে তার নির্বাচনী এলাকায় মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে নিরলস কাজ করেছেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর থেকে রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতিতে তিনি কোনঠাসা হয়ে পড়েন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে রাজনীতির মাঠ থেকে আড়াল হয়ে যান তিনি। এর পর থেকে শারিরীকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ছোট ভাই সেকান্দর গ্রামের একটি চা দোকান চালিয়ে কোন রকম তার চিকিৎসা সেবা চালিয়ে গেলেও অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা করতে পারছিলেন না। কিছুদিন আগে তার এই দুর্দশার চিত্র মিডিয়াতে প্রথম তুলে ধরেন সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস।

হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায় এমপি ইউসুফ
হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায় এমপি ইউসুফ পাশে সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস চিকিৎসার খোঁজ খবর নিচ্ছেন

এরপর প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। তিনি উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ দিলে গত ৯ জানুয়ারী বিকেলে তাকে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সপ্তাহে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনেকটা অযত্ন-অবহেলা ও অনাদরে এই সৎ মানুষটি মারা গেছেন। আমার কাছে অবাক লাগে, দীর্ঘদিন ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষটি রোগশয্যায় পড়ে ছিলেন। এমনকি তাঁর পায়েও পচন ধরেছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য রাঙ্গুনিয়াতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা, শিল্পপতি, দানবীর, সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ, বুর্জোয়া বড় ব্যবসায়ীদের অভাব ছিল না। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেন নি। ’৭১ এর রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউসুফ বর্তমান সময়ের এমপি-মন্ত্রীদের মতো ডিউটি ফ্রি গাড়ি, বিলাসী জীবন, পুলিশ এস্কট, লাইসেন্স পারমিট, তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য ও তোষামোদী বা মালিশের রাজনীতি করেননি।

এমপি হয়েও তাকে দেখেছি পাবলিক বাসে চড়ে শহরে আসা যাওয়া করছেন! অভাব অনটন তার সারাজীবন পিছু ছাড়েনি। এমপি থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকবার তাঁর সাথে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় কিংবা কর্পোরেশনের অফিস কক্ষে দেখা হয়েছে। এমনকি দুইবার তার বাড়িতেও গিয়েছি। সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছি।

মহিউদ্দিন চৌধুরী সাংসদ ইউসুফকে দেখলেই ঠাট্টা-মশকরা করতেন। একদিন আমাকে বলেন, ‘অডা এই এমপির সাক্ষাতকার লই তারে বাড়ি যাইবার টেয়া দিবি’। চশমাহিলের মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় এলেই মহিউদ্দিন ভাই ভালভাবে নিজ হাতে ভাত খাওয়ানোর পর পাঞ্জাবীর পকেটে কিছু টাকা গুজে দিতেন।

এ সময় মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাকে বলেন, ‘তুই চোখ বন্ধ কর’। গোপনে সামান্য সহায়তা এই চট্টলবীর দীর্ঘদিন উইসুফকে করেছেন। মানুষকে জানিয়ে, ছবি তুলে, পত্রিকায় ছাপিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনো অর্থ সাহায্য করেননি। সাবেক সাংসদ ইউসুফের খবর রাখেনি এই সভ্য সমাজ। কোন দলীয় নেতা তাকে রাঙ্গুনিয়াতে সাহায্য করা দুরে থাক, দেখতেই যাননি!

সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস মিডিয়াতে ইউসুফ মৃত্যু শয্যায় লড়াই করছেন এমন সংবাদ টিভিতে প্রচার করার পরেই নেতারা ছুটাছুটি শুরু করেন তার বাড়িতে। ক্যামেরা ও মোবাইলে ছবি নেওয়া, ফেসবুক-টুইটারে পোষ্ট দেয়া ও পত্রিকায় প্রেস রিলিজ আসতে থাকে। তাঁর প্রতি মোহাব্বত এখন যেন উপচে পড়ছে। একজন সৎ, সাহসী রাজনীতিবিদ ইউসুফের মৃত্যু আমাদের অনেক কিছু জানান দিয়ে গেছে। সৎ মানুষের মূল্য এই সমাজে কতটুকু আছে তাও উপলব্দি করা গেছে। আওয়ামী লীগের দু:সময়ে রাঙ্গুনিয়ায় সাকা বাহিনীর সশস্ত্র তান্ডবের মুখে জীবনকে বাজি রেখে রাজনীতি করেছেন তিনি।

’৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম সাক্ষাতকার গ্রহন করতে। সাক্ষাতকার গ্রহন শেষে তিনি বলেন, ‘কি খাওয়াব আপনাকে। এত দূর থেকে এসেছেন। চা-নাস্তা সেরে ঘর থেকে বের হতে হতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ’৭১ রনাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজনীতি করি সাধারন মানুষের জন্য। সাকা বাহিনী আমাকে সব সময় হুমকি ধামকি দেয়, আমি তা পরোয়া করি না।

তাদের আচরণের জবাব রাঙ্গুনিয়াবাসী ব্যালটের মাধ্যমে আমাকে দিয়েছে। আমি রাঙ্গুনিয়াবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সাংসদ ইউসুফের ব্যক্তিগত জীবন খুবই সাদামাটা ছিল। এখনকার নেতাদের মত খাই খাই রাজনীতি তিনি করেননি। রাজনীতির সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতণায় লালিত স্বপ্ন নিয়ে শত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সে সময় তিনি রাজনীতি করেছেন। পাজেরো জীপ তো দুরে থাক, নিজের কোন ব্যক্তিগত বাহন ছিল না। বাসে করে সাধারন মানুষের সাথে শহরে আসা যাওয়া করতেন। ট্রেনে যেতেন প্রথম শ্রেনির বা এসি কেবিনে নয়। শোভন শ্রেনীর চেয়ারে বসে।

সাংসদ ইউসুফের এই বাঁশের তৈরী বাড়িটি প্রমাণ করে তিনি সৎ একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন
সাংসদ ইউসুফের এই বাঁশের তৈরী বাড়িটি প্রমাণ করে তিনি সৎ একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন

ঢাকা থেকে গোধুলী ট্রেনে এমনি করে চট্টগ্রাম ফেরার পথে একই বগিতে তার সহযাত্রী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে সাংবাদিকতায় এখন ২৮ বছর অতিক্রম করছি। কিন্তু এমন নিরহংকারী সাদামাটা এমপি আমার জীবনে আর একজনও দেখিনি। বিকেলে ছেড়ে আসা ঢাকা থেকে ট্রেন রাত দশটায় যখন চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছাল তখন একসাথে প্লাটফরম থেকে বের হতে গিয়ে বললেন, ‘সাবধানে কাজ করবেন। আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখিতে আছেন’। তবে, বলে হেসে হেসে বললেন, ‘তারপরও আমার মত নয়। আমি তো সাকা বাহিনীর গন্ডীর ভেতরে থাকি। ওরা সমসময় ছায়ার মত আমাকে অনুসরন করে। একদিন শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাসে সাকা চৌধুরীর এক ক্যাডার আমার বাস ভাড়া দিতে চেয়েছিল। তাকে বললাম, ‘বেয়াদবি করিস না, ভাল হয়ে যা। আমার ভাড়া আমি দেব’।

এক সময় গাড়ির ষ্টেশনে এসে পড়লাম। টেক্সি ডাকতেই তিনি বললেন, ‘না, থাক আমি রিক্সায় যাব। আপনি যান, আমার চিন্তা করবেন না। সারাজীবন অর্থাভাব যেন ছাড়ছিল না তাঁকে। সততা, কর্মনিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ন, পরিশ্রমী, নিরহংকারী এমন রাজনীতিবিদ সমাজে বিরল। এখন রাজনীতি মানেই ব্যবসা। নেতারা কিভাবে পদ-পদবী আঁকড়ে থাকবেন এবং রাতারাতি কিভাবে টাকার পাহাড় গড়ে তুলবেন এই চিন্তা থাকে সারাক্ষণ। সচ্ছ রাজনীতির পরিবেশ দিন দিন কলুষিত হচ্ছে। বিষাক্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ।

এই সমাজে আমার দেখা মানব দরদী, সাধারন মানুষের বন্ধু একজন সংসদ সদস্য ইউসুফের কোন প্রতিচ্ছবি বর্তমান সময়ের কোন দলের নেতাদের মাঝে দেখতে পাচ্ছি না। মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যবোধ-সহমর্মীতা এখন ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। এখন এমপি মানেই দোর্দন্ড প্রতাপের প্রভাবশালী ও সম্পদশালী। এখন এমপি মানেই ক্ষমতাধর। ক্ষমতার দোর্দন্ড প্রতাপের কারণে এরা সাধারন মানুষের খুব কাছে যেতে পারেন না।

সাংসদ ইউসুফও ক্ষমতায় ছিলেন! যার পকেটে গাড়ি ভাড়ার টাকাও থাকতো না। তিনি ছিলেন সততার রাজনীতির বাতিঘর। বৃহত্তর চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শাসনামলে অনেক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। কিন্তু আরেকজন ইউসুফের মত মানুষ দেখিনি। যিনি গ্রামের মেঠোপথে বা বাজারে টং দোকানে বসে সাধারণ মানুষের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতেন। বামধারার রাজনীতি করলেও আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ট হওয়াতে একসময় আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার, মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু,  মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মরহুম ইসহাক মিয়া, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে মোহাম্মদ ইউসুফের সুসম্পর্ক। সাবেক সাংসদ মাটি ও মানুষের নেতা মোহাম্মদ ইউসুফের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পত্রিকা আজকের সুর্যোদয় পরিবারের পক্ষ থেকে এই বীর সেনানীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.