সেবায় নেই অন্ততঃ ৯০হাজার চিকিৎসক, প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিয়েও লাপাত্তাঃ রিয়াজ হায়দার

0

সিটি নিউজঃ স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত কোটি মানুষের আহাজারি থামাতে পুরো সেবাখাতটি রাষ্ট্রায়াত্তকরণ এবং প্রয়োজনে সুশৃংখল সেনা ব্যবস্থাপনায় ছয় মাসের জন্য হলেও অন্তর্র্বতীকালীন নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে নাগরিক প্রস্তাবনা তুলেছেন চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয সিন্ডিকেট সদস্য রিয়াজ হায়দার চৌধুরী।

স্বাস্থ্যখাতে অরাজক অবস্থা তৈরিতে, বিশেষ করে করোনা ইস্যুতে ভীতি সঞ্চারসহ সরকারবিরোধী অবস্থান তৈরিতে রহস্যজনকভাবে মহলবিশেষ তৎপর’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি ।

নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক পেশাজীবী নাগরিক সংগঠক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ জাতীয় সংগঠন ‘বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রামের পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক । এই পেশাজীবী নেতা অন্ততঃ গত দুই যুগ ধরে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে সোচ্চার। আঞ্চলিক রোধ, মানবাধিকার, সম্প্রদয়িক সম্প্রীতি ও উন্নয়ন আন্দোলনেও ব্যাপক সক্রিয় ।

বৈশ্বিক করোনা বিদ্ধ সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার করুন চিত্র নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ভিডিও বার্তা ভাইরাল হয়েছে। তিনি তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্যসেবা খাতের অন্তর্ভাগে থাকা দীর্ঘদিনের দুর্নীতিবাজ একটি মাফিয়া সিন্ডিকেটের চিত্র।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তায় রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য সেবা সেক্টরে দীর্ঘদিনের লুটেরা ঠিকাদার গোষ্ঠী বেসরকারি কিছু হাসপাতালের নিয়ন্ত্রকদের সাথে জোট বেঁধে যেন এমন পরিস্থিতি তৈরী করছে। এমন অবস্থায় লুটেরা মাফিয়াদের ঠেকিয়ে জনস্বার্থে স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় সার্বিক নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।

পেশাজীবী নাগরিক সংগঠক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে অপেক্ষাকৃত নবীন-তরুণ চিকিৎসকদের প্রতি সিনিয়র চিকিৎসকদের কোন নির্দেশনা কিংবা সমন্বয় নেই। নবীনরা অনেকাংশেই চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মনোযোগী থাকলেও তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য নানামাত্রিক অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে ।

‘দেশজুড়ে প্রায় ৯০ হাজার চিকিৎসকের সেবা খাতে চলমান অন্তর্মুখী’ অবস্থানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, সেবাখাতটিতে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য এখন চরমে। করোনাবিদ্ধ সময়ে শুরুর দিকে থাকা পিপিই সংকট কেটে গেলেও চিকিৎসা প্রার্থীরা চরমভাবে সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন।

ভিডিও বার্তায় রিয়াজ হায়দার বলেছেন, দল-মতের বাইরে গিয়ে সেবা না দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐক্য করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুসারী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)ও বিএনপ’র বাংলাদে মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ), কিংবা বিএনপি সমর্থিত ড্যাব ও জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর অনুসারী চিকিৎসকরা।

গত ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের আগে তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল স্বাচিপ-বিএমএ’র ৫শ’ চিকিৎসক প্রস্তুত রয়েছেন। সে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও বিষয়টি উঠে আসে। অভিযোগ উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুত এই চিকিৎসকরাও কর্মক্ষেত্রের সেবা দেননি। দিনের পর দিন ভয়াবহ সেবাসঙ্কটে বাড়ছে জনরোষ। চিকিৎসা না পেয়ে খোলা আকাশের নিচে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, যারা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তাঁরা প্রাণমন দিয়েই দিচ্ছেন। তাঁদের প্রতি মানুষ কৃতজ্ঞ। এ স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসকের কথা বাদ দিলে সারা দেশে চিকিৎসক, সমভাবে নার্স, আয়াসহ সেবাকর্মীরা লাপাত্তা। সেবায় নেই দেশের অন্ততঃ ৯০ হাজার চিকিৎসক। প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিয়েও লাপাত্তা চিকিৎসকরা।

দেশের ১০৯টি মেডিকেল কলেজ, ৮বিভাগীয় পর্যায়ে দুটি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সারাদেশের ৬৪জেলায় অন্তত ৪০০হাসপাতাল রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রায় ২৬হাজার চিকিৎসকসহ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। সর্বশেষ বিএমএ-এর তিন বছর আগের নির্বাচনে সারাদেশে তালিকাভুক্ত প্রায় ৩৬ হাজার চিকিৎসক সদস্য ছিলেন বিএমএ’র। জীবন সদস্য প্রায় ১৫হাজার। স্বাচিপ’র সদস্য সংখ্যা প্রায় ২২হাজার। অন্যরা বিএনপি-জাপা, জামাত, বামপন্থীসহ বিভিন্ন সংগঠনের অনুসারীও দলে সক্রীয় নন এমন চিকিৎসক।

ভিডিওবার্তায় বলা হয়, সরকারের গত প্রায় ১১বছরের মধ্যে প্রায় ১৬হাজার চিকিৎসক ক্যাডারভুক্ত হন। সর্বশেষ ৩৯তম স্পেশাল বিসিএস এ ৩৩হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩হাজার উত্তীর্ণ হন। তৎমধ্যে ৪হাজার ৮’শকে ক্যাডারভুক্ত পদায়ন করা হয়। নন ক্যাডার হিসেবে রয়েছেন আরও অন্তত ২হাজার। সবমিলিয়ে সরকারি ২৫ থেকে ২৬ হাজার চিকিৎসক থাকার কথা। বিএমডিসির সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সরকারি হাসপাতালে, অন্যরা সব প্রাইভেট হাসপাতালে সক্রিয় থাকার কথা থাকলেও হাসপাতাল ক্লিনিকে উপস্থিতি নেই। ১শতাংশ চিকিৎসকও সেবায় নেই’। সেবায় হাতে গোনা ক’জন মাত্র।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসক বন্ধুদের জন্য উদারনৈতিক ভাবে স্বাস্থ্যবীমা ও পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এক মন্ত্রী বসলেন বেসরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারিদের একটি সমিতির সাথে। তারা কিছু শর্ত দিলেন চিকিৎসায়। কিন্তু নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন, শর্ত দিয়ে সেবা দিতে হবে এটা কেমন কথা ? দুর্যোগ-দুঃসময় ও যুদ্ধে সেবা দেওয়ার শপথ করেই তাঁরা চিকিৎসক হয়েছেন। সেবায় আবার শর্ত দেবেন কেন?

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক ; এই তিন শ্রেণীর পেশাজীবীকেই সাধারণ মানুষ নানা সময়ে বুঝে হোক না বুঝে হোক গালমন্দ করেন। এটি করা অস্বাভাবিক নয় । তবে এবারের সংকটে চিকিৎসক বন্ধুদের সিংহভাগেরই (সবার নন) আচরণ বড় বেশি অমানবিক এবং রহস্যময়। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা বাদ দিলে, আমার দেশের সাধারণ চিকিৎসক ভাই-বোনদের অনেক ত্যাগের ইতিহাস আছে । এদেশের মানবিক চিকিৎসকরা শর্ত দিয়ে সেবা দেওয়ার কথা নয়। অতীতেও করোনার চেয়ে ভয়াবহ মহামারী এসেছে। কোন সময় চিকিৎসকরা এভাবে নিজেদের গুটিয়ে নেননি। শর্ত দেননি । তাহলে এখন শর্ত দিবেন কেন ?

ভিডিওবার্তাটিতে চলমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ডঃ অনুপম সেনের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে রিয়াজ বলেন, ভয়কে জয় করে পীড়িতের পাশে দাঁড়ানোই চিকিৎসকদের কাজ। যারা মানুষের বিপদে নিজের পেশাকে অবজ্ঞা করেন, তাদের পেশায় থাকার অধিকার নেই । কোন সৈনিক যদি যুদ্ধক্ষেত্রে না যায়, তাহলে তার যেমন সৈনিক হিসেবে থাকার অধিকার নেই, তেমনিভাবে দুর্যোগে পীড়িতের পাশে না থাকা ডাক্তারের পেশায় থাকা উচিত নয়। তাঁর সনদ বাতিল করাও উচিত।

ভিডিওবার্তাটিতে এও বলা হয়, সভ্যতার ইতিহাসে এই বাংলাদেশেই কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েডসহ অতীতের মহামারীগুলো আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে সময়ে ডাক্তাররা রোগীর পাশে ছিলেন । এখন প্রযুক্তি, সুরক্ষা, প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা অনেক বেশি থাকলেও দুঃসময়ে সেবা না দেওয়াটা দুঃখজনক। অথচ ইতালি স্পেনসহ অন্য দেশের চিকিৎসকরা মানবিক সংকটে সেবা দিচ্ছেন, রোগিদের জন্য কাঁদছেনও।

বাংলাদেশে চিকিৎসকদের সেবা অনীহায় মানুষ বিতৃষ্ণ এবং বিক্ষুব্ধ হবার আশঙ্কা রয়েছে। গত ৮মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই স্বাস্থ্যখাতে অরাজকতা দেখা দেয়। শুরু থেকেই পিপিই না থাকার অজুহাতে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা করোনা সন্দিগ্ধ শুধু নয়,অন্যদেরও চিকিৎসা দিতে অনীহা শুরু করেন। চিকিৎসকরা মালিকানায় জড়িত এমন অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে তালাও ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এখন পর্যাপ্ত পিপিই আছে, তবুও কেন চিকিৎসকরা ঘরে বসে থাকবেন ? তবে কি পেশাদারিত্বের বদলে বাণিজ্য মনস্কতা’ই কারণ ? নাকি নেতৃত্বের গলদ ? নাকি নেতৃত্বে প্রকৃত পেশাদারদের অনুপস্থিতির ফসল ? নাকি উবে গেছে চিকিৎসক সমাজের চিরচেনা মানবিক রূপ ? !

ভিডিওবার্তায় রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, পেশাজীবীদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে চিকিৎসক বন্ধুদের নিয়ে এই করোনা বিদ্ধ সময়ে এসব বলার ইচ্ছে মোটেও আমার ছিলনা। তার উপর স্বাস্থ্য সেবা প্রসঙ্গ এলেই ম্যাক্স হাসপাতলে সহকর্মী সাংবাদিক রুবেলের কন্যা রাইফার ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনায় অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণকারী কিছু স্বার্থান্ধ দ্বিমুখী সাপের মত থাকা মুখও ভেসে ওঠে। তবুও ব্যক্তিগতভাবে অনেক চিকিৎসকের কাছে সেবার জন্য ঋণ স্বীকার’ করেই রিয়াজ হায়দার দেন এসব তথ্য।

তাঁর মতে, করোনা পরিস্থিতির এই মানবিক দুসময়ে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকদেরও পেশায় আনা, ইন্টার্নিশিপ করা শিক্ষার্থী ও নার্সদের সেবায় সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একাধিক রাষ্ট্রে বাংলাদেশি চিকিৎসকরাও সেবা দিতে গিয়ে পরিবারের সদস্যসহ প্রাণ দিয়েছেন । পাকিস্তান ছাড়া কোন রাষ্ট্রের কোনো চিকিৎসক পিছু হটেননি। সেদেশের বেলুচিস্তানে পিছু হটা চিকিৎসকদের পুলিশ মারধর, গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.