আমরা শূন্যের মধ্যে ভালো কিছু খুঁজছি

0

দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একজনের সন্তান লেখক, অপরজনের সন্তান ওই লেখকের বইয়ের প্রকাশক। দুজনের সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুষ্কৃতকারীরা। সন্তানহারা এই দুই পিতার সাক্ষাৎ​কার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শরিফুজ্জামান

আপনি ছেলে হত্যার বিচার চান না কেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: বিচার চেয়ে আর কী হবে? এ দেশে রাজনৈতিক সমাধান যতক্ষণ পর্যন্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ আইনগত কোনো সমাধান সম্ভব না। আমরা শূন্যের মধ্যে ভালো কিছু খুঁজছি। এটা পাওয়া সম্ভব না। আমার কাছে মনে হয়, আগে এটা আদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।

আপনি কি আবেগ বা ক্ষোভ থেকে বিচার প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেমনটি একের পর এক সাংবাদিক খুন হওয়ার পর খুলনার সাংবাদিকেরা বিচার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?

ফজলুল হক: শোনো, এটা মোটেও আবেগ বা ক্ষোভের বিষয় নয়। আমি এটা ভেবে ও নিজের যৌক্তিক বিবেচনাবোধ থেকে বলেছি। কেন বলছি—সেই জবাব এখন তোমাকে দেব না। দীপনের জানাজা ও দাফন হয়ে যাক। এরপর কোনো এক সময় বলব। এখন এটুকু বলতে পারি, বিচার দিয়ে বা আইন-আদালত দিয়ে আমরা একজনকে শাস্তি বা জেল-ফাঁসি দিতে পারি। কিন্তু যদি দেশের সার্বিক উন্নতি না হয়, সবার বিচার তো আর হবে না।

ছেলে হত্যার ঘটনায় মামলা করবেন কি না?

ফজলুল হক: নিয়ম অনুযায়ী মামলা করব। আমি আইন মেনে চলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, একটা দরখাস্ত লিখে দিতে। আমি আজ না পারলে আগামীকাল লিখে দেব। তবে তার মানে এই নয় যে, আমি এটার ওপর নির্ভর করি। আমি শুভ বুদ্ধির জাগরণ চাই। সেই জাগরণ হতে হবে সমাজে, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে।

একের পর এক ব্লগার খুন হওয়ার এখনকার এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

ফজলুল হক: এর জবাব দেওয়ার আগে তুমি আমাকে বলো, কেউ কি এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়? কেবল আইনের বিচারে একের পর এক হামলা বা হত্যার সমাধান হবে না, এ সংকট থেকে বাঁচতে আদর্শগত রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা বামপন্থী—কেউই কি এখনকার পরিস্থিতি থেকে বের হতে চায়? আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম, সেটিও পেয়েছি। কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে যে গণতন্ত্র আমরা চেয়েছি, সেটি পাইনি। কারণ ওই চাওয়ার মধ্যে ভুল ও বিভ্রান্তি ছিল। সেই ভুলের খেসারত আজও আমরা দিচ্ছি। আমরা তখন গণতন্ত্রের কথা বলেছি, সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু করেছি আবার মুছে ফেলেছি। কিন্তু কোনো চাওয়াই পূর্ণতা পায়নি।

রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে ফয়সল আরেফিনকে দাফনের সময় দাঁড়িয়ে শোকবিহ্বল বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক (সামনে ডান থেকে দ্বিতীয়) l প্রথম আলোপ্রথম আলো: তাহলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কি ঠিক ছিল না?

ফজলুল হক: স্বৈরাচারের পতন দরকার ছিল। কিন্তু সেই আন্দোলন হয়েছিল নানা শক্তির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, সামনে ছিল সুশীল সমাজের কিছু লোকজন। ফলে ত্রুটিপূর্ণ ওই আন্দোলনের চরিত্র অনুযায়ী এখন দেশ চলছে। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজকের নতুন রাজনৈতিক ধারা তৈরি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এর চেয়েও খারাপ অবস্থা তৈরি হতে পারে।

এখান থেকে ফেরার উপায় কী?

ফজলুল হক: আমাদের মুক্তি ও উন্নতির জন্য ২৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে স্বদেশ চিন্তা সংঘ অনেক দিন ধরে কাজ করছে। আমরা বলছি, নির্বাচন সর্বস্ব গণতন্ত্র থেকে বের হতে হবে। তা না হলে সব মানুষের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত হবে না। এমন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে, যারা শুধু ঐক্যের কথা বলবে না, কাজেও এর প্রমাণ দেবে। অনেকেই কথায় কথায় আজকাল বলেন, ঐক্য দরকার। কিন্তু আমার প্রশ্ন—তাঁরা কি আসলেই এটা চান। চাইলে এত দিনেও তা হয় না কেন? আমাদের এখন একটি সংকল্প ও কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ওই ঐক্য যেন লুটপাট ও ভাগাভাগির জন্য না হয়।
চুপচাপ থাকলে চলবে না, মাঠে নামতে হবে

রাজনীতির কথা বললেন, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে মানুষের করণীয় কী?

ফজলুল হক: রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি—যে যেখানে আছি সবক্ষেত্রেই আত্মনির্ভরতা ও আত্মশক্তির চর্চা করা দরকার। আমরা এখনো পরিচালিত হচ্ছি বাইরের শক্তি দিয়ে। এর অবসান ঘটাতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার। আমার মনে হয়, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের জন্য ভালো করছেন না। উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া দরকার।

ছেলের সম্পর্কে কিছু বলবেন?

ফজলুল হক: ও কারও সঙ্গে কোনো দিন খারাপ ব্যবহার করেছে, এটা শুনিনি। জ্ঞানত কারও ক্ষতি করেনি। ওর টাকাপয়সার প্রতি মোহ ছিল না। যতটুকু দরকার ততটুকু পেলেই সন্তুষ্ট থাকত। ধর্ম নিয়ে কখনোই বাড়াবাড়ি করেনি। শুধু অভিজিতের বই প্রকাশ করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।

সাক্ষাৎকারটি সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.