জুবায়ের সিদ্দিকী –
চট্টগ্রামের কর্নফুলী এলাকার বাস্তুহারা কলোনী আবারো দখলের পায়তারা চালাচ্ছে ইয়াবা সম্্রাট ও বহু অপরাধের নায়ক বার্মা জসিম ও তার বাহিনী। এই আতঙ্কে এখন রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বাস্তুহারা কলোনীতে বসবাসরত সাধারন মানুষরা। বাস্তুহারা কলোনিতে বসবাসকারী জয়নাল আবেদিন জানান,’চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয় ও যুবলীগ নেতা আকতারের উপর হামলার ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ইয়াবা সম্রাট জসিম ও তার বাহিনীর লোকজন পলাতক থাকায় আমরা স্বস্তিতে ছিলাম। এ এলাকায় এখন ইয়াবার দৌরাত্ব্য কমেছে। জয়নাল জানান, ’ইয়াবা সম্রাটও মানবপাচারকারী জসিম ও তার বাহিনী আবারও বাস্তুহারা কলোনী দখল করে সেখানে ইয়াবা, ফেন্সিডিল বিক্রি, মানবপাচার সহ বিভিন্ন অপকর্ম চালানোর পায়তারা করছে।
অভিযোগ রয়েছে, মানব পাচার, ইয়াবা ব্যবসা সহ বহু অপকর্মের নায়ক বার্মা জসিম মুক্তিযোদ্ধা নামধারী কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বাস্তুহারা কলোনী দখলের মাধ্যমে মাদক ও মানবপাচারের ডিপো বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে,’ বার্মা জসিমের নেতৃত্বে বাকলিয়ার শহীদ এন.এম.এম.জে কলেজ সংলগ্ন বাস্তুহারা কলোনীতে প্রকাশ্যেই চলতো মদ, গাঁজা, ইয়াবা ট্যবলেট ও হেরোইন ব্যবসা। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, জবরদখল, অস্ত্র, মাদক ও সন্ত্রাসী লালনের অভিযোগে ইতিমধ্যে নগরীর বিভিন্ন থানা ও আদালতে অন্তত: ৩৬টি মামলা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মামলার কারনে জসিম বাস্তুহারা কলোনিতে না থাকলেও তার প্রতিনিধি হিসেবে বেশ কিছু লোকজন কাজ করছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন রয়েছে। তাদের অপকর্মে বাধা দিলে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করা হয়।
বাস্তুহারা কলোনিতে মাদক ব্যবসা সহ অসামাজিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে ৩৫নং বক্সিরহাট ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী নুরুল হকের পরিবারের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, জসিম ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রক্ষা পায়নি স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা মো: সালাউদ্দিন সহ ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে কয়েকটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে জসিমের অনুসারীরা। খবর নিয়ে জানা যায়, দুই যুগ আগে বার্মা জসিমের পুর্ব পুরুষরা মিয়ানমার থেকে এসে মিরসরাইতে বসতি গড়েন। তিনি ও তার পরিবারের সবাই রোহিঙ্গা। এরপর বিভিন্ন মিল কারখানা, ইট ভাটায় দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন জসিম। ২০০০ সালের শুরুর দিকে ভাগ্য বদলের আশায় ফিরিঙ্গীবাজার ফিশারীঘাট এলাকায় এসে জসিম ট্রলার থেকে মাছ নামানোর কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে পরিচয় ঘটে রাজাখালী এলাকার শামসুল আলম তালুকদারের সঙ্গে। সে সময় নতুন ব্রীজ এলাকার শহীদ এন.এম.এম জে কলেজ সংলগ্ন বাস্তুহারা সমিতির উপদেষ্টা ছিলেন তালুকদার। নানাভাবে তালুকদারের মন জয় করে বিশ্বস্ত সহচরে পরিনত হয়ে বাস্তুহারা সমিতিতে নাম লেখান জসিম।
তালুকদারের সঙ্গে মাত্র কয়েক বছরের সখ্যে পর্যায়ক্রমে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন বার্মা জসিম। তার এই অনৈতিক দখলবানিজ্য ও এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গেও কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় তালুকদার তার অপকর্মের প্রতিবাদ করায় অস্ত্রের মুখে তালুকদারের কাছ থেকে সমিতির দায় দায়িত্ব ছিনিয়ে নেন এবং নিজেই নিজেকে সভাপতি ঘোষনা করেন। নিরক্ষর জসিমের স্বাক্ষর করার ক্ষমতা না থাকলেও রাখেন লেখাপড়া জনা কয়েকজন লোক। ইটভাড়া ও শুটকি শ্রমিক থেকে নানা অপকর্ম কয়ে বনে যান তিনি কোটিপতি। বাকলিয়ার শত শত একর সরকারী খাস জমি সমিতির কাগজের উপর সই করে নামে বেনামে বিভিন্ন লোকের কাছে গন্ডা দুই লক্ষ টাকা করে বিক্রি করেন তিনি। রাজনৈতিক পরিচয় রহস্যময় হলেও তার সঙ্গে পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যতা গড়ে উঠে।
শুধু বাস্তুহারা কলোনিতে নয়, প্রকাশ্যে মদ, গাঁজা ও ইয়াবা ট্যাবলেট ও হেরোইন ব্যবসা করে নগরীর বিভিন্ন শপিং মলে নামে বেনামে একাধিক দোকান ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন জসিম। মিরসরাইতে আলিশান বাড়ি, নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারে ২ কোটি টাকা মুল্যের আট্টালিকা, এয়াকুব নগরে রয়েছে ১০ কোটি টাকা মুল্যের জমি। নগরীতে ছিনতাই ও মাদকব্যবসা পরিচালিত হতো এই বাস্তুহারা কলোনি থেকে। এখনো সারাদেশে তার ইয়াবা ও মাদকের নেটওয়ার্ক রয়েছে। জানা যায়, জসিমের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, জবরদখল, অস্ত্র, মাদক ও সন্ত্রাসী লালনের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় ৩৬টি মামলা রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাস্তুহারা সমবায় সিমিতির নেতৃত্ব দিতেন বামা জসিম। গত সিটি নির্বাচনে তিনি বক্সিরহাট ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। এরপর তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
ইয়াবা ব্যবসা থেকে শুরু করে সকলপ্রকার মাদকের রমরমা বানিজ্যের নাটের গুরু এই জসিম। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মানবপাচার ও জঙ্গি প্রশিক্ষনেও জসিম জড়িত থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। নগরীতে কোটিপতি সন্ত্রাসী গড়ফাদার হিসেবে জসিমের পরিচিতি রয়েছে। স্থানীয় সুত্রগুলো জানায়, টেকনাফ থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নগরীতে ট্রানজিট করায়, ইয়াবা বিক্রির ব্যবসা ও মানবপাচারের নেপত্যে হাত রয়েছে জসিমের। নগরীর ছিচকে চোর থেকে শুরু করে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকের আশ্রয়ের ঠিকানা জসিম। সরকারী জমি দখল করে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের এ পর্যন্ত ৩৩টি মামলা বিভিন্ন থানায় থাকলেও পুলিশ তাকে স্পর্শ করে না। বিগত সিটি নির্বাচনের পর তার দেহরক্ষী সহ আটক হলেও সে সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়।
রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায়, তখন সাধারন বিচারপ্রার্থী কিংবা ভুক্তভোগী লোকজনের দুর্ভোগ শেষ থাকে না। আবার সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে পুলিশ কর্মকর্তারাও যখন সরকারী খাস জমি লুটে জড়িত থাকেন তখন সরকারের পক্ষে হরিলুট নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয় না। এভাবেই পুলিশকে সাথে নিয়ে ৫ হাজার কোটি টাকার সরকারী জমি দখল উৎসবে মেতেছে কর্নফুলী পাড়ের ভুমিদস্যুরা। তোয়াক্কা করছেনা সরকারী লাল রং এর সাইনবোর্ডও। এখানকার মাদক ও পতিতাবৃত্তির নিয়ন্ত্রনও রয়েছে পুলিশের হাতে। জানা যায়, বাকলিয়ার কর্নুফলী নদীর তীরের খাস জমি দখলবাজিতে পুলিশের সদস্যদের নামের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক ফারুখ হোসেনের নাম। যিনি বর্তমানে জেলার জোরারগঞ্জ থানায় কর্মরত আছেন। নগরীর বাকলিয়া থানার চাক্তাই পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত থাকাকালীন জড়িয়ে পড়েন খাসজমি দখলে। ২০১৩ সালে চাক্তাই ফাঁড়ি থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) তে বদলী হয়ে গেলেও সরকারী জমির টানে পুনরায় বদলী নেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশে।
পদায়ন হয় মিরসরাই উপজেলার নতুন থানা জোরারগঞ্জ। সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ মার্চ তিনি ওই থানায় যোগদান করেন। জোরারগঞ্জ থানায় থানায় দায়িত্বে থাকলেও দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে তার বাকলিয়াতে। বাকলিয়ার ক্ষেত্রচর এলাকায় খাসজমিতে তার রয়েছে ১৪ কাঠা জমি। যেখানে ২ কাটার ৭টি প্লট। যার ৪টি প্লটে সেমিপাকা ঘর তৈরী করে ৪ পরিবারকে ভাড়ায় লাগানো হয়েছে। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাকলিয়ায় এন.এম.এম.জে কলেজ হয়ে সৎসঙ্গ আশ্রমের সন্নিকটে ক্ষেতচর সুবিশাল এলাকায় এস.আই ফারুকের সেমিপাকা নির্মিত বাড়ি। সবুজ রংয়ের এই বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ’মা-মঞ্জিল’। এখানকার কৃষ্ণ মন্দিরের সামনে এস.আই ফারুকের ব্যবহুত মোটরসাইকেলটিও দেখা যায়। ঢাকা মেট্রো-ল-২৫-৮১৬১ নাম্বারের মোটরসাইকেলটির নাম্বার প্লেটের উপরে ’পুলিশ’ শব্দটি লেখা রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ক্ষেত্রচর এলাকায় খাসজমি দখল নিয়ে বাস্তুহারা সমিতি ও দর্জি সমিতির সাথে বিরোধ দির্ঘদিনের। বাস্তুহারা সমিতির ১৪ কাঠা জমি নিজের দখলে নেয় এসআই ফারুখ। দিনের বেলায় স্থানীয় সন্ত্রাসী ও ভুমিদস্যুদের নিয়ে এস.আই ফারুখ মদের আড্ডা বসায়।
বাস্তুহারা বস্তীতে মদ, নারী ও চোরাচালান সহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ডে বার্মা জমিসের গডফাদার হিসেবে ভুমি রাখছে এই ফারুখ। এ ছাড়াও রয়েছে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। জানা গেছে, এস.আই ফারুখ ছাড়াও বাকলিয়া থানার এস.আই আবু তাহেরের দখলেও রয়েছে বিপুল পরিমান খাসভুমি। এ বছর নতুন করে জমি দখলে নিয়েছে এস.আই জাহাঙ্গীর। কয়েকটি ঘটনায় মামলাতো দুরে থাক, পুলিশ অভিযোগও নেয়নি। স্থানীয় সুত্র জানান, জমি দখল-বেদখল ঘটনায় গত চারমাসে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। দুটি ঘটনায় এস.আই ফারুখ নেতৃত্ব দিলেও এসব ঘটনার কোনটিতে থানা মামলা নেয়নি। পুলিশ মামলা না নিলেও দুই ঘটনার একটি নারী নির্যাতন ও অপরটি মারামারির অভিযোগে এস.আই ফারুকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। ২১ জুলাই তারিখের সংঘর্ষের ঘটনাটিতে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মামলা হলেও পুলিশ সুপার, পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও র্যাব মহাপরিচালককে লিখিতভাবে অভিযোগ দেন সেলিনা আক্তার নামের একজন ভুক্তভোগী। এই অভিযোগে পুলিশ সুপারের নির্দেশে এস.আই ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পান সীতাকুন্ড সার্কেল এএসপি সালাউদ্দিন সিকদার। তবে বাকলিয়ার ক্ষেতচর এলাকায় সরকারী খাস জমি নিয়ে এতকিছু ঘটলেও কিছুই জানেন না বাকলিয়া থানার ওসি মোহা¤মদ মহসীন।
পুলিশ সদস্য কর্তৃক সরকারী সম্পত্তি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন,’বাস্তুহারা এলাকায় কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ আমার কাছে নাই। তবে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে আমরা দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেই। সিতাকুন্ড সার্কেল এএসপি সালাউদ্দিন সিকদারের কাছে জানতে চাইলে বের হয়ে আসে এস.আই ফারুকের বিরুদ্ধে আরও নতুন তথ্য। তিনি বলেন, জোরারগঞ্জ থানার এসআই ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আমি তদন্ত করছি। সরেজমিন বাকলিয়ার ক্ষেতচর এলাকায় গিয়েছিলাম। ওখানে ফারুকের কিছু জমি রয়েছে।
ফারুক দুই বছর যাবত জমিতে ঘর বানিয়ে ভাড়ায় লাগিয়েছে। জমি নিয়ে বাস্তুহারা সমিতির সাথে দর্জি সমিতির বিরোধও রয়েছে। আমি অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষ্যপ্রমান নিয়েছি। দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন দাখিল করবো। তিনি আরও বলেন, ’আমার জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক জানিয়েছে ওই জমি তার স্ত্রীর নামে নেয়া। তার স্ত্রী বাস্তুহারা সমিতির সদস্য বলে তিনি দাবী করেন। তবে বার্ম জসিম অস্বীকার করে বলেছেন, ’এসআই ফারুকের স্ত্রী নয়, তার বোন বাস্তুহারা সমিতির সদস্য।