’গুডস হিল একাত্তরের সেই বধ্যভুমি’ এবং সাকার একাল সেকাল

0

জুবায়ের সিদ্দিকী  – 

আজকের সুর্যোদয়ের নামে মামলা হয়েছে। সমন এসেছে অফিসে। এই তথ্য ফোনে জানান আমার এক সহকর্মী। অফিসে এসে সমন পাওয়ার পর ঢাকায় প্রধান সম্পাদক মহোদয়কে জানালাম। আদালতে গিয়ে মামলার নথি নিয়ে জানতে পারলাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে তার চাচা আবু বক্কর চৌধুরী এই মামলার বাদী। সাক্ষী হয়েছেন সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী। দুপুরে বাসায় ফিরে এলাম। দুপুরের ভাত খাওয়ার আগেই ফোন এলো ল্যান্ড ফোনে, ’কুত্তার বাচ্চা আগ্রাবাদ থাকিস, তোকে দেখে নেবো’’। বুঝতে পারলাম এই সেই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী। বলছি ১৯৯৮ সালের কথা। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। আদালতে আমাদের পক্ষে আইনজীবি হলেন প্রবীন আইনজীবি ইব্রাহীম হোসেন বাবুল। তাঁকে সহায়তা করতেন ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী। আমাদের যে লেখাটি ছিল তা হলো ’গুডস হিল একাত্তরের সেই বধ্যভুমি’।এই কলামের লেখক ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদুত, যিনি একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ভারতে বাংলাদেশ দুতাবাস ঘোষনা দেন। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ।

প্রধান সম্পাদক মহোদয় বিষয়টি জানালেন মহিউদ্দিন স্যারকে। তিনি আমাকে ফোন করে বললেন,’ জুবায়ের ভয় পেয়েছো কি? এগিয়ে যাও সামনে। আল্লাহ আছে আমাদের সাথে। ইতিহাস সত্য, এটা মিথ্যা হতে পারে না। ইতিহাস একদিন কথা বলবে। যাক, মামলার আসামী ছিলেন প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক ও মহিউদ্দিন আহমদ। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। মামলা ছিল চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতে। তিন বছর যাবত একমাস পর পর আদালতে আজকের সুর্যোদয়ের পক্ষ থেকে আমাকে হাজিরা দিতে হয়েছে। ২০০০ সালে এই মামলা খালাস করে দেন তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট মরহুম মাঈনুদ্দিন খোন্দকার। মামলা খালাসের মাস দুয়েক আগে আদালতে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে আমার দেখা হয়।

সুর পাল্টে তিনি আমাকে বলেন,’ গেদুচাচা ক্যান আছে। লেখালেখি কনে গইল্য। আমি বললাম, আপনারা প্রতিবাদ দিতে পারতেন, আপনাদের বক্তব্য দিয়ে। মামলায় কি জয় হবে?’’ তিনি বললেন,’ দেখা যাক মামলার কি হবে? তবে আমার সাথে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর আলাপ ছিল ভদ্রতার ভেতর। ভাল ব্যবহার ছিল তার। তিনি জীবিত নেই। সাকার পরিবারের মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মানুষের সাথে মোটামুটি ভাল ব্যবহার করতেন। তবে অন্যদের ব্যবহার ছিল অসভ্য।

গুডস হিলের বাড়িটি এখন ফাঁকা। বহুল আলোচিত এই বাড়িটিতে এখন নেই সাকার সমর্থক অনুসারীদের আনাগোনা। পরিবারের সদস্য ও আত্বীয় স্বজনদেরও আগের মতো যাতায়াত নেই। রহমতগঞ্জের শেষ প্রান্তে গুড়স হিলের ফটক থাকে সারাদিন বন্ধ। মেহেদি পাতার ঝাড়ের দেয়াল, সেন্ট্রি বক্স, ঘনসবুজ গাছপালা সবই আছে শুধু সেই জৌলুস নেই। যেন মৃতপুরি, ভুতের বাড়ি। কে বলবে, এ বাড়িতে থাকতেন দাম্ভিক সেই সাকা চৌধুরী। একাত্তরে রাউজানের কুন্ডেশ্বরী মন্দিরে প্রার্থনারত অধ্যক্ষ নুতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, কুন্ডেশ্বরী গ্রাম, জগতমল্ল পাড়া, উনশত্তরপাড়ার তান্ডবের দায়ে যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাদের দায়ে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেফতারের পরপরই তার মামলার স্বাক্ষী এবং চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে দাবী উঠেছিল গুডস হিলে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন আর হত্যা হয়েছে। ওটা বধ্যভুমি। তাই গুডসহিলকে মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর করা হোক। সাকার ফাঁসির পর এই দাবী আরও জোরালো হচ্ছে। রহমত গঞ্জে যারা এখন প্রতিদিন আসা যাওয়া করেন বিশেষ করে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, যাত্রী এবং পথচারীরা একবার হলেও উকি মেরে দেখার চেষ্টা করে বাড়িটি।

আসপাশের ভবনে উঠে ভেতরের চিত্র দেখার চেষ্টা করে অনেকেই। তবে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ফটক দিয়ে কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখা না গেলেও ভেতরে কয়েকজন কর্মচারীকে দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত গুডস হিল কে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করার দাবীর পক্ষে নির্যাতিতরা বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরী সহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাসহ হত্যা, নির্যাতন ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একাত্তরে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারন মানুষ ধরে এখানে অমানুষিক নির্যতন করা হত। একাত্তরে নির্যাতন ও হত্যার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষনে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করা দরকার। ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী ম. ছলিম উল্লাহ বলেন,’একাত্তরে এই গুডস হিলেই মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেককে ধরে এনে নির্যাতন করা হত। এর নেতৃত্ব দিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবার ও তার অনুসারীরা।

এই গুডস হিলে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক নির্যাতনের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তাই এটিকে নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করা হলে আমরা যারা নির্যাতিত, যারা একাত্তরে এই টর্সার সেলে প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্বার শান্তি পাবে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী লেখক গবেষক সিরু বাঙ্গালী বলেন, আমি ট্রাইব্যুনালের প্রধান পসিকিউটর এবং তদন্ত কর্মকর্তাকেও বলেছি, একাত্তরে এই গুডস হিলে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে এনে টর্চার করা হতো। অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। এই ঘৃনিত গুডস হিলের প্রতি চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও সাদারন মানুষের অনেক নির্যাতনের অনেক স্মৃতি চিহ্ন জড়িত। তাই এটাকে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করার দাবী জানিয়েছি। সরকার এই পাহাড়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতনের স্মৃতি চিহ্নগুলোকে ধরে রাখলে তরুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের প্রতি এই দাবী জানাচ্ছি। দুইদিন ধরে গুডস হিলের মুল ফটকের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, পাশেই লাগানো রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। নিরাপত্তা চৌকিতে রয়েছে দুইটি রেজিষ্টার। যাতে অতিথি, ও কর্মচারীদের নাম, পরিচয়, টেলিফোন নম্বর লিখে রাখা হচ্ছে। ওই চৌকির দেওয়ালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রঙ্গিন ছবিযুক্ত সাটানো রয়েছে অনেক আগের রাঙ্গুনিয়াবাসীকে ঈদ শুভেচ্ছা।

একসময় নেতাকর্মীদের আনাগোনায় মুখর থাকতো যে কাছারি ঘরটি তার বারান্দায় দুতিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। তার পাশে জাহাজে মালামাল আনা নেওয়ায় ব্যবহুত দুটি কন্টেইনার রাখা। কন্টেইনারের পাশে অনেকগুলো বড় বড় নীল ড্রাম। লাল রঙ্গের ইউনিফর্ম পরে দুইজন লোক টেবিলে আ্ড্ডা দিচ্ছেন। কর্মচারীদের ষ্টাফ কোয়ার্টারে হাটাচলা করতে দেখা গেছে কয়েকবার। গুডস হিলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছাড়াও অপর তিন ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা পৃথক ভবনে থাকতেন। এর মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। তবে বর্তমানে সেখানে কারা রয়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

সাকার যেভাবে উত্থান ঃ ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম সাকার। তার পিতা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীও ৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান ছিল।৭১ সালের আগষ্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে সাকা পাড়ি জমান লন্ডনে। দেশে ফেরেন ৭৪ সালের এপ্রিলে। যোগ দেন রাজনীতিতে।

১৯৭৯ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় পাটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ৯০ এর দশকে গঠন করেন ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল এনডিপি। ৯১ এ নিজ দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৫ সালে এরশাদের মন্ত্রী হবার পর থেকে রাজনৈতিক দাপট ও ক্ষমতার শীর্ষে পৌছে যান সাকা চৌধুরী। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত অনেক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করে সাকা বাহিনী। তার আলোচিত ক্যাড়ারদের মধ্যে ফজল হক, বিধান বড়–য়া, জানে আলম, আবু তাহের, রমজান সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী চক্র গোটা উত্তর চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দেশের রাজনীতিতে বেশ আলোচিত সাকাকে নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ একসময় আতঙ্কিত থাকতো। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী প্রমানিত হয়ে ফাঁসিরর মধ্য দিয়ে যার সমাপ্তি ঘটলো।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.